রবিবার, ২১ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

মানবতার সেবায় রসুল (সা.)-এর শিক্ষা

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

মানবতার সেবায় রসুল (সা.)-এর শিক্ষা

মানবতার মুক্তির দিশারি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি মানবতাকে শিক্ষা দিয়েছেন নতুন এক জীবনের, নতুন উদ্যম ও নতুন শক্তির। দেখিয়েছেন পথচলার সামর্থ্য ও পাথেয়। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দিয়েছেন ‘মানুষই আশরাফুল মাখলুকাত’। তিনি মানুষকে শিখিয়েছেন মানবতা, সাম্য, সততা, ত্যাগ, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব এবং সহমর্মিতা। তিনি আরও শিক্ষা দিয়েছেন সব বিপদ-আপদে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে; এটাই মানবতা বা ইনসানিয়াতের দাবি, যাকে আমরা এক কথায় মানবসেবা বলে জানি। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের জন্য রেখে গেছেন উত্তম আদর্শসমূহ। তার মধ্যে মানবসেবা অন্যতম। তাঁর শেখানো মানবসেবা ও উদারতার নীতি অবলম্বন করেই অতি অল্প সময়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে বিস্তার লাভ করেছে ইসলাম। বিশ্বমানবতা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে পেয়েছে নিজের সঠিক পরিচয়, সঠিক কর্মপন্থা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের ভালোবাসা, উদারতা, ধৈর্য, সংযম ও আদর্শ দিয়ে মানুষের মন জয় করেছিলেন। এভাবে সারা জীবন তিনি মানুষের কল্যাণে শ্রম ও অর্থ বিলিয়েছেন প্রশস্ত হস্তে, নিরন্নকে অন্ন ও বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দান করেছেন। রোগীর সেবা করেছেন, দাসদের মুক্তি দিয়েছেন। সর্বোপরি যেখানেই কোনো মানুষ বিপদগ্রস্ত হয়েছে; ক্ষুণœ হয়েছে মানবতা বা ইনসানিয়াত, সেখানেই তিনি মানবসেবার হাত প্রসারিত করেছেন। মানবসেবার এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে তাঁর হাতের ছোঁয়া লাগেনি। অর্থাৎ মানবসেবার সব ক্ষেত্রেই তাঁর অপরিসীম অবদান রয়েছে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনসঙ্গিনী হজরত খাদিজা (রা.) ছিলেন তৎকালীন মক্কার সেরা ধনীদের একজন। বিয়ের পর তিনি সব সম্পত্তি স্বামীর হাতে হাওলা করে দিয়েছিলেন। আর রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গরিবদের মধ্যে সেই অর্থ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে মানবতার সেবায় সাহাবায়ে কিরামরাও (রা.) পিছিয়ে ছেলেন না। তাঁরাও এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছিলেন সমানভাবে। প্রত্যেক সাহাবি ছিলেন আত্মোৎসর্গ ও মানবসেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যেমন হজরত আবুবকর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করার আগে মক্কার সেরা ধনী ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তাঁর সব সম্পত্তি ইসলামের নামে অসহায় ও দুস্থদের দান করেছিলেন এবং অন্য সাহাবিরাও জানমাল সর্বস্ব দিয়েই রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইসলামকে ভালোবেসেছিলেন। আজ যদি আমাদের অবস্থা বিবেচনা করি তাহলে দেখব আমরা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মানবসেবার আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে আছি। আমাদের অনেকের বাস্তব জীবনে মানবসেবার নমুনা খুব কমই পাওয়া যায়। কত মানুষ না খেয়ে থাকে, কত হতদরিদ্র শীতে কাতরায়, কত অনাথ সাহায্যের অভাবে শিক্ষার আলো পায় না; আমাদের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। কিংবা বর্তমানে বন্যাকবলিত এলাকায় দুর্গত মানবতার পাশে দাঁড়ানো প্রত্যেক মুসলিম ভাইবোনের মানবতার দাবি ও রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা। তিনি উত্তম মানবসেবা কায়েম রাখার জন্য বেশি বেশি দান-খয়রাত করার নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, ‘কেউ যদি হালাল উপার্জন থেকে দান করে, রব্বুল আলামিন সে দান নিজে গ্রহণ করেন। সেটিকে উত্তমরূপে সংরক্ষণ করেন। একসময় সে দানের সওয়াব পাহাড়তুল্য হয়ে যায়।’ এভাবে মানবতার সেবা এবং অন্যের দুঃখ-কষ্ট দূর করার জন্য তিনি উম্মতকে উপদেশ দিয়েছেন। একদিন তিনি হজরত আবু দারদা (রা.)-কে বললেন, ‘ঘরে তরকারি রান্না করার সময় তাতে পানি কিছুটা বাড়িয়ে দিও। খাওয়ার সময় যাতে প্রতিবেশীকে সামান্য ঝোল হলেও দান করতে পারো।’ এভাবেই তাঁর উম্মতকে আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসার জন্য উৎসাহিত করেছেন। ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও ভারসাম্য সমাজব্যবস্থা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘যারা জমিনবাসীর ওপর দয়া করে তাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়।’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা বান্দাদের উদ্দেশ করে বলবেন, হে আদমসন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম, তোমরা আমার সেবাযতœ করনি। বান্দা আরজ করবে, হে আল্লাহ! তা কেমন করে সম্ভব! আপনি তো বিশ্বজগতের প্রতিপালক। আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানো না, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল, কিন্তু তুমি তার সেবাযতœ করনি। তার পাশে দাঁড়ালে সেখানে তো আমাকেই পেতে। হে আদমসন্তান! আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, তোমরা আমাকে খাবার দাওনি। বান্দা বলবে, তা কীভাবে সম্ভব, আপনি তো রব্বুল আলামিন। আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা ক্ষুধার্ত ছিল। তুমি তাকে খেতে দাওনি। তোমার কি জানা ছিল না, তাকে খাওয়ালে তার কাছে আমাকে পেতে। হে আদমসন্তান! আমি পিপাসার্ত ছিলাম, তোমরা আমায় পানি দাওনি। বান্দা আরজ করবে, হে আল্লাহ! কীভাবে আপনাকে পানি পান করাব? আপনি তো তৃষ্ণা থেকে পবিত্র। আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা পিপাসার্ত ছিল, তুমি তার পিপাসা নিবারণ করনি। তোমার কি জানা ছিল না, তার পিপাসা মেটালে তার কাছে আমাকে পেতে।’

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, মহাদ্দিস মুফাসসির ও টিভি উপস্থাপক।

সর্বশেষ খবর