বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

শেকসপিয়রের জন্মস্থানে

আতাউর রহমান

শেকসপিয়রের জন্মস্থানে

গল্প আছে : বিলেতে জনৈক পর্যটক স্ব-চালিত মোটরগাড়িতে করে শেকসপিয়রের জন্মস্থান স্ট্র্যাটফোর্ড-অন-অ্যাভন সফরে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে সন্দেহ হওয়াতে তিনি হঠাৎ এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটাই কি শেকসপিয়রের বাড়িতে যাওয়ার সঠিক রাস্তা? লোকটি তার আপাদমস্তক নিরীক্ষা-পূর্বক একগাল হেসে জবাব দিলেন, হ্যাঁ। তবে তাড়াহুড়ার প্রয়োজন নেই, কারণ তিনি অলরেডি মৃত। বলা বাহুল্য, এটাই হচ্ছে ব্রিটিশ হিউমারের আদর্শ নমুনা। তবে হিউমার আপাতত থাক, আসল ব্যাপারে মনঃসংযোগ করা যাক।

আসল ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ফিবছর গড়ে প্রায় পাঁচ লাখ লোক মহাকবি ও মহানাট্যকার শেকসপিয়রের জন্মস্থান সফর করে থাকেন এবং এদের প্রায় অর্ধেকই পৃথিবীর অন্যূন শ’খানেক দেশ থেকে আগত প্রবাসী পর্যটক। আর বছরে একবার যখন শেকসপিয়রে জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে স্ট্র্যাটফোর্ডে উৎসবের আয়োজন করা হয়, তখন তো কথাই নেই- পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারি প্রতিনিধি ব্যতিরেকে অনেক খ্যতিমান ব্যক্তিত্বও সে সময় সেখানে পদধূলি দিয়ে থাকেন এবং এই সুযোগে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও আপামর জনসাধারণও অতিরিক্ত টু-পাইস রোজগার করতেও সমর্থ হন। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন যথার্থই একবার ব্রিটিশদের ‘এ নেশন অব শপ-কিপারস’ তথা বেনিয়ার জাত বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

সে যা হোক। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উইলিয়াম শেকসপিয়র ইংরেজি সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি এবং নাট্যকার হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। তার গুণমুগ্ধ স্বজাতি ভক্তি ও ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ তাকে ‘ইমোটেল বার্ড’ তথা ‘অমর কবি’, দ্য সুইট সুয়ান অব অ্যাভন তথা অ্যাভনের মিষ্টি সরাল ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করে থাকেন। সর্বোপরি শেকসপিয়রের প্রতি ইংরেজদের সার্বজনীন ভক্তি ও ভালোবাসা ইংরেজি ভাষার অভিধানে একটি নতুন শব্দের সংযোজন ঘটিয়েছে। শব্দটি হচ্ছে ‘বার্ডোলেট্রি’ এবং এটার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘শেকসপিয়রের অন্ধ প্রশ্বস্তি’। আর শেকসপিয়রের ওপর ইংরেজি ভাষায় অদ্যাবধি যত বই লিখা হয়েছে, পৃথিবীর আর কোনো কবি-সাহিত্যিকের বেলায় তা ঘটেনি। তদুপরি আমাদের এই উপমহাদেশসহ পৃথিবীর নানান দেশ-মহাদেশের মানুষ শেকসপিয়রের কবিতা আবৃতি করে তার নাটক মঞ্চস্থ করে ও উদ্ধৃত অংশ মুখস্থ করে তাকে ‘কাল্ট ফিগার’ হিসেবে পরিগণিত করে থাকেন। তবে তার প্রকৃত পরিচিতি সম্পর্কে বেশ কিছুটা রহস্য থাকায় নানান সময়ে নানান আজগুবি বক্তব্য শুনতে পাওয়া যায়। এই যেমন- গেল শতাব্দীর ষাটের দশকে জনৈক মিসরীয় মহাপ-িত দাবি করে বসেন, শেকসপিয়রের আসল নাম ছিল শেখ পির এবং তিনি ছিলেন ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী একজন আরব বণিক, যিনি বাণিজ্য উপলক্ষে বিলেতে গমন করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন, অতঃপর কবিতা আর নাটক লিখে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। পৃথিবীতে কত ধরনের পাগলই না আছেন! তা সত্যি বলতে কী, খোদ ব্রিটেন ও আমেরিকায় ইংরেজি ভাষাভাষি লোকেদের মধ্যেও শেকসপিয়র নামধারী ব্যক্তিটি প্রকৃতপক্ষে কে ছিলেন এবং তার নামে প্রচারিত কবিতা ও নাটকের স্রষ্টা সত্যিই তিনি, নাকি সমসাময়িক অন্য কেউ-এ নিয়ে অদ্যাবধি বাকবিত-ার অন্ত নেই। একদল আছেন যারা বলেন, নাটকগুলো তার সমসাময়িক নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লো (যিনি বিখ্যাত ট্র্যাজিক নাটক ড. ফাস্টাস লিখে খ্যাতি লাভ করেছিলেন) কর্তৃক রচিত; আবার আরেক দল আছেন যারা বলেন, ওগুলো সে সময়কার সবচাইতে বিদ্বান ব্যক্তি ও লেখক বলে পরিগণিত ফ্রান্সিস বেকন দ্বারা লিখিত। এ সম্পর্কে একটি মজার উপাখ্যানও আছে : বিখ্যাত আমেরিকান রসস্রষ্টা মার্ক টোয়েন একবার বিলেত সফরকালে একটি সাহিত্য সভায় উপরোক্ত বিষয়ে হৈ-চৈ শুরু হয়ে গেলে এক পর্যায়ে মার্ক টোয়েন বলে উঠলেন, আমি মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করব এবং অতঃপর স্বর্গে গিয়ে স্বয়ং শেকসপিয়রের কাছ থেকে জেনে নেব নাটকগুলো সত্যিই তিনি লিখেছেন কি না। ‘কিন্তু, উপস্থিত একজন ফোড়ন কাটলেন, শেকসপিয়র যদি স্বর্গে না গিয়ে নরকে গিয়ে থাকেন?

‘সে ক্ষেত্রে আপনি ওটা জেনে নিয়েন’ মার্ক টোয়েন বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে তৎক্ষণাৎ তাকে জবাব দিয়েছিলেন।

এক্ষনে আমি শেকসপিয়রের জন্মস্থান পরিদর্শন সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনায় আসি। বিলেতের বাংলাদেশ দূতাবাসে আশির দশকে পদায়নের সুবাদে আমার ভাগ্যে সে সৌভাগ্যটি ঘটেছিল। ততদিনে অবশ্য ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে শেকসপিয়র সম্পর্কে মোটামুটি যা জানার তা জেনে গিয়েছি : শেকসপিয়রের জীবনের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৫৬৪ থেকে ১৬১৬ সাল, অর্থাৎ মাত্র ৫২ বছর। এই স্বল্পায়ুর মধ্যেই তিনি ট্র্যাজেডি, কমেডি ও ঐতিহাসিক নাটক মিলিয়ে মোট ৩৮টি বিখ্যাত নাটক ও বহু সংখ্যক সনেট তথা চতুর্দশপদী কবিতা রচনা করে গেছেন। তার পিতা একজন সম্পদশালী সওদাগর ছিলেন, কিন্তু ১৫৭৭ সাল থেকে পিতার ব্যবসায়ে ভাটা পড়তে থাকলে তিনি স্থানীয় গ্রামার স্কুলের পড়ালেখা অসমাপ্ত রেখেই স্কুল পরিত্যাগ করে থাকবেন। অতঃপর একটি কাহিনী মতে, স্থানীয় জমিদারের বাগানবাড়ি থেকে একটি হরিণ চুরি করে জমিদারের রোষ থেকে বাঁচতে তিনি স্ট্র্যাটফোর্ড ত্যাগ করে লন্ডনে পাড়ি জমান। ইত্যবসরে অবশ্য তিনি পার্শ্ববর্তী গ্রামের তার চাইতে আট বছরের বড় অ্যান হ্যাথেওয়েকে বিয়ে করেন এবং তিন বছরের মধ্যেই দুটি কন্যা-সন্তানের পিতা বনে যান। আর লন্ডনে পৌঁছে তিনি সম্ভবত অভিনেতা কিংবা লেখক হওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করেন এবং যুগপৎ মঞ্চে অভিনয় করা ও নাটক লিখা আরম্ভ করেন। বিলেতের রানী তখন প্রথম এলিজাবেথ এবং তার শাসনামলকে সে দেশের শিল্প-সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা হয়। ফলে শেকসপিয়র লন্ডনে খুব সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনযাপন করতে থাকেন এবং কয়েক বছর পরই জন্মস্থানে ফিরে গিয়ে সেখানে এক আলিশান বাড়ি ক্রয়পূর্বক আমৃত্যু বাস করেন। সে সময়টাতেই তিনি তার শেষ পর্যায়ের নাটকগুলো লিখেছেন।

তো দেহাবসানের পর শেকসপিয়রের মরদেহ যথারীতি স্থানীয় গির্জা প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। শীতপ্রধান দেশে ডিসেম্বরের এক শীতার্ত অপরাহ্ণে শত শত টুরিস্টের ভিড়ে স্ট্র্যাটফোর্ডের হেনলি স্ট্রিটের শেকসপিয়রের পৈতৃক বাড়ি, মনোরম শেকসপিয়র সেন্টারের বিল্ডিং বিরাটকায় রয়েল শেকসপিয়র থিয়েটার (যেখানে সারা বছরই শেকসপিয়রের কোনো না কোনো নাটকের মঞ্চায়ন করা হয়ে থাকে) ও অ্যান হ্যাথেওয়ের নয়নাভিরাম কটেজ দেখতে দেখতে আমি তাই মনে মনে ভাবছিলাম- শেকসপিয়রের সমসাময়িক আরেকজন উল্লেখযোগ্য নাট্যকার ফ্রন্সিস বোমন্টকে (১৫৮৪-১৬১৬) তো লন্ডনের ওয়েস্ট মিনস্টার অ্যাবির জাতীয় সমাধিক্ষেত্রে ইংরেজ সাহিত্যিকদের জন্য নির্ধারিত কর্নারে চ্যমার, স্পেনসার প্রমুখের সমাধির পাশে সমাধিস্থ করা হলো; অথচ শেকসপিয়রকে করা হলো না, তার মরদেহ পড়ে রইল স্ট্র্যাটফোর্ডে। তাহলে কি তিনি জীবিতকালে অতটা জনপ্রিয় ছিলেন না?

আমার সহগামী টুরিস্টদের মধ্যে দৃশ্যত অধিকাংশ ছিলেন আমেরিকান। বাস্তবিকই আমেরিকানদের মধ্যে যারা সাহিত্যানুরাগী তারা শেকসপিয়রের জন্য এককথায় পাগলপ্রায় এবং তারা বিলেতে বেড়াতে এসে একবার স্ট্র্যাটফোর্ড-অন-অ্যাভনে যাবেনই। তো গল্প আছে : একবার এরূপ এক আমেরিকান মহিলা শেকসপিয়রের জন্মস্থান সফর করে এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন যে, ফেরার পথে স্ট্র্যাটফোর্ডের রেলস্টেশনের প্ল্যাটফরমে ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণ অবস্থায় বান্ধবীকে টেলিফোনে বলছিলেন, ভাবতেই অবাক লাগছে যে, অমর কবি যখনই ট্রেনে লন্ডন যেতেন তখনই তিনি এই প্ল্যাটফরম থেকেই ট্রেনে চাপতেন! হা-হা-হা।

আর স্ট্র্যাটফোর্ড-অন অ্যাভনে একটি চমক আমার জন্য বোধকরি অপেক্ষা করছিল। স্বদেশী ভাই আরব আলী সাহেব প্রকৃতপক্ষে আমার দূর সম্পর্কিত আত্মীয়। দেশে একবার দেখা হলে পর বিলেতে কী কাজ করেন, আমার এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি মুচকি হেসে বলেছিলেন, ভাত বেচি। স্ট্র্যাটফোর্ডে এসে প্রত্যক্ষ করা গেল, হেনলি স্ট্রিটে শেকসপিয়র সেন্টারের বিপরীতে তথাকথিত ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট খুলে তিনি গাভনার তথা রেস্টুরেন্টের মালিক হয়ে বসে আছেন। আমাকে পেয়ে তিনি বেজায় খুশি। তার অধিকাংশ কাস্টমারই স্থানীয় অভিনেতা-অভিনেত্রী। জিজ্ঞেস করলাম, কখনো কোনো মজার ব্যাপার ঘটেছে কি? প্রত্যুত্তরে তিনি জানালেন, একবার এক অভিনেতা-কাস্টমার শেকসপিয়র সেজে রেস্টুরেন্টে এলে পর তাদের অনেকক্ষণ লেগেছিল ভাবতে, ওটা কি অমর কবির অপচ্ছায়া নাকি অবিকল তার মতো দেখতে রক্তমাংসের কেউ।

শেষ করছি বিলেতে আমার অবস্থানকালে সংঘটিত শেকসপিয়র সম্পর্কিত আরেকটি মজার উপাখ্যান দিয়ে : বিবিসি টেলিভিশনে ‘আলট্রা কুইজ’ শীর্ষক সাধারণ জ্ঞানের রিয়েলিটি শো হচ্ছিল, যেটা পরিচালনা করছিলেন স্যার ডেভিড ফ্রস্ট (তখনো তিনি নাইটহুড পাননি)। তো এক পর্যায়ে তিনি একটি কুড়ি-বাইশ বছরের মেয়েকে প্রশ্ন করেছিলেন, শেকসপিয়রের স্ত্রীর নাম কী ছিল? মেয়েটি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে জবাব দিল, মিসেস শেকসপিয়র। ডেভিড ফ্রস্ট তাৎক্ষণিকভাবে হেসে উঠে বললেন, ওয়েল, দ্য অ্যানসার ইজ সো স্মার্ট দ্যাট আই শ্যাল একসেপ্ট ইট- উত্তরটি এতটাই রসবোধপূর্ণ যে, আমি ওটা গ্রহণ করব।

পরিশিষ্ট : দ্য বুক অব অ্যামেইজিং ফ্যাক্টস অনুসারে শেকসপিয়রের ইংরেজি শব্দভা-ার নাকি ছিল চব্বিশ হাজার, যেখানে সচরাচর একজন ইংরেজের শব্দভান্ডার হচ্ছে প্রায় তিন হাজার।

 

         লেখক : বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর