সোমবার, ১৫ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

এক দলীয় শাসনের পথে ভারত!

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

এক দলীয় শাসনের পথে ভারত!

যা আশঙ্কা করা হয়েছিল তাই কার্যত ভারতবর্ষের রাজনীতিতে প্রকাশ্যে এসে গেছে। ভারতবর্ষের গণতন্ত্র শুধু বিপন্নই নয়, একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করার জন্য বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলোর নেতৃত্বাধীন সরকার ভাঙার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিতশাহের প্রশাসনিক ক্ষমতা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হয়তো এই লেখা বের হওয়ার আগেই একই দিনে দক্ষিণের কর্ণাটকের কংগ্রেস ও জনতা দল (সেকুলার) দলের সরকারকে ভেঙে দেওয়া হবে। ইউপি-এর চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধী সংসদে দাঁড়িয়ে মোদি ও অমিতশাহকে আক্রমণ করে বলেছেন, যেভাবে আপনারা অ-বিজেপি সরকারকে ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছেন এবং সে কাজ শুরুও করেছেন সেটা সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির জন্য বিশ্বের দরবারে ভারতের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে। সোনিয়া গান্ধীর এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন ইউপি-এর অংশীদার সাতটি সর্বভারতীয় দল। বিপদ বুঝে বিজেপির বন্ধু পশ্চিমবঙ্গে বঙ্গেশ্বরীর দল তৃণমূল কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছে।

সব মিলিয়ে ভারতের রাজনৈতিক তথা গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি এখন সংকটের মুখে। শুধু চারদিকে একটি আওয়াজ- ‘জয় শ্রীরাম, তারা এই জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিচ্ছেন শুধু হিন্দুত্ববাদ কায়েম করার জন্য। তারা এ ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে কিছুটা সফল। ভারতের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি সংখ্যালঘু। এই সংখ্যালঘুদের মধ্যে ৩০ শতাংশ মুসলমান, আর ৫-৬ শতাংশ খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ প্রভৃতি। আর বিজেপি যে হিন্দুত্ববাদ নিয়ে বড়াই করছে গুজরাট রাজ্যের অধিকাংশ নাগরিকই বর্ণ হিন্দু নয়। জাতপাত নিয়ে সদ্য লোকসভায় ২০১৯-২০ সালের যে বাজেট পেশ করা হয়েছে তাতে দেশ গঠনে কৃষি সমস্যা সমাধান, বেকার সমস্যা সমাধান, জলসমস্যার সমাধান সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি। দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ১৯৪৭ সালের পরে তারা এই ধরনের দিশাহীন বাজেট ভারতবর্ষের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দেখেননি। আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো- ঘাটতি বাজেট পূরণ করার জন্য বিদেশ থেকে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণের কথাও বিজেপি সরকার ঘোষণা করেছে। এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে বিশ্বের অন্যতম অর্থনীতিবিদ তথা ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং সরকারের কড়া সমালোচনা করে তিনি বলেছেন- এখন প্রতি ডলারের দাম ৭০ টাকা আর যখন ঋণ শোধ করতে হবে তখন ডলারের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। নোবেল বিজয়ী অপর অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন বলেছেন, ভারতের এই বাজেট বিশ্বকে এক হাসির খোরাক জুগিয়ে দিল। ভারতের আরেক সাবেক অর্থমন্ত্রী পি-চিদাম্বরম্ বলেছেন, এই বাজেটকে সম্বল করে ভারতকে রামরাজ্যে পরিণত করা যাবে না। এই বাজেটে বিজলি, সড়ক ও পানি বলে কোনো কথা নেই। নেই রোটি, মাকাম ও কাপড়ার কথা। এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, এটা ‘গ্রিন বাজেট’। এই ‘গ্রিন বাজেট’ শব্দটির অর্থ কী তা অর্থনীতিবিদরা বুঝতে পারছেন না। মানুষ যাতে বাজেট নিয়ে কথা না বলে তাই অমিত শাহ রাজে রাজ্যে অ-বিজেপি সরকার ভেঙে দেওয়ার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করছেন। আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী কর্ণাটকের সেকুলার দলের সভাপতি এইচডি দেবগৌড়া অভিযোগ করেছেন- কর্ণাটকের জনতা দল সেকুলার এবং কংগ্রেসের বিধায়কদের কেনার জন্য প্রত্যেককে ২৫ থেকে ৫০ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছে, বেসরকারি সর্বভারতীয় ইংরেজি টিভি চ্যানেল এনডি টিভি তথ্য প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছে- বিজেপির কাছে বিক্রি হওয়া বিধায়কদের বোম্বের পাঁচতারা হোটেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে।

২০০২ সালে গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নায়ক বিজেপি সভাপতি তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিতশাহ আরএসএসের মাধ্যমে সারা দেশে রটিয়ে দিয়েছে- আমাদের প্রথম কাজ ছিল কংগ্রেস মুক্ত ভারত তা প্রায় সফল হয়েছে। দ্বিতীয় কর্মসূচি হলো- আঞ্চলিক দলগুলোকে ভেঙে দেওয়া ও বিজেপির একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করা হবে। বিজেপি তথা গেরুয়াবাহিনী সরকারের কার্যকলাপ দেখে জনগণের মধ্যে একটি ভয় ও সন্ত্রাসের জন্ম হয়েছে। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, এমনকি জহরলাল নেহেরুর আমল থেকে ভারতের যে ৪০-৪২টি স্বয়ং শাসিত লাভজনক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে কোটি কোটি লোক চাকরি করেন- যেমন ভারতের ইস্পাত কারখানাগুলো, এয়ার ইন্ডিয়া, টেলিফোন, চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ইঞ্জিন কারখানার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করে দেওয়া হবে আর তা কিনে নেবে গুজরাটের অনিল আম্বানি, গৌতম আদানির মতো ব্যবসায়ীরা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির অর্থমন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা বলেছেন, তিলে তিলে দেশের এই সম্পদ তৈরি করা হয়েছিল।

এই সম্পদ বিক্রি করা হলে দেশের অর্থনীতি আরও ভেঙে পড়বে বলে তার আশঙ্কা। যাই হোক এতে বিজেপি সরকার ও আরএসএস কর্ণপাত করতে রাজি নয়। আরএসএস ফিসফিস করে গ্রামগঞ্জের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজেকে নেহেরুর আমলের স্বরাষ্ট্র তথা উপ-প্রধানমন্ত্রী সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে তুলনা করে বলছেন, সর্দার প্যাটেল স্বাধীনতার পর ছোট ছোট দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন আর আমার কাজ হলো দেশ থেকে সব দলকে তুলে দিয়ে একদল, একজাতি, এক ভাষা চালু করে এক নতুন ভারত গঠন করব। এটা কি তিনি পারবেন? কারণ জনগণ সব দেখছে। কর্ণাটক ও গোয়ার পরে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান ও প-িচেরী এই চারটি রাজ্যের কংগ্রেস সরকার ভেঙে দেওয়ার ব্লু প্রিন্ট তিনি ইতিমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছেন। তারপর কী? তা ভবিষ্যৎই বলবে।

                              লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর