বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

আবেগ তৈরির কারখানা যেন বন্ধ না হয়

কাজী হায়াৎ

আবেগ তৈরির কারখানা যেন বন্ধ না হয়

বরগুনার নয়ন ও তার সঙ্গীদের নৃশংসতা স্তব্ধ করে দিয়েছে বিশ^বিবেককে। নাড়া দিয়েছে দেশের সকল শ্রেণির মানুষের মননকে। দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের অনেকেই মন্তব্যসহ কলামও লিখেছেন। অনেকে এ ঘটনার জন্য মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক অবক্ষয় ও দেশের রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে দায়ী করেছেন। ৩০ জুন বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম সাহেব উপসম্পাদকীয়তে গবেষণাধর্মী একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। শিরোনাম ছিল ‘সুচিত্রা বললেন বিশ্বাস করুন আমি অভিনয় করিনি’। আমি ওই লেখাটির সূত্র ধরে বলতে চাই, নঈম ভাই যথার্থই বলেছেন। যে আবেগের কথা আপনার লেখায় প্রাধান্য পেয়েছে সেই আবেগ তৈরির কারখানা এখন সারা দেশ থেকে প্রায় বিলুপ্তির পথে। সত্যি যদি আবেগ তৈরির কারখানাগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে শুধু বরগুনার ঘটনা নয়, প্রতিনিয়ত এ দেশে এমনই আরও অনেক ঘটনা ঘটবে। আমার মনে আছে, একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ একটি ঘরোয়া সভায় বলেছিলেন, ‘কাজী হায়াত সাহেব যুবসমাজকে আবেগ তৈরির কারখানায় যেতে উদ্বুদ্ধ করুন। আপনারা ব্যর্থ হলে দেশ ও সমাজ দারুণ সংকটে পড়বে।’ ইলিশিয়াম ভবনের কিশোর হত্যাকান্ড সম্পর্কে বলতে গিয়েই তিনি এ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ইলিশিয়াম হত্যাকান্ড কিন্তু সমাজকে দারুণভাবে সতর্ক করে দিচ্ছে। যে বয়সে কিশোররা আবেগে ভরপুর থাকে সেই বয়সের কিশোররা আবেগ হারিয়ে ফেলে আরেক কিশোরকে হত্যা করছে। বিষয়টি দারুণ ভয়াবহ।’ তিনি বলেছিলেন, ‘হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হওয়ার সময় যাকে হত্যা করা হয়েছিল সে নিশ্চয়ই চুপ করে ছিল না। সে হয়তো হত্যাকারীদের বলেছিল আমাকে মেরো না। আমার জীবনটা ভিক্ষা দাও। তার কোনো কাকুতি-মিনতি হত্যাকারীদের আবেগকে একটুও নাড়া দিতে পারেনি। তাই দ্রুত ওদের আবেগ তৈরির কারখানায় ঢোকান। আবেগকে জাগ্রত করে তাকে শানিত করুন।’ সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। অবাক হয়ে ওই স্বনামখ্যাত বুদ্ধিজীবীর দিকে তাকিয়েছিলাম। তিনি আমাকে এ অবস্থায় দেখে বলেছিলেন, ‘বুঝতে পারেননি? নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবছেন আবেগ তৈরি এবং শানিত করার কারখানা কোথায়?’ তিনি বলেছিলেন, ‘সিনেমা হল ও লাইব্রেরি হলো মানুষের আবেগ তৈরির কারখানা।’ তিনি বলেছিলেন, ‘দেবদাস পড়ে কাঁদেননি? একজন বাঙালি হয়ে যদি দেবদাস পড়ে না কাঁদেন তাহলে মনোবিজ্ঞানীর কাছে যাবেন। মনে করবেন নিশ্চয়ই আপনার মননের কোনো বিপর্যয় ঘটেছে। আপনারা সিনেমা তৈরি করে মানুষকে অন্ধকার সিনেমা হলের মধ্যে নিয়ে উল্লসিত করেন, অবাক করেন, হাসান ও কাঁদান। এসবই অনেক মহৎ কাজ। আপনারা মানুষের আবেগকে জাগ্রত করেন এবং শানিত করেন।’

হ্যাঁ নঈম ভাই, আপনি সুচিত্রা সেনের ‘বিশ্বাস করুন আমি অভিনয় করিনি’ সংলাপ শুনে আবেগপ্রবণ হয়েছিলেন। আমি ক্লাস এইটে পড়ার সময় রাজবাড়ীর একটি সিনেমা হলে আমার মামার সঙ্গে ‘দীপ জ্বেলে যাই’ সিনেমাটি দেখেছিলাম। ওই দৃশ্য চলাকালে আমিও কেঁদেছিলাম। আমার মামাকেও কাঁদতে দেখেছিলাম। আজ বুঝি, মামা-ভাগ্নে দুজনই সেদিন আবেগ তৈরির কারখানায় ঢুকেছিলাম, না হলে ছায়ার বাণী শুনে কি কেউ কাঁদে?

বিগত ৪০ বছর যাবৎ আমি এই ছায়া আর তার বাণী নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত। আমার অভিজ্ঞতা থেকে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। পর্দায় সিনেমা চলছে। সিনেমাটির কাহিনি এমন : গ্রামের একজন বৃদ্ধ তার মেয়ের চিকিৎসার জন্য তার পালের একমাত্র দুধেল গাভীটি বিক্রি করে কোমরে টাকা বেঁধে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। পথিমধ্যে একজন ছিনতাইকারী অস্ত্রের মুখে তার সমস্ত টাকা নিয়ে যায়। বৃদ্ধ চিৎকার দিলেন, আমার সর্বস্ব নিয়ে গেল। কে আছে আমাকে বাঁচান। একটু দূরে অবস্থান ছিল ছবির নায়কের। বৃদ্ধের চিৎকারে সাড়া দিয়ে ছিনতাইকারীকে ধরার জন্য নায়ক দৌড় দিল। সিনেমা হলের দর্শক নায়ককে সমর্থন করে হাত তালি দিতে থাকল। আর বলতে থাকল ধর ...কে। নায়ক ছিনতাইকারীকে ধরতে পারল কি পারল না। সে পর্যন্ত না গিয়ে আমি সবার কাছে একটি প্রশ্নের উত্তর চাই। প্রশ্নটি হলো, ঠিক ওই সময়ে ওই সিনেমার ওই দৃশ্যটি দেখছে আরেকজন ছিনতাইকারী। সেও ঠিক এমনই ভাবে ছিনতাই করা টাকা দিয়ে সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে ঢুকেছে। ওই মুহূর্তে সে কী করবে? সে কি নায়কের পক্ষ সমর্থন করে হাতে তালি দেবে? অনেকেই উত্তর দিতে কিছুক্ষণ ভাববেন। আমি ভাববার সময় না দিয়ে বলতে চাই, ছিনতাইকারী দর্শকও অবশ্যই সবার সঙ্গে তালি দেবে এবং বলবে ধর ...কে। এমনটি কেন হবে? এ কথার উত্তর-  ছিনতাইকারী যেমন স্বভাবের মানুষই হোক, উল্লিখিত আবেগ তৈরির কারখানায় ঢুকেছে সে। নায়কের পক্ষ অবশ্যই সে সমর্থন করবে। সিনেমা এবং সিনেমা হলের ম্যাজিক হলো একজন দর্শককে অন্ধকার সিনেমা হলে ঢুকিয়ে তার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের কথা ভুলিয়ে দিয়ে সিনেমা দেখার সময়টুকুতে তাকে একক একজন ভালো মানুষে পরিণত করা। তার প্রমাণ প্রায় প্রতিটি সিনেমাতেই থাকে ভালো আর মন্দের দ্বন্দ্ব। সমস্ত দর্শকই ভালোর পক্ষ সমর্থন করে, মন্দকে ঘৃণা করে। একটি সিনেমায় অপরাধীর যদি শাস্তি নিশ্চিত করা না হয়, তাহলে দর্শক সন্তুষ্ট হয় না। দর্শক সিনেমা হলেও যায় না। ফলে সিনেমাও ব্যবসাসফল হয় না। সিনেমা শুধু মানুষকে আবেগপ্রবণ করে না, সিনেমা মানুষের মনন গঠনের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। সিনেমা মানুষকে চরিত্রবান হতে সহায়তা করে।

আজ থেকে কয়েক বছর আগেও সহস্রাধিক সিনেমা হল ছিল আমাদের দেশে। বর্তমানে তার সংখ্যা এসেছে মাত্র ২০০-তে। প্রায় প্রতি মাসে এর থেকেও কমে যাচ্ছে। অনেক দেশ আছে যেখানে কখনই সিনেমা শিল্প ছিল না, সিনেমা হলও ছিল না। সেসব দেশের সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, অন্যান্য অনেক দেশের চাইতে সেসব দেশে নৃশংসতা অনেক বেশি। যারা দেশ ও সমাজ নিয়ে ভাবেন, তাদের প্রতি অনুরোধ- বিষয়টি নিয়ে ভাববেন এবং আমাদের আবেগ তৈরির কারখানা আমাদের সিনেমা হল ও সিনেমা শিল্প যেন একেবারে বন্ধ হয়ে না যায়। অনেকে বলতে পারেন, দর্শক তো সিনেমা হল বিমুখ হয়ে গেছে, দর্শক আমাদের সিনেমা দেখতে চায় না। তাদের আমি বলতে চাই, এই গত ঈদে ‘পাসওয়ার্ড’ নামক একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। ওই সিনেমা দিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক সিনেমা হল খোলা হয়েছিল। আমি জানি ওয়ার্ল্ডকাপ ক্রিকেট খেলা থাকা সত্ত্বেও সিনেমা হলগুলোয় প্রচুর দর্শকসমাগম হয়েছিল। আসল কথা, দর্শক সিনেমা হল বিমুখ হয়নি; আমরা দর্শকদের সিনেমা হল বিমুখ করে দিয়েছি। এর পেছনে যে কারণ তা হলো, ইতিমধ্যে দেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। আর সেই উন্নয়নের ফলে মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতির সঙ্গে তাদের রুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে যে সিনেমা হল তৈরি হয়েছিল, তার সেই লোহার বাক্সের মতো ভাঙা আসনে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে অনেক সময় দুর্গন্ধের মধ্যে প্রচন্ড গরমে স্কুল-কলেজের ছাত্র তো দূরের কথা, আমাদের শ্রমিক ও রিকশাচালক ভাইয়েরাও সেখানে বসে সিনেমা দেখতে চান না। তা ছাড়া সিনেমার মাধ্যম এখন ডিজিটাল হয়েছে। প্রায় অধিকাংশ সিনেমা হলে জোড়াতালি দিয়ে খুবই কম মূল্যের প্রক্ষেপণ যন্ত্র দিয়ে এখনো সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছে। কিছু দর্শক সিনেপ্লেক্সগুলোতে সিনেমা দেখে আগের সেই বিশালাকৃতির সিনেমা হলে ঢুকতে চায় না। তদুপরি ওইসব সিনেমা হলে মহিলা দর্শকও নিরাপদ নন। হল কর্তৃপক্ষ অনেক সময় তাদের নিরাপত্তা দিতে পারে না। বরগুনায় দুটি সিনেমা হল ছিল। দীর্ঘদিন সেই আবেগ তৈরির কারখানা বন্ধ। আমার মনে হয়, দেশের সিনেমা শিল্প তথা মরহুম ওই স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবীর কথিত আবেগ তৈরির কারখানার জন্য অনতিবিলম্বে সরকারের একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। তা না হলে সমাজের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। দেশে ৫ লাখ হাজার কোটি টাকারও বেশি বাজেট পাস হয়েছে। সিনেমার জন্য কত কোটি টাকা বাজেট করা হয়েছে তা আমি জানি না। তবে আমি মনে করি, আনুমানিক মাত্র ১৫ হাজার কোটি টাকা দিয়ে কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান করা যায়, নতুন করে আধুনিক ডিজিটাল সিনেমা হল তৈরি করা যায়। যদি প্রতিটি হাইওয়ের পাশে ৩০-৪০ মাইল পরপর কোনো শহরের পাশে একেকটি বিনোদন কেন্দ্র তৈরি করা যায়; যেখানে থাকবে গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা, থাকবে বড় শপিং কমপ্লেক্স, ব্যাংক, এটিএম বুথ, ছোট্ট পরিসরে একটি শিশু পার্ক, খাবার ও আবাসিক হোটেল, সেই সঙ্গে ৩০০ সিটের অধিক নয় এমন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক তিনটি সিনেমা হল। এই বিনোদন কেন্দ্রগুলোর নাম একই হতে পারে। হতে পারে চারদিকে ঘেরাও করা দেয়াল দিয়ে আটকানো। থাকতে পারে এদের নিজস্ব একটি চ্যানেল। যেখানে শুধু সিনেমা নিয়ে আলোচনা হবে, কী সিনেমা কোন হলে চলছে এবং সিনেমার খবরই থাকবে সেখানে মুখ্য। সারা দেশে যদি এমন ৫০ থেকে ৬০টি বিনোদন কেন্দ্র তৈরি করা যায়, তাহলে বেঁচে যাবে আমাদের সিনেমা শিল্প। কর্মসংস্থান হবে আমাদের বিশাল এক জনগোষ্ঠীর। আমার মনে হয়, বর্তমানে আমাদের দেশের চলচ্চিত্রবান্ধব সরকারের পক্ষে এ কাজটি করা দুঃসাধ্য কোনো ব্যাপার নয়। সব শেষে সরকার তথা দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের কাছে আমার অনুরোধ, সিনেমা হলকে বাঁচান, সিনেমা শিল্পকে বাঁচান। মানবতাকে বাঁচান, বাঁচান আমার দেশের আবেগ তৈরির কারখানাকে।

 

[email protected]

সর্বশেষ খবর