বুধবার, ১০ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভোট গুরুর কৃপাপ্রার্থী মমতা

স্বপন দাশগুপ্ত

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে চলছে ভাঙাগড়া। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক নেতাই এখন যোগদান করছেন বিজেপিতে। অতিসম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর ও বিধায়ক দলবেঁধে বিজেপির পতাকাতলে শামিল হয়েছেন। এ তো গেল পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার চিত্র। গ্রামাঞ্চলের চিত্রও অভিন্ন। গ্রামাঞ্চলের কর্মীরা দলবেঁধে যোগ দিচ্ছেন বিজেপিতে। ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পর রাজনীতিতে এই হাওয়া বইছে। লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ৪২ আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ২২টি আসন। নির্বাচনে বিপর্যয়ের পরেই রাজনীতিতে এই পরিবর্তন। যদিও এই নির্বাচনের আগে তৃণমূল নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি একাধিকবার দম্ভোক্তি করেছেন, লোকসভায় পশ্চিম বাংলার ৪২টি আসনের মধ্যে তার দল পাবে ৪২টি আসনই। এমনকি একটি আঞ্চলিক দলের নেত্রী হয়েও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের মুখ্য ভূমিকা রাখতে চেয়েছেন। সরকারবিরোধী দলগুলো নিয়ে মোর্চা গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধী কংগ্রেস ও তার জোট বাদে অন্য বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তোড়জোড় করেও লোকসভায় ৪২টি আসনের অর্ধেক আসন পেয়েছেন। নির্বাচনের আগে তিনি ভাবতে পারেননি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বামপন্থি দলগুলো তাদের নিজেদের প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে বিজেপিকে ভোট দেবেন। কলকাতায় আমার স্ত্রী ও আত্মীয়ের চিকিৎসার লক্ষ্যে ২ সপ্তাহের জন্য গিয়েছিলাম। এ কদিন কলকাতার পত্রপত্রিকা বিশ্লেষণ করে ও বেশকিছু নেতা-নেত্রীর সঙ্গে আলাপ করে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, বামপন্থিরা সন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লোকসভা নির্বাচনে এ কাজটি করেছেন। এটি বামপন্থিদের কৌশল। তৃণমূলের রাজনৈতিক অবস্থা দুর্বল হওয়ায় চূড়ান্ত বিশ্লেষণে লাভবান হবেন বামপন্থিরা। গত লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম দুটি আসনে বিজয়ী এবং ৮-১০টি আসনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেয়েছিল। তৃণমূলের শাসনামলে তাদের দলীয় কার্যালয় দখলসহ নানা সন্ত্রাসের কারণে বামপন্থিরা খুব বেশি চাপের মধ্যে ছিল। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় নির্বাচনে তাদের এ কৌশল গ্রহণ করতে হয়েছে। নির্বাচনী ফলাফলে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হয়েছে বামপন্থিরা। এ বিশ্বাস থেকেই বামপন্থিরা নিজেদের নাক কেটে বিজেপির প্রার্থীকে বিজয়ী করেছে। আগামী বিধানসভাসহ যে কোনো নির্বাচনে হয়তো নতুন কৌশল গ্রহণ করবে বামপন্থিরা। হয়তো তারা রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গঠন করতে পারে। লোকসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পর ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে তৃণমূল কংগ্রেস ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করে মাঠে নামতে চাচ্ছে। ইতিমধ্যে মমতা ব্যানার্জি দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মুসলিম ভোটারদের আরও কাছে আনার চেষ্টা করছেন। এমনকি বিজেপিকে ঠেকানোর জন্য কৌশল নির্ধারণের লক্ষ্যে ‘ভোটগুরু’-খ্যাত প্রশান্ত কিশোরকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। প্রশান্ত কিশোর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের বিপর্যয়ের কারণ উদঘাটন করবেন। আগামী দিনে জনগণের কাছে পৌঁছানোর কৌশল নির্ধারণ করবেন। তার পরামর্শেই বক্তৃতার পয়েন্ট নির্ধারণ করা হবে। জানা গেছে প্রশান্ত কিশোর আগামী মাসে এসব কাজ শুরু করবেন।  আমাদের দেশে ভোটগুরু বলে খ্যাত কাউকে নিয়োগ করেনি কোনো দল। গত ১১টি সংসদ নির্বাচনের আগে এ ধরনের ভোটগুরুর আবির্ভাব ঘটেনি। ভারতীয় নির্বাচনে এই ভোটগুরুর নিয়োগের অভিজ্ঞতা অনেক আগে থেকেই। এক সময় জাতিসংঘের কর্মী প্রশান্ত কিশোরকে ২০১১ সালে গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম কাজে লাগানো হয়। বিজেপি ওই নির্বাচনে তাকে নিয়োগ দেয়। প্রশান্ত কিশোরের সংগঠন সিটিজেন্স ফর অ্যাকাউন্টেবল গভর্ন্যান্সের পরামর্শ অনুযায়ী নির্বাচনী কৌশল গ্রহণ করেন নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। প্রশান্ত কিশোরের কৌশলেই গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। ওই নির্বাচনের পর ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে আবার তাকে কাজে লাগান মোদি। ওই সময়ে প্রশান্তের নতুন সংগঠন ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটিকে (আইপিএল) মোদি নির্বাচনের জন্য নিয়োগ দেন। ওই নিবার্চনে নতুন স্লোগান তৈরি করেন প্রশান্ত। হর হর মোদি-ঘর গর মোদি এই স্লোগানে মোদিকে জনপ্রিয় করে তোলেন প্রশান্ত। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভোটগুরু হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন প্রশান্ত। এর পর নানা কারণে মোদি সরকারের সঙ্গে তার বিরোধ বাধে। ২০১৫ সালে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে প্রশান্ত কিশোরকে নিয়োগ দেন নিতীশ-লালু জোট। প্রশান্তের সংগঠনের পরামর্শে ক্ষমতাসীন হয় এই জোট। ২০১৫ সালে নির্বাচনে এই জোটের জন্য কৌশল তৈরি করে দেন প্রশান্ত কিশোর। প্রশান্তের ধারণা, প্রতিটি এলাকাকে প্রাধান্য দিয়ে বক্তৃতা তৈরি করে দিলে ওই এলাকার মানুষ মনে করবে মুখ্যমন্ত্রী তাদের কথাও ভাবেন। নির্বাচনে বিজয়ের পর জোট নেতাদেরও ধারণা, এই কৌশল নির্বাচনে বিজয়ের জন্য তাদের সাহায্য করেছে। নির্বাচনে বিজয়ের পর নিতীশ-লালু জোট প্রশান্ত কিশোরকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। পরবর্তীতে সিনিয়র মন্ত্রীদের সঙ্গে তার বিরোধ দেখা দিলে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে আলাদা হয়ে যান। ২০১৭ সালে পাঞ্জাবে কংগ্রেস নেতা অমরেন্দ্র সিং প্রশান্তকে নিয়োগ দেন। প্রশান্তের কৌশলেই ১০ বছর পর পাঞ্জাবে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। এরপর অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুতে কংগ্রেসকে সাফল্য এনে দেন প্রশান্ত। এত সব সাফল্যের কথা বিবেচনা করেই আগামী বিধানসভা নির্বাচনে প্রশান্তকে নিয়োগ প্রদান করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন এখনো অনেকটা বাকি। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএমসহ সব দলই তাদের কৌশল গ্রহণ করবে। বিধানসভা নির্বাচনের আগে এসব দল কী ধরনের কৌশল করবে তাও দেখার বিষয়। তবে এটা বলা যায়, এই দলগুলো চাইবে না আগামী বিধানসভা নির্বাচনে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস জয়ী হোক। সম্ভবত বিজেপিকে বাদ দিয়ে কংগ্রেস ও বামপন্থি দলগুলো একটি নির্বাচনী মোর্চা গঠন করবে। তৃণমূল, বিজেপি ও নতুন জোটের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রশান্ত কি পারবে আগামীতে তৃণমূলকে ক্ষমতায় আনতে?

 

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর