শনিবার, ২০ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

নতুন মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার দিন

এম নজরুল ইসলাম

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই কিছু কিছু ঘটনা যেন বার বার ঘুরে ঘুরে আসে। যদি বলা হয় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। যেমন ধরা যাক বঙ্গবন্ধুর কথা। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বঙ্গবন্ধুকে কোনো দিন মুছে ফেলা যাবে না। অথচ তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার কত চেষ্টাই না হয়েছে! বঙ্গবন্ধুকে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে। বার বার কারাবরণ করতে হয়েছে। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতিতে অভিষেকও তো তাঁর জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না। অতীতেও মসৃণ ছিল না তাঁর রাজনৈতিক চলার পথটি, এখনো নয়। দেশের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পরও ছায়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করেছে ঘাতক। বহুবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। একসময় রাজনীতি থেকে তাঁকে নির্বাসনে পাঠানোর অপচেষ্টাও করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেফতার করা হয় তাঁকে।

বরাবরই আমরা দেখে এসেছি, ‘চেপে বসা’ শাসকদের চরিত্র এ রকমই হয়। সেখানে মানুষ উপেক্ষিত থাকে। মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলা ‘চেপে বসা’ শাসকদের পছন্দ নয়। মানুষ নয়, অন্তরালের অন্য কিছু যখন ক্ষমতার নিয়ামক হয়, তখন জনমত যে উপেক্ষিত হবে এটাই স্বাভাবিক। জনমানুষের প্রতিনিধিত্ব তখন অপরাধ হয়ে দেখা দেয়। এমনটিই ঘটেছিল ২০০৭ সালে। ‘চেপে বসা’ শাসকগোষ্ঠী তখন মানুষের কণ্ঠ রোধ করেছে। সবকিছুই তখন চলেছে শর্তের বেড়াজালে। অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার নামে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল সে সময়। মানুষের অধিকার আদায়ের অগ্র নেত্রী শেখ হাসিনা যখন মানুষের হারানো অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার, তখনই রুদ্ধ করা হলো তাঁকে। সে এক দুঃসহ দিন। বাংলাদেশে তখন চলছে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ নামে ‘চেপে বসা’ অপশক্তির দুঃশাসন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশকে সত্যিকার অর্থেই দুর্যোগের মেঘ আচ্ছন্ন করেছিল তখন। গণতন্ত্র নির্বাসনে পাঠিয়ে ‘চেপে বসা’ শাসকগোষ্ঠী তখন রাজনীতিবিদদের চরিত্রহননে ব্যস্ত। রাজনীতি তখন যেন গর্হিত অপরাধ। রাজনীতিক পরিচয়টিও যেন হানিকর। শাসনের নামে ত্রাসের রাজত্ব। ‘চেপে বসা’ তত্ত্বাবধায়ক নামের অপব্যবস্থায় জনজীবনে নাভিশ্বাস।

সেই সময়, ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সূর্য ওঠার আগে যে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়, টেলিভিশনের পর্দায় তার লাইভ সম্প্রচারও দেখেছে দেশের মানুষ। ঢাকায় তখন রাত পৌনে ৪টা। যৌথ বাহিনী ঘিরে ফেলল সুধাসদন- জননেত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন। তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় তখন মধ্যরাত। সেলফোনে খবরটা জানালেন বর্তমান সরকারের তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রিয়ায় বসবাসরত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক ও অনুসারীদের ফোন করে ঘুম থেকে জাগিয়ে নেত্রীর গ্রেফতারের খবর দিই এবং সকাল ৮টায় অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় স্টার্ড পার্কে শেখ হাসিনার গ্রেফতারের প্রতিবাদ ও মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ আহ্বান করি আমরা। ফোন করি লন্ডনে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানাকে। ফোনের ওপারে তাঁর কণ্ঠেও হতাশা। আমি আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানাই তাঁকে। তিনি আমাদের উৎসাহ দেন। তৎক্ষণাৎ ‘শেখ হাসিনা মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের পরামর্শ দেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নেতার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। পরদিন অস্ট্রিয়া সময় সকাল ৮টায় বিপুলসংখ্যক বাঙালি নারী-পুরুষ উপস্থিত হন বিক্ষোভ সমাবেশে। অস্ট্রিয়াপ্রবাসী সর্বস্তরের বাঙালিকে নিয়ে ‘শেখ হাসিনা মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। নেত্রী গ্রেফতারের পর থেকে তাঁর মুক্তির দাবিতে প্রতি মাসে ভিয়েনায় চারটি করে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়ে আসছিল। আমরা গণস্বাক্ষর, অস্ট্রিয়ান পার্লামেন্টের সামনে মানববন্ধন, গণঅনশন কর্মসূচিও পালন করেছি। শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলে মুক্ত করতে তাঁর যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ছোট বোন শেখ রেহানা টেলিফোনে সব সময় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বিভিন্ন নির্দেশনা ও উপদেশ দিয়েছেন। তাঁরা ছিলেন প্রত্যয়দৃপ্ত। তাঁরা জানতেন সব ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে বাংলার মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত শেখ হাসিনা একদিন ঠিকই ফিরে আসবেন তাঁর বিশ্বাসের মানুষের কাছে। ২০০৮ সালের জুনে তিনি মুক্তি পেলেন। আর একই বছর নির্বাচন অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে তো পাল্টে গেল পুরো চালচিত্র।

আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরিত্রের যে বিষয়টি সবার আগে দৃষ্টি কাড়ে তা হচ্ছে তাঁর গভীর প্রত্যয়। দেশ ও মানুষের কল্যাণে তিনি সব সময় নিবেদিত। গভীর সংকটেও তিনি জনগণের কল্যাণচিন্তা করেন। তাঁর সেই চিন্তার প্রতিফলন বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সব অর্জনে। আর এটাই হচ্ছে বাংলাদেশ ও বাঙালির সবচেয়ে বড় পাওয়া। ঘৃণ্য শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তাঁর আদর্শ মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তাঁর সুযোগ্য কন্যা, সেই আদর্শের পতাকা হাতে সামনে থেকে জাতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নিয়েছেন জীবনের ঝুঁঁকি। জনগণকে আস্থায় নিয়ে রাজনৈতিক কল্যাণের যে যাত্রা হয়েছিল তাঁর, তা থেকে তিনি এক দিনের জন্যও বিচ্যুত হননি। দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রায় কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। বাবার মতোই অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছেন। দীর্ঘদিন কাটাতে হয়েছে নিঃসঙ্গ পরবাস। স্বামী-সন্তান নিয়েও গভীর বেদনার দিন পার করতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অন্য সদস্যদের হারিয়েও স্বদেশে ফিরতে পারেননি তিনি।

বঙ্গবন্ধুকন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এ দেশের দুঃখী মানুষের নেতা; তাঁর পরিবারকে সমূলে উৎপাটনের ষড়যন্ত্র আজকের নয়, দীর্ঘ কয়েক যুগ থেকেই চলছে। সাহসী রাজনীতির পারিবারিক ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ইতিহাস মুছে ফেলার কি কুৎসিত-নির্মম ও ভয়াবহ চক্রান্তই না করেছিল প্রতিক্রিয়াশীল চক্র- রাজনৈতিক নিষ্ঠুর প্রতিহিংসাপরায়ণতার সেই চক্রান্তের জাল ক্রমেই বিছিয়েছে গোপনে! শুধু কি তাই, হীন চক্রান্তকারীরা চেষ্টা করেছে সংকীর্ণ রাজনীতির হীনমন্যতার ছদ্মাবরণে তাঁর ভাবমূর্তিকে নস্যাৎ করতে। সেই চক্রান্ত কি আজও চলছে? আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির বিরুদ্ধে কি নিরন্তর ষড়যন্ত্র করছে কোনো গণবিরোধী চক্র? দেশটিকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে এখনো প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তৎপর। ঘাপটি মেরে আছে রাজনৈতিক অপশক্তিও। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির সম্মিলিত প্রয়াস।

জনগণই বাংলাদেশের প্রাণশক্তি। সেই জনগণকে রক্ষা ও সুসংহত করেই রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্বও জনগণের। সকালের আলো ঢেকে দেওয়া কালো দিন ১৬ জুলাই। আজ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নতুন মন্ত্রে নতুন করে উজ্জীবিত হই আমরা। জনগণের জয় হোক।

লেখক : সর্ব-ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং অস্ট্রিয়াপ্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর