সোমবার, ১৫ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

উপকূলীয় জেলেদের বাঁচান

ফাতিমা পারভীন

উপকূলীয় জেলেদের বাঁচান

সারা দেশে চলছে জেলেদের জন্য ৬৫ দিনের অবরোধ। জেলেদের জীবন জীবিকা ইলিশ মৌসুমে মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল। ইলিশ আহরণের মূল সময়ে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ না করে ৬৫ দিনের অবরোধ দেওয়ায় তা জেলেদের জীবন জীবিকার জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। মাত্র দুই বছর আগেও বঙ্গোপসাগর ছিল জলদস্যুদের কবলে। ইলিশসহ অন্যান্য মাছ শিকার করতে গেলে জলদস্যুদের টাকা দিতে হতো। কখনো কখনো তাদের হাতে বন্দী হয়ে ভিটেমাটিসহ সর্বস্ব বিক্রি করে মুক্তিপণ দিতে হতো। মুক্তিপণ না দিতে পারায় জীবনও দিতে হয়েছে জেলেদের। সেখানে অসংখ্য নারীকে হতে হয়েছে বিধবা। বছরের পর বছর জেলেরা অসহায় ছিল জলদস্যুদের কাছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জলদস্যুমুক্ত বঙ্গোপসাগর আজ জেলেদের অভয়ারণ্য। আজ সেই সুখের ঘরে দুঃখের আগুন লাগিয়ে দিয়েছে টানা ৬৫ দিনের অবরোধ। এ কারণে জেলে পরিবারের সদস্যরা না খেয়ে মরতে বসেছে আজ। অভাব নেমেছে প্রতিটি জেলে পরিবারে। বেড়েছে নারী নির্যাতন, শালিস বিচার। হাট-বাজারে পড়েছে ব্যাপক প্রভাব, ঈদের বাজারও তেমন রমরমাভাবে জমে ওঠেনি। জেলে, মাছ বিক্রেতা ও বোট মালিকরা এখন প্রায় নিঃস্ব। উপকূলীয় জেলেদের দুঃখ-কষ্ট এমনিতেই সারা বছর লেগে থাকে, তারওপর আবার ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। জেলেদের দুঃখ-কষ্টের কথা লিখতে গেলে লেখার পরিসর বেড়ে যাবে। স্থানীয় আড়তদার, ট্রলার মালিক আর জেলেদের মধ্যে রয়েছে ‘দাদন’ এর ব্যাপক এক সিন্ডিকেট। সব সিন্ডিকেটের পীড়ন পোহাতে হয় জেলেদের আর ফলাফল ভোগ করতে হয় পরিবারের নারী ও শিশুদের। তারপরও দুই বেলা খেয়ে উপকূলীয় এ জেলেরা বেশ ভালোই ছিল। বঙ্গবন্ধু তনয়া জলদস্যুমুক্ত সাগর উপহার দেওয়ায় প্রাণভরে দোয়া করে বেলাশেষে প্রতিটি পরিবার ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবেই কাটছিল অভিযোগহীন জেলে পরিবারগুলোর। ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে। সারা বছরের মধ্যে মাত্র পাঁচ মাস মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে জেলেরা। পাঁচ মাসের ৬৫ দিন অবরোধ দিলে জেলেদের পথে নামতে হবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া ইলিশ মৌসুমের এই সময়েই সুস্বাদু ইলিশ পাওয়া যায়, যার ফলে ইলিশের মূল্য বৃদ্ধি হয়। তাতে সারা বছর জেলেদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। দরিদ্রতার গ্ল­ানি তাদের স্পর্শ করতে পারে না। ৬৫ দিনের অবরোধ ঘিরে সরকার কর্তৃক জেলেপ্রতি ৪০ কেজি চাল প্রদান করা হয়েছে যা দিয়ে পরিবারে চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। এ স্বল্প সাহায্য জেলে পরিবারের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল বলে বিবেচিত। এটি বাড়ানো উচিত। দীর্ঘমেয়াদি এ অবরোধের সময়ই জেলেরা বিকল্প কোনো কর্ম খুঁজে নিতে পারত। কিন্তু পারেনি। মাছধরা ছাড়া বিকল্প কোনো কাজ করতেও জানেন না তারা। ফলে নানামুখী ঝামেলায় জড়িত হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। যারা মাছের ব্যবসা করে তাদের ঘরে এখন অভাব-অনটন। এ জন্য মানববন্ধন করতে রাজপথে আসতে বাধ্য হয়েছিল হাজার হাজার জেলে।

সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে গত ২০ মে থেকে সাগরে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে। ৬৫ দিনের এ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৩ জুলাই। সরকারের এ ৬৫ দিনের অবরোধের সুযোগ নিচ্ছে ভারতের জেলেরা। আমাদের জেলেদের জন্য বেঁধে দেওয়া হলো ৬৫ দিনের অবরোধ অথচ বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশি জলসীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি। প্রতিবেশী ভারতের জেলেরা নির্বিঘ্নে আমাদের সমুদ্রসীমায় অনুপ্রবেশ করে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের ইলিশ শিকার করে তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশে দুটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র রয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলায়। এখান থেকে সরকার বছরে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করে। বঙ্গোপসাগরের পাড়ে বরগুনা জেলা হলো ইলিশের বাড়ি অথচ একটি কুচক্রী মহল এখান থেকে ইলিশের বাড়ির নাম লেখেন চাঁদপুর। এটির পরিবর্তন হওয়া জরুরি। বরগুনার মতো সুস্বাদু ইলিশ সারা বাংলায় আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। অবরোধ সফল হলে জেলেরা শিকার করবে রুপালি ইলিশ। তবু দুই বেলা না খেয়ে একবেলা পোলাও কোরমা খেতে ইচ্ছে করে না কারোরই। বঙ্গোপসাগরের একটি বিস্তৃত নির্দিষ্ট আয়তনকে অভয়ারণ্য করা উচিত যেখানে মা ইলিশ ডিম ছাড়তে পারে। আর বাকি সমুদ্র সীমারেখায় জেলেরা ইলিশ আহরণ করে তাদের জীবিকা অর্জন করতে পারে। ইলিশ সংগ্রহের নীতি নির্ধারকরা একবার ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন, তারপর আবার ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছেন। গবেষণা যতই হোক মনে হচ্ছে, মূলত নীতিনির্ধারকরা জানেনই না যে ইলিশ সংগ্রহের সঠিক সময়কাল কখন? এভাবে অযথা জেলেদের হয়রানি না করে জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিটি গঠন করা হোক। ওই কমিটিতে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হোক যারা এই পেশায় অভিজ্ঞ, অর্থাৎ ইলিশ বিশেষজ্ঞ জেলেদের। আমাদের জেলেদের মধ্যে এমন অভিজ্ঞ জেলে রয়েছেন যারা বঙ্গোপসাগরের পানি দেখলে বলে দিতে পারেন ওই পানিতে ইলিশ আছে কি নেই! ৬৫ দিনের অবরোধ সমাপ্তির পথে। উপকূলীয় জেলেদের একটাই দাবি ৬৫ দিনের অবরোধ ভবিষ্যতে প্রত্যাহার করে জেলেদের এহেন কষ্ট লাঘব করবে সরকার। আর যদি অবরোধ প্রত্যাহার করা না হয় তবে যেন সেই অবরোধ দেওয়া হয় ভারতের অবরোধের সময়কালের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, না হয় আমাদের বঙ্গোপসাগরের জলসীমান্তে অনুপ্রবেশ করে ভারতের জেলেরা অবাধে ইলিশ ধরে নিয়ে যাবে। ফলে লাখ লাখ জেলেকে পথে বসতে হবে।

লেখক : নারী ও শিশু অধিকারকর্মী

[email protected]

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর