শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

অনন্য হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী

মো. শফিকুল আলম

অনন্য হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী

ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডের ‘মাহজাবীন’ বাড়িটির সামনে দিয়ে যখন যাই বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। দৃষ্টিনন্দন ভবনটি সেই আগের মতোই সেখানে দাঁড়িয়ে, শুধু নেই অত্যন্ত বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪১তম অধিবেশনের সভাপতি ও সর্বশেষ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পিকার পরম শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। ১০ জুলাই, ২০০১ সালে তিনি এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। মৃত্যুর মাত্র দুই দিন আগে সন্ধ্যায় আমি তাকে দেখতে ধানমন্ডির বাসায় যাই। তিনি তখন ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বেড রেস্টে ছিলেন। আমি এসেছি জেনেই তিনি আমাকে ভিতরের রুমে ডেকে পাঠান। সেদিন আমি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারিনি, এটাই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। এই অবিনশ্বর পৃথিবী থেকে কালের অমোঘ বিধানে আমাদের সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন যারা মরে গিয়েও তাদের কর্মের মধ্যে বেঁচে থাকেন। আমার দৃষ্টিতে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তাদেরই একজন। স্পিকার স্যার মরে যাওয়ার পরও তার প্রিয় সহধর্মিণী মাহজাবীন চৌধুরী তাদের একমাত্র পুত্র নোমান রশীদ চৌধুরী ও একমাত্র কন্যা নাসরিন করিম চৌধুরীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। দুঃখের বিষয়, তারা কেউ আর আজ বেঁচে নেই। এমন অন্তহীন অপার শূন্যতার মাঝেও স্পিকার স্যারের অতিপ্রিয় তৎকালীন দুজন পিএস আজকের স্বনামধন্য প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব নজিবুর রহমান ও সাবেক সচিব সি কিউ এম মুশতাক সাহেবের সঙ্গে যখন কোথাও দেখা হয়, তখন আবেগপ্রবণ হয়ে যাই, তাদের মাঝে স্যারের হারানো স্মৃতি খুঁজে পাই। তারা দুজনও আমাকে ভীষণ স্নেহ করেন। আমার জীবনের সাধনা ‘মেঘনা উপজেলা’ প্রতিষ্ঠায় এ দুজনের অবদানও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত শক্তি জাতির জনককে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করার সময়ে প্রবাসে থাকায় তার দুই কন্যা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। হতে পারে বাবার সারা জীবনের স্বপ্ন দুঃখী মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানোর পথ সুগম করার জন্য পরম করুণাময় তাদের ঘাতকের নির্মম বুলেট থেকে রক্ষা করেছিলেন। সেই দুঃসময়ে জার্মানিতে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকালে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জাতির জনকের দুই কন্যাকে আশ্রয় দিয়ে শুধু মানবিক দায়িত্বই পালন করেননি, তিনি সেদিন বাঙালি জাতির মুখও রক্ষা করেছিলেন। আমার বিশ্বাস, স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালি তাকে এই বিশেষ কারণেও চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। কিন্তু ঘটনাক্রমে ১৯৯১ সালের শেষ দিকে এই মহান মানুষটির সঙ্গে আমার শুধু পরিচয়ই নয়, আমৃত্যু আত্মার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

কুমিল্লা জেলার হোমনা-দাউদকান্দির যে নিভৃত এলাকায় আমার জন্ম, রাজধানী ঢাকার অতিনিকটবর্তী হলেও এ ভূখ-টি ছিল চারদিক থেকে নদীদ্বারা বিচ্ছিন্ন একটি দুর্গম চরাঞ্চল। জনমদুঃখী মানুষগুলোর করুণ চিত্র সেই শৈশব-কৈশোরে চোখের সামনে দেখেছি। প্রায় সারা বছরই হাঁটুপানি কিংবা কোমরপানি ভেঙে মানুষকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাফেরা করতে হতো। প্রসব বেদনায় কাতর কোনো মা কিংবা অশীতিপর বৃদ্ধবৃদ্ধাকে খাটিয়ায় চিকিৎসার জন্য কোথাও নিতে পথিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন- এমন অসংখ্য বেদনার স্মৃতি এখনো মনকে নাড়া দেয়। এলাকায় ছিল না রাস্তাঘাট, যোগাযোগব্যবস্থা; ছিল না শিক্ষাদীক্ষার তেমন কোনো সুযোগ। এরূপ বাস্তবতায় মুক্তির পথ হিসেবে একটি প্রশাসনিক থানা গঠনের দাবি এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে। কত মন্ত্রী-এমপি নেতা যান আসেন, কিন্তু এদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ছাত্রজীবন থেকেই অনেকটা অজান্তেই এলাকাবাসীর এই দুঃখ দূর করার স্বপ্ন আমার বুকে বাসা বাঁধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের তাগিদ আমার মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে। আমি সুযোগ খুঁজতে থাকি! কিন্তু মনে মনে আমি প্রতিজ্ঞা করি আমার প্রিয় এলাকাবাসীর আজন্মলালিত স্বপ্ন একটি প্রশাসনিক থানা গঠনের মধ্য দিয়ে এই দুঃখকে একদিন দূর করবই। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির জনকের আদর্শকে রাজনীতির আদর্শ হিসেবে আত্মস্থ করেছি। তাই চাকরি -বাকরি করব না রাজনীতিকেই দেশের মানুষের সেবা করার ব্রত হিসেবে বেছে নিই, আজও সেই পথেই আছি। তাই ছাত্রজীবন শেষ করে তৃণমূলের কর্মী হয়ে গ্রামে ফিরে যাই। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন কুমিল্লা-১ (হোমনা-দাউদকান্দি) আসন থেকে আওয়ামী লীগের সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী হিসেবে (প্রথম) দলের মনোনয়ন পাই, যদিও তিন সপ্তাহ পর দলের নির্দেশে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াই। কিন্তু হাল ছাড়িনি। অবশেষে দীর্ঘ ২৩ বছর পর হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬-এর সংসদ নির্বাচনে জনতার রায় নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আমার নেত্রী প্রধানমন্ত্রী ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হন। শুরু হয় আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের। একদল তরুণ ও রতন শিকদারের মতো কিছু বিশ্বস্ত সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন একটি প্রশাসনিক থানা গঠনের বার্তা নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াই। এরই ধারাবাহিকতায় আমাকে সভাপতি ও রতন শিকদারকে সদস্যসচিব করে গঠিত হয় ‘মেঘনা উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটি’। সেই কমিটির আমন্ত্রণে স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ১৯৯৭-এর ১৭ মে রামপুর রাজারস্থ চরাঞ্চলে এসে আমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে ‘মেঘনা’ নামে একটি উপজেলা গঠনের আশ্বাস দেন। পরে গঠিত হয় মেঘনা উপজেলা।

►লেখক : সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান

মেঘনা উপজেলা, কুমিল্লা।

সর্বশেষ খবর