রবিবার, ২১ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

শেরম্যানের রাখাইন কি হাফিজের বোখারা-সমরকন্দ

তুষার কণা খোন্দকার

শেরম্যানের রাখাইন কি হাফিজের বোখারা-সমরকন্দ

আমেরিকার কংগ্রেস সদস্য ব্র্যাড শেরম্যান গত ১৩ জুন আমেরিকান কংগ্রেসে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য একটি অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা রোহিঙ্গা মুসলমানরা তাদের দেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ তার ভূখন্ডে আশ্রয় দিয়ে একটি মহৎ কাজ করেছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার এখনো বন্ধ করছে না এবং মিয়ানমার সরকার তাদের ফেরত নিতে আগ্রহী নয়। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান কোনো দিন করবে বলে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। রাখাইন রাজ্যে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে তারা এ যাবৎ তেমন দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাখাইন রাজ্য যদি মিয়ানমার রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বহাল থাকে তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যার কোনো সমাধান কোনো দিনই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাজেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যকে মিয়ানমারের ম্যাপ থেকে কেটে বাদ দিয়ে ওটি বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে হবে। ব্র্যাড শেরম্যান মনে করেন, রাখাইনকে বাংলাদেশের রাজ্য বানিয়ে দিলে রোহিঙ্গা সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধান হয়ে যাবে। মিয়ানমার একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। রাখাইন রাজ্য মিয়ানমারের অখন্ড ভৌগোলিক অংশ। ব্র্যাড শেরম্যান স্বাধীন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যকে এমন আচমকা বাংলাদেশকে দান করে দেওয়ার জন্য মনস্থির করায় আমার একটি গল্প মনে পড়ল। চতুর্দশ শতাব্দীর কথা। দুর্ধর্ষ তুর্কি যোদ্ধা তৈমুর লং তখন দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ভারতবর্ষ থেকে শুরু করে ইউরোপ পর্যন্ত যখন যেখানে তৈমুর লং অভিযানে যাচ্ছেন সেখানেই নিষ্ঠুরতার বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। সেই তৈমুর লং যখন ইরান দখল করলেন তখন ইরানিরা তেমন বড় মাপের প্রতিরোধ গড়তে পারল না। ভয়ানক যোদ্ধা তৈমুর অনেকটা বিনা বাধায় ইরান জয় করে নিলেন। ইরান জয়ের পর তৈমুরের মনে প্রশ্ন জাগল, একসময় ইরানি জাতের বীরত্বের সুনাম ছিল। উন্নত সাহিত্য-সংস্কৃতি পারস্য সভ্যতার ভূষণ হলেও তাদের শৌর্যবীর্যকে কেউ ছোট করে দেখতে পারে না। সেই সাহসী ইরানি জাত তৈমুরকে প্রায় বিনা বাধায় বিজয়ী হতে দিল এর গূঢ় কারণ কী? তৈমুর তার নিজের লোকজনকে ডেকে ইরানি জাতের ভীরুতার কারণ অনুসন্ধান করতে বললেন। তৈমুরের লোকজন যথারীতি তত্ত্ব-তালাশ করে দরবারে ফিরে তৈমুরের কাছে খবর পেশ করল। বলল, বাদশাহ নামদার! একদল কবি প্রেমের কবিতা লিখে ইরানি জাতকে বীরত্ব ভুলিয়ে দিয়েছে। ইরানিরা এখন তরবারি ফেলে দিয়ে সেই কবিদের কবিতা পড়ে আর মেয়েমানুষের মতো আহাবিহা করে দিন কাটায়। এ কথা শুনে তৈমুর চিন্তায় পড়ে গেলেন। ভাবলেন, বদমাশ কবিগুলো যদি তৈমুরের লোকজনকে কবিতা শুনিয়ে যুদ্ধ ভুলিয়ে দেয় তাহলে উপায় কী হবে? কাজেই তিনি তলোয়ারের আঘাতে বেশকিছু কবির কল্লা নামিয়ে দিলেন। তারপর মাথা ঠান্ডা করে ভাবলেন, এভাবে আর কয়টা কবিকে নিঃশেষ করতে পারবেন। তার চেয়ে পালের গোদা কবিটাকে চিনতে পারলে সেটির কল্লা নামিয়ে দিলে কেল্লাফতে। ভবিষ্যতে ইরানে কোনো বদমাশ আর কবিতা লেখার সাহস পাবে না। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। তৈমুর ইরানি জাতের পালের গোদা কবিটাকে খুঁজে বের করার হুকুম জারি করে অপেক্ষা করতে লাগলেন। যথারীতি তৈমুরের লোকজন খোঁজখবর করে তথ্য নিয়ে ফিরে এসে বলল, কবিকুলে হাফিজ বলে এক কবি আছেন। সেই ব্যাটাই এই কবিদের গুরু। সেই ব্যাটা কবিতা লেখে, ‘প্রিয়ার গালের তিলের বিনিময়ে বোখারা-সমরকন্দ বিলিয়ে দিতে পারি’। গোয়েন্দা বাহিনীর মুখে হাফিজের কবিতার চরণ শুনে তৈমুরের চক্ষু চড়কগাছ। তৈমুরের নিজের শহর সমরকন্দ কিনা হাফিজ নামের ইরানি কবি প্রিয়ার গালের তিলের জন্য বিলিয়ে দিচ্ছে! শুধু কি সমরকন্দ! সঙ্গে তৈমুরের স্বপ্ন দিয়ে গড়া বোখারাও কবি ব্যাটা বিলিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। প্রচন্ড রাগে তৈমুরের খোঁড়া পায়ের রক্ত সব মাথায় চড়ে গেল। তৈমুর তার সাঙ্গোপাঙ্গকে হুকুম করলেন সেই মুহূর্তে কবি হাফিজকে দরবারে হাজির করতে। তারা কালবিলম্ব না করে কবি হাফিজকে তৈমুরের সামনে হাজির করতে ছুটল। এর মধ্যে তৈমুরের সভাসদদের দু-একজন সাহস করে তৈমুরকে বলল, বাদশাহ নামদার! কবি হাফিজের কল্লা নামিয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এই কবি ইরানিদের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয়। ওর কল্লা নামিয়ে দিলে ইরানিরা খেপে উঠতে পারে। তাহলে আমাদের ইরানে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে। তাতে হুজুরের চীন অভিযানের স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে যাওয়ার ভয় আছে। তৈমুর বুদ্ধিটা ফেলে না দিয়ে কবি হাফিজের সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় বাতচিত করবে বলে ঠিক করলেন। এর মধ্যে হাফিজকে দরবারে হাজির করা হলে তৈমুর বললেন, তা কবিবর! তুমি কি লিখেছ, প্রিয়ার গালের তিলের জন্য তুমি বোখারা-সমরকন্দ বিলিয়ে দিতে পারো- এ কথা কি সত্যি? হাফিজ মাথা নুইয়ে সত্য মেনে নেওয়ার পরে তৈমুর বললেন, বেশ ভালো! বোখারা-সমরকন্দ বিলিয়ে দেওয়ার আগে তোমাকে তো শহর দুটি জয় করে তার মালিকানা নিতে হবে। সুদূর ইরান থেকে অভিযান চালিয়ে বোখারা-সমরকন্দ জয় করার জন্য তোমার কি কোনো পরিকল্পনা আছে? বোখারা -সমরকন্দের শাসক কারা, তাদের যুদ্ধ করার সামর্থ্য কী, তাদের সঙ্গে লড়তে হলে তোমাকে কত ডিভিশন সৈন্য নিয়ে কত লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে সব জেনেবুঝে তুমি নিশ্চয়ই প্রিয়ার গালের তিলের বিনিময়ে বোখারা-সমরকন্দ বিলিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছ। ব্র্যাড শেরম্যান মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য বাংলাদেশকে বিলিয়ে দেবেন সেটা অতিচমৎকার আয়োজন। কিন্তু রাখাইন রাজ্য আমাদের উপহার দেওয়ার আগে তিনি নিশ্চয়ই মিয়ানমারের কাছ থেকে রাজ্যটির দখল নিজে বুঝে নেবেন। আমরা শান্তিপ্রিয় জাতি। আমরা প্রতিবেশী কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াব না। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা ধৈর্যের পরীক্ষা আগেও দিয়েছি, এখনো দিচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও দেব। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিয়ানমার সরকার যে নিষ্ঠুর আচরণ করছে তা পৃথিবীর কোনো দেশ সমর্থন করে না। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমরা ইসরায়েলের মতো মারদাঙ্গা করে প্রতিবেশীদের জায়গা দখল করে রাষ্ট্রের সীমা বাড়ানোর কৌশলে বিশ্বাস করি না। আমাদের সরকার জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং অন্য প্রভাবশালী দেশগুলোকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানিয়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো থাকার কারণে বাংলাদেশ সরকার চীনকে দিয়ে মিয়ানমারের ওপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছে যাতে মিয়ানমারের শুভবুদ্ধির উদয় ঘটে। আমরা জানি, রোহিঙ্গা সমস্যা এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। যে সমস্যা এক দিনে সৃষ্টি হয়নি সে সমস্যার সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয় এই বুঝও আমাদের পরিষ্কার। আমেরিকার কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড শেরম্যান সাতসমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে রোহিঙ্গা সমস্যার এমন অলীক সমাধান কেমন করে খুঁজে পেলেন তা বোঝা যাচ্ছে না। আমেরিকার কূটনৈতিক বোধবুদ্ধি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে বলে একজন কংগ্রেস সদস্য একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে এমন দায়দায়িত্বহীন বালখিল্য কথা বলছেন এমনটি বিশ্বাস করতে পারলে আমার খুব ভালো লাগত। কিন্তু বিষয়টি কি নেহাত কথার কথা নাকি তার চেয়ে আরও বড় কোনো ষড়যন্ত্র? ডেমোক্র্যাট পার্টির নেতা ব্র্যাড শেরম্যান কংগ্রেসে এশিয়া প্যাসিফিক সাব কমিটির চেয়ারম্যান। ব্র্যাড শেরম্যানের বাবা-মা রাশিয়ান ইহুদি। ব্র্যাড নিজে আমেরিকান ইহুদি। একজন ইহুদি কংগ্রেসম্যান ঝোঁকের বশে এমন ভয়ঙ্কর কথা বলেছেন তা আমি বিশ্বাস করি না। তিনি আসলে ঠান্ডা মাথায় অনেক ভেবেচিন্তে স্বাধীন সার্বভৌম মিয়ানমার রাষ্ট্রের একটি রাজ্যকে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছেন। এ ক্ষেত্রে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা-কৌশল আপনারা স্মরণ করে দেখুন। আরব দুনিয়ার বুকের ওপর খাবলা মেরে ইসরায়েল রাষ্ট্র গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এমন একটি ষড়যন্ত্রমূলক কাজ করার ফলে গত এক শতাব্দী আরব বিশ্ব কতগুলো যুদ্ধের মুখে পড়েছে তার হিসাব ইসরায়েল নিজেরাও ভুলে গেছে। ইহুদি কংগ্রেসম্যান ব্র্যাড কি আমাদের জন্য তেমন এক পরিস্থিতির জন্ম দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন? ব্র্যাড আমাদের এমন নির্বোধ ভাবার আগে ১৯৯৩ সালের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে দেখুন। ১৯৯২ সালে যখন রাখাইন রাজ্য থেকে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছিল তখন মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনী এক রাতে টেকনাফের বিডিআর ক্যাম্পে হামলা করে ক্যাম্পে কর্মরত সব বিডিআর জওয়ানকে হত্যা করেছিল। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্তে যখন উত্তেজনা চলছে তখন ইউরোপিয়ান কমিশন থেকে বাংলাদেশকে একটি চিঠি লিখেছিল। তাতে বলা হয়েছিল- বিডিআর ক্যাম্পে হামলার ঘটনায় বাংলাদেশ যেন ধৈর্যের পরিচয় দেয়। সীমান্তের সাময়িক উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো বাড়াবাড়ি আমরা সমর্থন করব না।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দুনিয়াজুড়ে মোড়লি করার জন্য আমেরিকা আদাজল খেয়ে লেগেছিল। মোড়লি করতে চাইলেই মোড়লি পাওয়া যায় না। আমেরিকা চাইলেই ইউরোপ তাদের শত বছরের মোড়লির দখল হুট করে ছাড়বে কেন। বিশেষ করে ইংল্যান্ডকে মোড়লির আসন থেকে ঘাড় ধরে নামিয়ে দিয়ে দুনিয়ার মোড়লগিরি কব্জা করতে আমেরিকাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। রাশিয়ার অস্তিত্বের কারণে দুনিয়ার মোড়লগিরি আমেরিকার জন্য কখনই নিষ্কণ্টক ছিল না। রাশিয়া সব সময় আমেরিকার মোড়লগিরির পথে পাহাড়সমান বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আশির দশকে গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রয়কার ঝড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ধসে পড়ার পর আমেরিকা দুনিয়াজুড়ে মনের সুখে বিনা বাধায় মোড়লগিরি করার মওকা পেল। বাধাবন্ধনহীন মোড়লগিরির মওকা আমেরিকাকে দিন দিন উচ্ছৃঙ্খলতার শেষ ধাপে নিয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে দুনিয়ার মানুষের আর বাকি নেই। উচ্ছৃঙ্খলতা আর নির্বুদ্ধিতা এক পাত্রে গলাগলি করে বাস করে। আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতি প্রমাণ করে আমেরিকা কূটনীতি ভুলে গেছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে শান্তিপূর্ণ পথ খোঁজা বাদ দিয়ে আমেরিকান কংগ্রেসম্যান আমাদের যুদ্ধের পথে ঠেলে দেওয়ার কুমতলব করছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ সরকার ব্র্যাড শেরম্যানের কথা নাকচ করে দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের কথায় আমেরিকা থেমে থাকবে না। শেরম্যানের কথার সূত্র ধরে আমাদের চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যাকে কেন্দ্র করে আমেরিকা কিংবা অন্য কোনো মতলববাজ প্রতিবেশী যেন আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো নোংরা খেলায় মেতে উঠতে না পারে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।         

সর্বশেষ খবর