শনিবার, ২০ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঘরে-বাইরে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ

শাইখ সিরাজ

ঘরে-বাইরে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ

ঢাকার উত্তরার খানটেক এলাকাটি বিমানবন্দরের রানওয়ের খুব কাছে। ফলে একটু পরপরই বিমানের ওঠা-নামার সাঁইসাঁই শব্দ শোনা যায়। এ এলাকার দোতলার এক ছাদে ছাদ -কৃষি নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করছেন আমিনুল ইসলাম নামের একজন। তার কাজকারবার দেখার জন্যই সেখানে গিয়েছিলাম সপ্তাহ দুই আগে। বিমানের ঘন ঘন ওঠানামা দেখে আমার শৈশবের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। আমি বড় হয়েছি ঢাকার খিলগাঁওয়ে। তখন খিলগাঁওয়ের আমাদের মহল্লাটি ছিল ঘন গাছগাছালিতে ছাওয়া। এত ঘন ছিল যে, সূর্য পশ্চিমে হেলতে না হেলতেই অন্ধকার নেমে আসত। এই গাছগাছালির ওপর দিয়ে যখন অ্যারোপ্লেন উড়ে গিয়ে নামত তেজগাঁও বিমানবন্দরে; আমরা দৌড়ে গিয়ে গাছের ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম। সে সময় মনে মনে ভেবেছিলাম, বড় হয়ে অ্যারোপ্লেন চালাব। মহল্লায় একজন প্রতিবেশী ছিলেন এয়ারপোর্ট কাস্টমসের ইন্সপেক্টর। তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী, ছিল সফেদ দাড়ি। আমরা ডাকতাম ‘ইন্সপেক্টর কাকু’ বলে। একদিন পাড়ার কয়েকজন মিলে ইন্সপেক্টর কাকুকে ধরলাম, আমাদের অ্যারোপ্লেন দেখাতে হবে। কাকুও রাজি হলেন। শীতের এক পড়ন্ত বিকালে ইন্সপেক্টর কাকু আমাদের নিয়ে গেলেন অ্যারোপ্লেন দেখাতে। পিআইএ (Pakistan International Airlines)-এর একটি অ্যারোপ্লেন যাত্রী নামিয়ে সবে দাঁড়িয়েছে। বিকালের রোদের সোনালি আলো এসে বিমানের ওপর পড়েছে। চিকচিক করছে পাখা। সে দৃশ্য আজও মনে পড়ে। আমরা অ্যারোপ্লেনটায় চড়ারও অনুমতি পেলাম। ইন্সপেক্টর কাকু আমাদের নিয়ে প্লেনে চড়লেন। কী সুন্দর সাজানো গোছানে! টানটান করে রাখা প্লেনের চেয়ার। সে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ইন্সপেক্টর কাকু চোখে ইশারা করলেন, বসা যাবে। বসলাম। অ্যারোপ্লেন দেখা শেষ, ওড়া না হলেও প্লেনে চড়া তো হলো, সেই খুশি নিয়ে ফেরার পালা। প্লেন থেকে নেমে রানওয়ে ধরে ফিরছি। হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া। বলা নেই, কওয়া নেই, রোদের দিনে হঠাৎ ঝড়! আমার বড় আপা শিরি ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ছুটে এলেন ইন্সপেক্টর কাকু, ‘ভয় নেই, ভয় নেই, ঝড় ওঠেনি। প্লেনের পেছনের পাখার বাতাস।’ অ্যারোপ্লেনটি তখন ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। পেছনের পাখা ঘুরে প্রচ- বাতাস হলো। আর সেই বাতাসকে ঝড় ভেবে কী যে ভয় পেয়েছিলাম!

যাই হোক, বলছিলাম উত্তরার আমিনুল ইসলামের কথা। নতুন কৃষিপ্রযুক্তির প্রতি তার অন্যরকম এক ঝোঁক। বাসভবনের ছাদটিকে তিনি কৃষিপ্রযুক্তির পরীক্ষাগার বানিয়েছেন। ছোট্ট ছাদটিতেই হাইড্রোপনিক, অ্যাকুয়াপনিক্স থেকে শুরু করে নানান প্রযুক্তির সমাহার ঘটিয়েছেন। কৃষির প্রতি টান তার শৈশব থেকেই। তবে জৈবকৃষির তাগিদ থেকে ছাদকৃষিতে যুক্ত হন। তারপর ছাদেই চালিয়েছেন কৃষি নিয়ে গবেষণা।

এর মধ্যে ঘরের ভিতর মাছ চাষের বিষয়টি তাকে কৌতূহলী করে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করেন আরএএস (রিসার্কুলেটিং অ্যাকুয়াকালচার সিস্টেম)-এ মাছ চাষের নিরীক্ষা। সঙ্গে যুক্ত হন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ছেলে তাহসিন ইসলাম ও ছেলের বন্ধু নেটওয়ার্কিং ইঞ্জিনিয়ার জাহিদুর রহমান। ভবনের নিচতলায় ছয়টি ছোট্ট ট্যাংক তৈরি করে তাতে একেবারে নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরি করা যন্ত্রপাতি দিয়ে শুরু করেন আরএএসে মাছ চাষ। পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফল হয়। তবে সেটা একেবারে ক্ষুদ্র পর্যায়ে। ছোট ছোট ট্যাংকে অল্প কিছু পরিমাণ মাছ চাষ সম্ভব হয়েছে। কিন্তু যদি বাণিজ্যিকভাবে বৃহদাকারে যেতে চান তাহলে প্রয়োজন বড় বিনিয়োগ। কারণ, বড় বড় যন্ত্রপাতি, নানা রকম ফিল্টার সব মিলে কোটি টাকার ব্যাপার। এর মাঝেই অনলাইনে দেখেন বায়োফ্লক প্রযুক্তির একটি ভিডিও। দুই তরুণ বায়োফ্লক নিয়ে শুরু করেন পড়াশোনা। ভারত থেকে প্রশিক্ষণও নিয়ে আসেন। এরপর শুরু হয় বায়োফ্লক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এ প্রযুক্তিতে ফিল্টার মেশিনের কোনো খরচ নেই। আবার বায়োফ্লকে মাছের মলকে খাদ্যে পরিণত করার কারণে ২৫-৩০% খাবারও বেঁচে যায়। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বাসভবনের দোতলায় বড় চারটি ট্যাংক বসান তারা; যার একটিতে এখন বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ চলছে। বাকি তিনটিতেও শুরু করবেন শিগগিরই। পাঠক! বলে রাখি বায়োফ্লক প্রযুক্তি মাছ চাষের একটি টেকসই ও পরিবেশগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ পদ্ধতি; যা পানির গুণমান রক্ষা এবং ক্ষতিকারক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করে। মাছের জন্য মাইক্রোবায়াল প্রোটিন খাদ্য হিসেবে সরবরাহ করে। ইসরায়েলের অধ্যাপক ইয়োরাম ইভনিমিলেচকে বলা হয় বায়োফ্লক পদ্ধতির প্রবর্তক। তার রচিত Biofloc Technology – A Practical Guide Book বইটিতে বায়োফ্লক সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। বায়োফ্লক মূলত উপকারী ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নিধন ও মাছের মলকে মাছের খাদ্যোপযোগী প্রোটিনে রূপান্তরের একটি প্রক্রিয়া। গত বছর চীনে এ পদ্ধতির অসংখ্য খামার দেখে এসেছি। দূর থেকে দেখে মনে হয় বড় বড় পুকুর বিশালাকার পলিথিন দিয়ে ঢাকা। বায়োফ্লক পদ্ধতির খামারগুলোয় প্রাথমিকভাবে পানির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্যই ওই পলিথিনের ব্যবহার করা হয়। সেখানে অধিক ঘনত্বে চাষ হচ্ছে চিংড়ি, তেলাপিয়া, মাগুরসহ নানান জাতের মাছ। বায়োফ্লক পদ্ধতিটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়। সেখানে বাড়িতে বাড়িতে গড়ে উঠেছে মাছের ছোট্ট খামার। একেকটি বাড়ি যেন মাছ চাষের কুটিরশিল্প। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বায়োফ্লক রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছে। এর হাওয়া আমাদের দেশেও লেগেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে বিষয়টিতে আগ্রহী করে তুলেছে।

কথা বলি দুই তরুণ তাহসিন ইসলাম ও জাহিদুর রহমানের সঙ্গে। তাদের কাছে জানতে চাই, কম্পিউটার প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা শেষে তারা কেন যুক্ত হলেন কৃষির সঙ্গে? জাহিদুর জানালেন, ‘মাস্টার্স শেষে আমি যদি কোনো ফার্মে চাকরি করি আমার প্রারম্ভিক বেতন হবে বড়জোর ২০ হাজার টাকা। একটা চলনসই বেতন কাঠামোয় ঢুকতে ছয় থেকে সাত বছর লেগে যাবে। ভেবে দেখলাম, তার চেয়ে কৃষি উদ্যোক্তা হওয়া বেশি লাভজনক। এখানে সম্ভাবনাও বেশি।’ তাদের কথা শুনে বোঝা গেল দুই তরুণ বেশ হিসাব কষেই মাঠে নেমেছেন। বায়োফ্লক প্রযুক্তির বিষয়গুলোও রপ্ত করেছেন ভালোভাবেই। আমাকে হিসাব করে বুঝিয়ে দিলেন সব ঠিকঠাকমতো করতে পারলে কীভাবে এক বছরেই বিনিয়োগ তুলে ফেলা সম্ভব। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপারটি হলো, বায়োফ্লক পদ্ধতি স্থাপনের ব্যয় রাশ পদ্ধতির চেয়ে অনেক কম। সামগ্রিক ব্যয়ও কম। লাভের হিসাবটি বেশ ভালো। তার মানে অনেক বেশি অর্থ বিনিয়োগ না করেও পরীক্ষামূলকভাবে এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করা সম্ভব। শুধু অনুসরণ করতে হবে বিজ্ঞানসম্মত বিষয়গুলো।

এ প্রজন্মের স্বপ্নচারী দুই তরুণ তাহসিন ও জাহিদ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির নানা বিষয় যখন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তরুণ প্রজন্মকে, তখন তারা ঠিক প্রযুক্তিবিষয়ক জ্ঞানটিকেই প্রয়োগ করতে এসেছেন উৎপাদন খাতে। প্রথমেই তারা হাত দিয়েছেন এমন একটি উদ্ভাবনী ও বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যার সঙ্গে দেশের মৎস্য খাত তথা খাদ্য নিরাপত্তার সম্পর্ক যুক্ত। কৃষি তথা এর উপখাতগুলোয় বিজ্ঞান গবেষণা যত দ্রুত এগোচ্ছে, তার চেয়ে দ্রুততার সঙ্গে চলছে যোগাযোগ প্রযুক্তি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে যে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চোখের পলকে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে চলে যাচ্ছে অন্য প্রান্তে। এর বহুমুখী ইতিবাচক দিক যেমন রয়েছে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকির আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই নতুন নতুন বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ও প্রযুক্তিগুলো আমাদের দেশে স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন বহুমুখী গবেষণা। বর্তমানের কৃষি অনেক প্রযুক্তিনির্ভর ও বিজ্ঞানসম্মত। দিন দিন কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন বাড়ছে, তেমন যুক্ত হচ্ছে নানান কলাকৌশল। আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস), এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স), ন্যানো টেকনোলজিসহ নানা প্রযুক্তির কৃষিতে শিক্ষিত তরুণদের যুক্ত করতে হবে। তাদের জন্য তৈরি করতে হবে উপযুক্ত পরিবেশ। যেসব উদ্যোক্তা নতুন বিষয় সামনে আনছেন, এসব বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার আলোকে পৃষ্ঠপোষকতা যেমন করা দরকার, একইভাবে এগুলোর কার্যকর সম্প্রসারণে নেওয়া দরকার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। তাহলেই নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে, দেশে কার্যকরভাবে সম্প্রসারণ ঘটবে নতুন নতুন প্রযুক্তির।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর