মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাঙালির সুগন্ধি চর্চা

সাইফুর রহমান

বাঙালির সুগন্ধি চর্চা

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিতের পর ইংরেজ অনুরাগীদের অনেকেই বন্যার জলের মতো বিত্ত বৈভবের অধিকারী হয়ে ওঠেন। তাদের মধ্যে কলকাতার শোভাবাজারে পাশাপাশি দুজন প্রতিবেশী ছিলেন। একজন রাজা নবকৃষ্ণদেব। অন্যজন চুড়ামনি দত্ত। দেব আর দত্তদের মধ্যে তখন চলছে তুমুল লড়াই। কে বড় আর কে ছোট এই নিয়ে। রাজা নবকৃষ্ণদেবের আরেকটি কীর্তি হচ্ছে বাংলার স্বাধীনতা হারানোর ঠিক সে বছরই, অর্থাৎ ১৭৫৭ সালে চোখ ধাঁধানো এক আয়োজনের মধ্য দিয়ে তিনি কলকাতায় দুর্গাপূজা উৎসবের গোড়াপত্তন করেছিলেন।

নবকৃষ্ণ তার মায়ের উৎসাহে ইংরেজি, ফারসি ও আরবি ভাষা শেখেন সুচারুরূপে। এর ফলে প্রথমে ওয়ারেন হেস্টিংসের ফারসি-শিক্ষক নিযুক্ত হলেন নবকৃষ্ণ। সেখান থেকে নিজের যোগ্যতা ও বুদ্ধি-বলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুনশির পদ লাভ করলেন। লর্ড ক্লাইভ তখন কোম্পানির প্রভাবশালী ব্যক্তি। নবকৃষ্ণ ক্রমে তার কাছের লোক হয়ে উঠলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ইংরেজদের বিরোধে রাজা রাজবল্লভ, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, মীরজাফর, জগত শেঠদের সঙ্গে নবকৃষ্ণও কোম্পানির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর সিরাজের বিশাল টাকা ও সম্পত্তির একটি ভাগও পেয়েছিলেন তিনি।

তো হয়েছে কি সেই নবকৃষ্ণদেব কিংবা চুড়ামনি দত্তরা এতটাই ধনী হয়েছিলেন যে তারা কীভাবে যে তাদের অর্থ খরচ করবেন সে বিষয়ে প্রায়ই দিশা পেতেন না। সে সময়কালেরই একটি ঘটনা- একদিন এক ব্রাহ্মণের ছেলের কানে পুঁজ জমেছে। ছেলেকে নিয়ে ব্রাহ্মণ ছুটলেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার সাহেব সব শুনে বুঝে বললেন- এই রোগেরে মোক্ষম ওষুধ হচ্ছে পচা আতর।

গরিব বামুন আঁতকে উঠলেন- পচা আতর!! তা পচা আতর আমি কোথায় পাব ডাক্তার সাহেব। ডাক্তার বেচারাই আতরের সন্ধান বাতলে দিলেন দরিদ্র ব্রাহ্মণকে। ডাক্তারের পরামর্শ মতো বামুন গিয়ে হাজির রাজা নবকৃষ্ণদেবের দুয়ারে। কী চাই, জিজ্ঞেস করলেন নবকৃষ্ণের ছেলে গোপীমহনদেব। বামুন কাচুমাচু কণ্ঠে বললেন- আজ্ঞে আমার ছেলের কানে পুঁজ জমেছে একটু পচা আতর প্রয়োজন। গোপীমহন তো রেগে আগুন। আমরা কি পচা আতরের আড়ত খুলে বসেছি। পচা আতর চাই তো পাশেই চুড়ামনি দত্তের বাড়ি সেখানে চলে যাও। আর শোন, তোমার ওই ছোট পাথর বাটি দেখে চুড়ামনি দত্ত হয়তো রেগে যাবেন। একটি কলসি নিয়ে যেও। বামুন এবার চুড়ামনি দত্তের দুয়ারে গিয়ে হাঁক ছাড়লেন। চুড়ামনি বললেন- কি চাই। আজ্ঞে একটু আতর। চুড়ামনি দত্ত বললেন- পাত্র এনেছ। আজ্ঞে হ্যাঁ এই যে কলসি। কলসি দেখেই চুড়ামনি দত্ত সব বুঝতে পারলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আতরওয়ালাকে ডেকে বললেন- এই কলসিখানা ভরতে কত টাকার আতর লাগবে। আড়াই হাজার টাকার মতো- দাঁত কেলিয়ে বলল আতরওয়ালা। তাহলে এক্ষুণি এক কলসি আতর দিয়ে দিন এই বামুনকে। চুড়ামনি দত্ত বামুনকে উদ্দেশ্য করে বললেন- যাও এবার ওদের দেখিয়ে এসো। আর শোন গোপীমহন ছোট মানুষ ওকে দেখিয়ে লাভ নেই তুমি বরং নবকৃষ্ণকে দেখাবে। বামুনও কলসি ভর্তি আতর নিয়ে হাজির নবকৃষ্ণের বাড়িতে। গোপীমহন আর নবকৃষ্ণ দুজনেই তখন লজ্জায় একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা। সে কথা জানাতে বামুন আবার ফিরে এলেন চুড়ামনি দত্তের বাড়িতে। বললেনও সে কথা। চুড়ামনি দত্ত বামুনকে বললেন- এক কলসি আতর নিয়ে তুমি কী করবে। বরং তোমাকে আমি আড়াই হাজার টাকা দিচ্ছি আতরের কলসিটা এখানেই রেখে যাও। আর অল্প একটু আতর তোমার ওই বাটিতে দিয়ে দিচ্ছি। চুড়ামনির মোট খরচ হয়ে গেল পাঁচ হাজার টাকা। তাতে কি? আতরের লড়াইয়ে তো জিত হলো তার। নব-র মাথাটাতো নিচু করা গেল! এই বা কম কি!

সে সময় কলকাতার বাবুরা যে শুধু কলস কলস আতর ঘরে মজুদ রাখতেন তাই নয়। সমস্ত ঘরদোর, বাড়ির দেয়াল, মেঝে, বারান্দা সব ধোয়া মোছা হতো আতর দিয়ে। সেকালের কলকাতার বিখ্যাত ধনী নিমাইচরণ মল্লিকের পৌত্রের বিয়ের সময় চিৎপুর রোডের দু মাইল পথে গোলাপজল ছড়ানো হয়েছিল। বিয়ের শোভাযাত্রাতে পথের ধুলো আর দুর্গন্ধে যাতে বিঘ্ন না ঘটে। সেকালের ধনী বাঙালিবাবুর বনেদিয়ানা বজায় রাখতেও সুগন্ধের বড় একটা ভূমিকা ছিল। বার মহলে অতিথি আপ্যায়ন করা হতো গোলাপপাশ থেকে গোলাপজল ছিটিয়ে। এছাড়া আসরে সাজিয়ে রাখা হতো আতরদান। তুলায় মোড়া ছোট্ট ছোট্ট কাঠি। অতিথিরা আতরদান থেকে তুলায় মাখিয়ে তুলে নিতেন মনপসন্দ আতর, খস, চামেলি, বেলি।

উপরোক্ত ইতিহাস থেকে অনেকের মনে হতে পারে। সহস্র বছর ধরেই হয়তো ভারতবর্ষের এই ভূখন্ডে সুগন্ধির চর্চা ও ব্যবহার হয়ে আসছে। আদতে মোটেও সেরকম কিছু নয়। যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও তিন-চার হাজার বছর আগে যেখানে মিসর ও মেসোপটেমিয়ার রীতিমতো সুগন্ধের জয়জয়কার সেখানে ভারতবর্ষে সুগন্ধির ব্যবহার শুরু হয় আরবদের হাত ধরে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। সুগন্ধির ইংরেজি শব্দ হলো- চবৎভঁসব এই শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ চবৎভঁসধৎব থেকে বাংলা করলে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘ধোঁয়ার মাধ্যমে’। অর্থাৎ ধোঁয়ার মাধ্যমে যে সুগন্ধ ছড়ানো হয় তাকে পারফিউম বলে। বর্তমানে পারফিউম বলতে যা দেখি বা বুঝি তা হচ্ছে সুদৃশ্য বোতলের ভিতর তেলজাতীয় এক প্রকার পদার্থ যা স্প্রে করে শরীরে কিংবা পোশাকে ছিটানো হয়। কিন্তু পাঠকবৃন্দের একটা বিষয় মাথায় রাখা উচিত হবে যে, সুদৃশ্য বোতলে সুগন্ধির ব্যবহার হচ্ছে তিন হাজার বছর ধরে চলমান একটা সংস্কৃতির সবচেয়ে উৎকর্ষিত রূপ। তিন, চার হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়া ও মিসরে সুগন্ধি সাধারণত ব্যবহার হতো ধোঁয়ার মাধ্যমে এবং সেটা প্রধানত ব্যবহার হতো উপাসনালয়ে, রাজপরিবার, রাজ আমাত্য ও সমাজের উচ্চকোটির মানুষের মধ্যে। উপাসনালয়গুলোতে দেবতাদের সামনে প্রার্থনারত মানুষের ও দেবতাদের সঙ্গে সেতু তৈরি করত এই সুগন্ধিযুক্ত ধোঁয়া। সহস্র বছরের পুরোনো এই সংস্কৃতি কিন্তু এখনো চালু আছে। এখনো আমরা মিলাদ কিংবা ধর্মীয় মাহফিলে আগরবাতি জ্বালিয়ে চারপাশ সুগন্ধময় করে তুলি। তাছাড়া সে সময় দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে হতো দামি কোনো বস্তু যেমন- সোনা, রুপা কিংবা কোনো কোনো সংস্কৃতিতে মানুষের শির-েদ। বেশিরভাগ মানুষই একাধারে ধর্মপ্রাণ ও বুদ্ধিমান এজন্য সোনা, রুপা কিংবা মানুষের মুন্ডের পরিবর্তে ধর্মভিরু মানুষ বেছে নিয়েছিল সুগন্ধি বস্তু। এতে করে একই সঙ্গে অর্থের কৃচ্ছ্রতা সাধন ও ধর্মকৃত্য দুটোই সম্পন্ন হতো।

মিসরীয় ফারাও রাজারা যে কি পরিমাণ সুগন্ধি ব্যবহার করতেন তার একটি জাজ্বল্যমান প্রমাণ মেলে ফারাও রাজা তুতানখামুনের মমি আবিষ্কারের সময়। তুতানখামুন জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ১৩২৩ অব্দে। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ পুরাতাত্ত্বিক হাওয়ার্ড কার্টার পিরামিডের ভিতর যখন তুতানখামুনের সমাধিস্থল আবিষ্কার করেন তখন সেখানে স্বাভাবিকভাবেই সোনা, রুপা, হিরা, জহরতসহ পাওয়া যায় অনেক মূল্যবান বস্তু। তবে লোকজন সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যান্বিত হন এটা দেখে যে, তখনো তীব্র ও ঝাঁজালো সুগন্ধ বের হচ্ছিল মমিটির শরীর থেকে। চিন্তা করেই অবাক হতে হয় কী পরিমাণ অমূল্য ও ব্যতিক্রমী সুগন্ধি ঢালা হয়েছিল মমিটার শরীরে, যে তিন হাজার বছর পরও এর সৌরভ এতটুকু ক্ষুণœ হয়নি। ফারাও যুগে সুগন্ধি অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার হতো মোমের মাধ্যমে। সুগন্ধি ফুল, লতাপাতার নির্ঝাস মোমের মধ্যে মিশিয়ে তা শরীরে মাখা হতো। পিরামিডে আঁকা চিত্র দেখে ধারণা করা যায় যে ফারাও রাজা ও রানীরা এক ধরনের মোম মাথায় সেঁটে রাখতেন। প্রচ- রোদের তাপে মোম গলে সমস্ত শরীরের কোষে কোষে সেই সুগন্ধ ছড়িয়ে দিত। তবে ফারাও রাজা-রানীদের মধ্যে কুইন ক্লিওপেট্রা বোধকরি ছিলেন খোশবাইয়ের সবচেয়ে বড় সমঝদার। তিনি তার ব্যক্তিগত সৌগন্ধিকদের নির্দেশ দেন একেক সময় একেক রকম সুগন্ধি তৈরি না করে উৎকৃষ্ট ধরনের একটি নির্দিষ্ট সেন্ট পুনরায় তৈরি করতে।

সুগন্ধি প্রস্তুতকারকরা এই প্রথম নির্দিষ্ট ফরমুলার মাধ্যমে ক্লিওপেট্রার জন্য একটি সেন্ট তৈরি করে দেন যার নাম ছিল ‘কিফি’। সুগন্ধির ইতিহাসে কিফি-ই হচ্ছে প্রথম ব্র্যান্ড। ক্লিওপেট্রা যে শুধু পারফিউমের ভক্ত ছিলেন তা-ই নয়, পারফিউমের ব্যাবসায়ও নেমেছিলেন তিনি। খুলেছিলেন পারফিউমের কারখানা। তবে সেকালে তার খদ্দের কে ছিল সে বিষয়ে কিছু জানা যায় না। মিসরের পাশাপাশি গ্রিক রোমান ও পারস্যেও সুগন্ধ ব্যবহারের প্রচলন ছিল। রোমান সম্রাট নিরো (৩৭ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৬৮ খ্রিস্টাব্দ) রাজকীয় অনুষ্ঠানগুলোতে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন মুক্তহস্তে। সম্রাটের হিসাবপত্রের খাতা ঘেঁটে দেখা যায় শুধু একদিনে সুগন্ধির পেছনে তিনি ব্যয় করেছেন লক্ষাধিক টাকা। আমার বইয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালাটিতে হাজার দশেকের মতো বই থাকলেও সুগন্ধির ওপর কোনো বই নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে সুগন্ধির ভীষণ অনুরাগী। এ বিষয়ে লেখার জন্য গত তিন বছর ধরে নোট নিচ্ছিলাম। সুগন্ধির ওপর যখন যা তথ্য পেয়েছি টুকে রেখেছি নোটবইয়ে। এই তো মাস তিনেক আগে আলেকজান্ডারের ওপর একটি বই পড়েছিলাম, সেখানে পেলাম মজার একটি তথ্য। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে যখন পারস্যের রাজা তৃতীয় ডারিয়ূসকে হারিয়ে প্রথম রাজ দরবারে এসে পা রাখলেন তখন তিনি পারস্য সম্রাটের অনেক কিছু দেখেই অভিভূত হয়েছিলেন। বিশেষ করে রাজপ্রাসাদ। রাজপ্রাসাদে পরীর মতো অজস্র সুন্দরী নারী। ডারিয়ূসের সিংহাসনের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ভাস্কর্য। এছাড়া বিবিধ জেল্লা জৌলুস তো ছিলই। কিন্তু আলেকজান্ডার সবচেয়ে বেশি অভিভূত হন প্রাসাদের ভিতর ঐশ্বরিক এক সুগন্ধির সন্ধান পেয়ে। যোজনগন্ধা প্রাসাদটি সুগন্ধে যেন ম ম করছিল। তিনি বেশ কিছু সময় ধরে ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের পূর্তি করেন জোরে জোরে শ্বাস টেনে। তারপর এক সতীর্থ সমর নায়ককে উদ্দেশ্য করে বলেন- একেই বলে যথার্থ এক মহান রাজা ও তার সাম্রাজ্য। মনে হচ্ছে যেন সুগন্ধির কোনো এক মহান স্বর্গে তৈরি করা হয়েছে এই রাজপ্রাসাদ।

এবার ভারতবর্ষে সুগন্ধি চর্চা প্রসঙ্গে আশা যাক। যদিও হিন্দু আয়ুর্বেদিক গ্রন্থ সশ্রুত ও চারাক সহিংতায় আতরের কথা উল্লেখ আছে, কিন্তু ভারতের প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য কিংবা ধারাবাহিকভাবে যেসব পর্যটক এই ভারত ভূখন্ডে এসেছিলেন তাদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় জোরালোভাবে সুগন্ধির চর্চা এদেশে আরবদের আগমনের আগ পর্যন্ত শুরু হয়নি। বিখ্যাত পর্যটক আলবেরুনী ভারতীয়দের প্রসাধন চর্চা প্রসঙ্গে লিখেছেন- উৎসবের দিনে তারা তাদের দেহে সুগন্ধির বদলে গোবর লেপে। মেয়েদের সাজ-পোশাকের জিনিস পুরুষেরা পরে। তারা তাদের শরীরের কোনো চুল কাটে না। আসলে, গরমের প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে তারা নগ্নভাবে চলাফেরা করে। আর মাথার চুল না কাটার মূল কারণ হলো সর্দি-গর্মির কবল থেকে আত্মরক্ষা করা। একগুচ্ছের আকারে তারা তাদের গোঁফ রাখে। নখ না কেটে তারা তাদের কুঁড়েমিকে মহিমান্বিত করে। এদেশিরা একের পর এক, একা একা ভোজন করে। গোবরের প্রলেপ-দেওয়া স্থানে তারা এ কাজ সমাধা করে। (আলবেরুনী- প্রেমময় দাশগুপ্ত কর্তৃক অনূদিত, পৃষ্ঠ- ৫০ ও ৫১)। আলবেরুনী ছিলেন মধ্যযুগের বিশ্বখ্যাত আরবীয় শিক্ষাবিদ ও গবেষক, তার প্রণীত ভারততত্ত্ব গ্রন্থটি ইতিহাসের আলোকে বেশ প্রণিধানযোগ্য। অন্যদিকে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন- ‘সধবা নারীরা কপালে পরিতেন কাজলের টিপ এবং সীমন্তে সিঁদুরের রেখা; পায়ে পরিতেন লাক্ষারস অলক্তক, ঠোঁটে সিঁদুর; দেহ ও মুখমন্ডল প্রসাধনে ব্যবহার করিতেন চন্দনের গুঁড়া ও চন্দনপঙ্ক, মৃগনাভী, জাফ্রান প্রভৃতি। বাৎস্যায়ন বলিতেছেন, গৌড়ীয় পুরুষেরা হস্তশোভা ও চিত্তগ্রাহী লম্বা লম্বা নখ রাখিতেন এবং সেই নখে রং লাগাইতেন, বোধ হয় যুবতীদের মনোরঞ্জনের জন্য। নারীরা নখে রং লাগাইতেন কিনা, এ-বিষয় কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে না। (বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়, পৃষ্ঠা- ৪৬০)।

প্রেম, ভালোবাসা ও যুদ্ধের সঙ্গেও সুগন্ধির রয়েছে প্রগাঢ় সম্পর্ক। ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট যুদ্ধে যাওয়ার সময় দুটি জিনিস সবসময় সঙ্গে রাখতেন। প্রথমটি বই আর দ্বিতীয়টি হলো সুগন্ধি। সুগন্ধির প্রতি ছিল তার অসম্ভব আসক্তি। রাজ সুগন্ধ প্রস্তুতকারীদের  পকাছে প্রতি মাসে তার চাহিদা ছিল ৬০ বোতল সেন্ট। নেপোলিয়নের প্রিয় সুগন্ধি ছিল জেসমিন। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে- নেপোলিয়ন যে শুধু সুগন্ধি গায়েই মাখতেন তা নয়। তিনি মাঝে মধ্যে মদের সঙ্গে সুগন্ধি মিশিয়েও পান করতেন। সত্যিই অদ্ভুত। অন্যদিকে বাংলার নবাব আলিবর্দী খানও নাকি যুদ্ধে যেতেন পারস্যের বিভিন্ন সুগন্ধি সঙ্গে নিয়ে। এটা নাকি তার ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলত। সেই সঙ্গে যুদ্ধেও উৎসাহ জোগাত। আলিবর্দী খানের দৌহিত্র যুবরাজ সিরাজউদ্দৌলারও সুগন্ধির প্রতি ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা। নিজে গায়ে মাখতেন হরেকরকমের দামি সুগন্ধি। বিভিন্ন পালা পার্বণে হীরাঝিল প্রাসাদের কোনো কোনো উৎসব বা অনুষ্ঠানে পায়রা, কাকাতুয়া, টিয়া, ময়ূর বা অন্যান্য পাখি পারস্যের সুগন্ধির তরলে ভিজিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হতো হলঘরে। আর এতে সুন্দর ¯িœগ্ধ পারস্যের সৌরভে ছেয়ে যেত বাংলার যুবরাজ সিরাজউদ্দৌলার স্বপ্নরঙে রাঙানো হীরাঝিল প্রাসাদ।

তবে বাঙালির সুগন্ধি চর্চার কথা বলতে গিয়ে ঠাকুরবাড়ির লোকজনের সুগন্ধি ব্যবহারের কথা না বললেই নয়। সেকালে ঠাকুরবাড়ির সুগন্ধি চর্চার ইতিহাস অনেকটা কিংবদন্তিতুল্য বলা চলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জেঠাতো ভ্রাতুষ্পুুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন- আমাদের বাড়িতে পুজো না থাকলেও পুজোর আবহাওয়া এসে লাগত আমাদের বাড়িতে। পুজোর আগেই আসত চীনেম্যান-বার্নিশ করা নতুন জুতোর জন্যে পায়ের মাপ নিতে। সব বাড়ির ছেলেরা মিলেই পায়ের মাপ দিতুম। তারপর আসত দর্জি। তার নামটা ভুলে গেছি। যতদূর মনে পড়ে ‘আবদুল’। তার মাথায় গোল গম্বুজের মতো একটা মস্ত শাদা টুপি। গায়ে সামনে-বোতাম- দেওয়া দিব্যি ধবধবে শাদা চাপকান, মস্ত ভুঁড়ি। পিঠে কাপড়ের পুঁটলি। তার কাছে দিতে হত সক্কলের জামার মাপ। পোশাকের পালা চুকে গেলে আসত গ্রিবেল সাহেব। ইহুদি সাহেব সে। টকটকে রং, গোঁফ-দাঁড়িতে জমকালো চেহারা। তার চেহারাটা হুবহু শাইলকের ছবি। তার ওপর ইহুদি-জামার আস্তিনে রুপোর বোতাম সারি সারি লাগানো থাকত। তা দেখে চমক লাগত। সে আসত গোলাপ আর আতর বিক্রি করতে। কর্তারা, বাবুরা, সব্বাই ছিলেন তার খদ্দের। আমাদের ছোটদের জন্য ছোট ছোট শিশিতে সে আনত গোলাপি আতর। সেটা আমাদের বার্ষিকী। তার জন্যে পয়সা দিতে হতো না তাকে। তিনি আরও লিখেছেন- তার দিদিমা অর্থাৎ গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী যোগমায়া ছিলেন অতি রূপবতী মহিলা। পাশ দিয়ে চলে গেলে মনে হতো পদ্মগন্ধ ছড়াচ্ছে কেউ। সেই দিদিমার সাতনরী হারটি হাতে নিয়ে শুঁকে দেখতেন তার নাতি-নাতনিরা। আতর-চন্দনের সুগন্ধ লেগে থাকত সে গয়নায়। তখনও খোস্বো ভুরভুর করছে, সাতনরী হারের সঙ্গে যেন মিশে আছে। সেকালে আতর মাখার খুব রেওয়াজ ছিল; আর তেমনি সব আতর। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বৌদি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী লিখেছেন- জোড়াসাঁকোর ৬নং বাড়ির গৃহিণী তার শাশুড়ি সারদাদেবীর কথা। শ্বশুর দেবেন্দ্রনাথ বাড়ি থাকলে শাশুড়িকে একটু রাত করে ডেকে পাঠাতেন, ছেলেরা সব শুতে গেলে। আর মা একখানি ধোয়া সুতি শাড়ি পরতেন। তারপর একটু আতর মাখতেন। এই ছিল তার রাতের সাজ।

চার হাজার বছর আগে সুগন্ধি ব্যবহার করত উচ্চ শ্রেণির মানুষ। হিসাব কষে দেখা যায় এখনো সুগন্ধির ব্যবহার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এত বছর পরেও মানুষের অভ্যাস বা রুচির কিন্তু তেমন পরিবর্তন হয়নি। দেখা যায় অনেক সচ্ছল মানুষ আছেন যারা শরীরে ঘামের বোটকা গন্ধ নিয়ে ঘুরে বেড়ান কিন্তু সুগন্ধ ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক। এটা নিঃসন্দেহে একটি সচেতনতার বিষয়। এই শিক্ষা পরিবার থেকেও আসতে হয়। আমার মনে আছে ছোটবেলায় আমার মাকে দেখেছি নানারকম সুগন্ধি ব্যবহার করতে যদিও সেগুলো খুব একটা দামি ছিল না। একটার নাম সম্ভবত ছিল ‘চার্লি’ আরও কয়েকটার নাম যতদূর মনে পড়ে ‘পয়জন’, ‘ইয়ার্ডলি’ ইত্যাদি। বিয়েশাদি বা এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে আমাদের ভাই বোনদের শরীরে তিনি স্প্রে করে দিতেন সেসব সেন্ট। আম্মা সেসব অনুষ্ঠানকে বলতেন ‘ফাংশন’। এ ধরনের ইংরেজি শব্দ এখন আর কাউকে ব্যবহার করতে দেখা যায় না। যেমন নেপোলিয়ন মদের সঙ্গে সুগন্ধি মিশিয়ে খেতেন অন্যদিকে কখনো সখনো মন বিষণ্ন হলে আমার পছন্দের কিছু সুগন্ধি আছে যা হাতের মণিবন্ধের তালুর দিকটায় দুই-তিন দফা স্প্রে করে নাকের সামনে ধরলেই কীভাবে যেন আমার মন ভালো হয়ে যায়। সে বড়ই এক অদ্ভুত ব্যাপার!!!

 লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

ই-মৈইল :  [email protected]

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর