মঙ্গলবার, ৯ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

গুণগত শিক্ষা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাহালুল মজনুন চুন্নু

গুণগত শিক্ষা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালি জাতির অহংকার। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ধূলিকণা অপরাজেয় সংগ্রামী ইতিহাসের সাক্ষী। বাঙালি জাতির ইতিহাস আর এই বিশ্ববিদ্যালয় যেন একই সূত্রে গাঁথা। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র্র করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন আর চেতনার নাম। এর প্রমাণ অতীতের সোনালি ইতিহাস। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছিষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও মহান একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নেতৃত্বের অগ্রভাগে। এখান থেকেই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইতিহাস নয়, এর ইতিহাস এই বাংলার মানুষের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বিবর্র্তনের ইতিহাস, পরাধীনতার শিকল ভেঙে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনার ইতিহাস। তাই বাঙালি জাতির ইতিহাস থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কোনোভাবেই পৃথক করা যায় না। প্রথম উপাচার্য ফিলিপ জে হার্টগ চেয়েছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে একটি মডেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বিদ্যাচর্চার খ্যাতিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি উপমহাদেশের একটি শ্রেষ্ঠ উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েও ছিল। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা এবং রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান ও চর্চার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে আসছে। একটা সময় পর্যন্ত নতুন জ্ঞানের সন্ধান-সৃজন ও জ্ঞানের দিগন্তের প্রসারণকে এই বিশ্ববিদ্যালয় সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিল। পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন কাঠামো এবং বাজারব্যবস্থার সমন্বয়ের প্রয়োজনে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের বিষয়টি। ফলে নতুন জ্ঞানের দিগন্ত উন্মোচনের সঙ্গে সঙ্গে একদল পেশাগত দক্ষ মানুষ সৃষ্টির কারিগর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এ দেশের প্রতিটি সেক্টরেই নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সুনামের সঙ্গে কাজ করে আসছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়গুলোয় অবস্থান করে শক্ত হাতে হাল ধরে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কথায় বলে, লেখাপড়া করা ছাড়া কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা দিয়ে হাঁটলেও অনেক জ্ঞান লাভ করা যায়। এটা কথার কথা। তবে এর মধ্য দিয়ে জ্ঞানচর্চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব কতখানি- সে বিষয়টিই প্রকাশ পায়। শুধু জ্ঞানচর্চা, পেশাগত দক্ষতা সৃষ্টিই নয়, মুক্তবুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রগতিশীল চেতনার বিকাশ ঘটাতেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস তুলনাহীন, যা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। সবচেয়ে বড় কথা এই বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা করেছিল শিক্ষার্থীদের মাঝে যে মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে, তা এখনো করে চলেছে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে। ফলে অন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান পরিলক্ষিত হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনই সাম্প্রদায়িক শক্তি ঘেঁষতে পারেনি।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঐতিহ্যবাহী এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয় সম্প্রতি বেশ সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে টাইমস হায়ার এডুকেশন নামের একটি সংস্থা বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না থাকা, এমনকি এশিয়ার সেরা ৪০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নাম না থাকার কারণে এই সমালোচনা। এই র‌্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষা, গবেষণা, গবেষণার ফলাফল সাইটেশন, আন্তর্জাতিক উপস্থিতি, গবেষণাকর্মের বাণিজ্যিকীকরণ ইত্যাদি বিবেচনা করা হয়েছে। এই র‌্যাংকিংয়ে শিক্ষা খাতের স্কোর করা হয় সুনামের জরিপ, ছাত্র-কর্মকর্তার অনুপাত, স্নাতক ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের সংখ্যা, বাজেট, অবকাঠামো ইত্যাদির ভিত্তিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই র‌্যাংকিংয়ে স্থান না পাওয়ার কারণ আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তারা পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি কিংবা আমরা পাঠাতে সক্ষম হইনি, র‌্যাংকিংটির নিজের সীমাবদ্ধতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও কিছু সীমাবদ্ধতা যা অস্বীকার করার জো নেই। এই র‌্যাংকিংয়ে স্থান পেতে হলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সক্রিয়ভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য পাঠাতে হবে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি তথ্য না পাঠায়, র‌্যাংকিংয়ে স্বভাবতই তাদের স্থান হবে না। এটা র‌্যাংকিংয়ের সীমাবদ্ধতা এবং আমাদেরও সীমাবদ্ধতা। যদিও এসব র‌্যাংকিং করা হয় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য সামনে রেখে, আর যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাণিজ্যিক কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত নয় তাই হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে উদাসীন ছিল। তবে আমার মনে হয়, বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থা ও বিশ্বায়নের কথা মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিযোগিতা করতে হয়। যদি র‌্যাংকিংয়ে পিছিয়ে থাকি তবে তা হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক ধরনের অবিচার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান নিয়ে সমালোচনা করা হচ্ছে। আমি এটা জোর গলায় বলতে পারি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অনেক উন্নত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে, এটাই হচ্ছে বড় প্রমাণ। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাক্রম আপডেট করা হয়েছে বেশির ভাগ বিভাগে, শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রমেও এসেছে পরিবর্তন। ডিজিটালাইজড ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমসহ আধুনিক শিখন পদ্ধতির প্রয়োগ হচ্ছে। তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে আমরা গবেষণা ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা এ দুটি বিষয় নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবনে পরস্পর পরিপূরক হলেও বাজেট-স্বল্পতার কারণে আমরা গবেষণায় পিছিয়ে আছি। জন হপকিংস ইউনিভার্সিটি যেখানে বছরে প্রায় ২৪ লাখ ডলার গবেষণায় বরাদ্দ করে সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাদ্দ ৫০ হাজার ডলারের আশপাশেই থাকে। আর যেটুকু অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে তাও যে ভালোভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না তা বলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ধরনের গবেষণা হচ্ছে তার আন্তর্জাতিক মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

► লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

 

 

সর্বশেষ খবর