রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিজ্ঞান বিবেক ও ধর্ম

জাকারিয়া চৌধুরী

বিজ্ঞান বিবেক ও ধর্ম

প্রচলিত ধারণা, বিজ্ঞান ও ধর্ম বিপরীতমুখী অন্বেষা। একের সঙ্গে অন্যের কোনো মিল নেই। তাই যদি হয় তাহলে আল কোরআনে কেন দেখি অনেক বাণী আছে যা বিজ্ঞানের নিত্যনতুন তথ্যের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও সৃষ্টির ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিজ্ঞান যে সত্য ১৯৪০ সালের পর জেনেছে কোরআনে তা উল্লিখিত হয়েছে ১৪০০ বছর আগে নিরক্ষর ও আল্লাহর শেষ বার্তাবাহক হজরত মুহাম্মদ (সা.) -এর মাধ্যমে। আল কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা অবিশ্বাস করে তারা কি দেখে না যে, পৃথিবী ও মহাজাগতিক যা কিছু তা একসময় একত্রীভূত ছিল এক বিন্দুতে যা আমরা খন্ডবিখন্ড করে দিয়েছি নিমেষে। যা কিছু জীবন্ত তা আমরা পানি থেকে সৃষ্টি করেছি। তার পরও কি তারা তা বিশ্বাস করবে না?’ সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৩০। বিজ্ঞানেরও কথা মহাবিশ্বের উৎপত্তি ঘটে হঠাৎ করে মহাশূন্যে এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে যাকে আমরা বিগব্যাং বলে জানি। একসময় বিজ্ঞান মনে করত আমাদের ক্ষুদ্র গ্রহ ও মহাবিশ্ব স্থিতিশীল। অথচ কোরআনে বলা হয়েছে, সবকিছু গতিশীল এবং একসময় যা কিছু দেখি জানি তা ধ্বংস হয়ে নতুন সৃষ্টির আবির্ভাব ঘটবে। আধুনিক বিজ্ঞানও আগের অবস্থান থেকে এখন সরে এসে বলছে, হ্যাঁ, সবকিছু একসময় ধ্বংস হবে যাকে আমরা ‘বিগ ক্রানচ’ বলে জানি। চার্লস ডারউইনের সূত্র ধরে অনেকে বলে বেড়ান, বিবর্তনের প্রাকৃ-তিক প্রক্রিয়ায় সবকিছুর পরিবর্তন ঘটে; আল্লাহর হাত বলে কিছু নেই। তারা জানেন না কোরআনে আল্লাহ পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘তিনিই আল্লাহ, সৃজনকর্তা ও বিবর্তনের প্রবক্তা। সব রং, রূপ ও গঠনের সৃষ্টিকারী।’ সূরা হাশর, আয়াত ২৪।

কোরআনের কথায় সবকিছুর পরিবর্তন এসেছে ধাপে ধাপে হাজার হাজার লাখ লাখ বছরের ব্যবধানে কোনো কিছুই হঠাৎ করে বেড়ে ওঠেনি। বিজ্ঞান বলছে, মহাবিশ্ব ক্রমে সম্প্রসারিত হচ্ছে। আল্লাহ্ সূরা শূরার ৫ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘মহাকাশম-লীর যা কিছু আছে বিদীর্ণ করে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছি।’ মানুষ একদিন মহাশূন্যে ভ্রমণ করবে বলে আল্লাহ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। সূরা রহমানের ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে জিন ও মানুষ সম্প্রদায়! তোমরা একদিন আকাশম-লী ও পৃথিবীর সীমা অতিক্রম করতে পারবে। কিন্তু অনুমোদন ছাড়া কেউ কোনো সীমানা অতিক্রম করতে পারবে না।’ ৩৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘তাহলে তোমরা প্রভুর কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?’

জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন বলেছেন, ‘মহাবিশ্বের গতিপ্রকৃতি যে অমোঘ নিয়মে সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রিত তা থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় স্রষ্টার অস্তিত্ব। আল্লাহ সূরা আরাফের ৫৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘তিনি সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাশি সৃষ্টি করেছেন তার দেওয়া নিয়ম বেঁধে দিয়ে।’ সূরা আরাফের ৫২ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘আমরা নিশ্চয়ই তাদের কাছে একটি গ্রন্থ পাঠিয়েছি যা জ্ঞানভিত্তিক।’

কোরআন ধর্মগ্রন্থ হলেও এতে নিহিত আছে জ্ঞানের ভা-ার যা সম্পর্কে সম্মানিত আলেমরা সচেতন বলে মনে হয় না। তাদের মুখ থেকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে শুনি না। তাদের ধর্ম প্রচার শুধু ধর্মের আচার অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ। জ্ঞানের কথা, নীতির কথা তেমন কিছু থাকে না। আর যারা ধর্মকে অবজ্ঞার চোখে দেখেন তারা কোরআনকে জ্ঞান আহরণের এক অনন্য উৎস বলে জানেন না, জানতে চান না। কোরআনে হাজারো জায়গায় বৈজ্ঞানিক তথ্য উচ্চারিত হয়েছে, যা যে কোনো সচেতন পাঠকের চোখে পড়তে বাধ্য।  মানুষ এখন শুধু ব্যবসা, মুনাফা ও প্রযুক্তির চমকদানকারী ফাঁদে আটকা পড়ে মানবিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলি হারিয়ে এক অস্থির অধৈর্য ও অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের পথ ধরে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে এবং এটাকেই উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতি বলে প্রচার করছে। আমাদের উন্নয়নের ধারা ও জীবনধারা যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও সৌন্দর্য বিনষ্টকারী তা দেরিতে হলেও মানুষ এখন উপলব্ধি করছে কিন্তু কায়েমি স্বার্থ এর প্রতিকারের পথ রুদ্ধ করে রেখেছে। শুধু ধর্মের বা দর্শনের কথা নয়, বিজ্ঞানীরা যখন বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধ করতে না পারলে আমাদের সুন্দর গ্রহ কয়েক দশকের মধ্যে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে মানব-অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। শুধু বিশ্ব উষ্ণতা নয়, আমাদের লাগামহীন জীবনধারা, রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ, অর্থনৈতিক নীতি ও জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন না আনতে পারলে আজকের সভ্যতা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না; অচিরেই তা ধসে পড়বে। আমাদের বাড়ি, গাড়ি, মোবাইল, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, নিত্যনতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন দিয়ে কী হবে যদি মানব-অস্তিত্ব টিকে না থাকে? নৈতিকতা, মানবিকতা, বিবেক ও বিবেচনা যে সমাজে প্রায় শূন্যের কোঠায় সেই মানবসমাজ কী করে বেশি দিন টিকে থাকে? ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতার কথা বলতে গিয়ে আল্লাহ বলেছেন, যখনই মানবসভ্যতা নৈতিকতা ও মানবিকতা হারিয়ে সমাজ পরিচালনা করে তখন তিনি তা ধ্বংস করে দেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কশাঘাতে যেমন ভূমিকম্প, খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, মহামারি ইত্যাদি দিয়ে। পৃথিবীতে হাজারো সভ্যতার উত্থান ও পতন ঘটেছে এ প্রক্রিয়ায়। আমাদের জানা ইতিহাস শুধু পাঁচ হাজার বছরের। প্রাগ-ঐতিহাসিক লাখ লাখ বছরের উল্লেখ আছে কোরআনে যার উন্নয়ন ও লয় হয়েছে আল্লাহ-নির্দেশিত এ প্রক্রিয়ায়। কোরআনের সতর্কীকরণে যেমন আমাদের আস্থা নেই এখন বিজ্ঞানের সতর্কীকরণেও আমাদের বিশ্বাস নেই; যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই বিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তিধর নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথাবার্তা ও আচরণে। তিনি তো পরিবেশ ও জলবায়ুসংক্রান্ত বিজ্ঞানীদের সতর্ক বার্তাকে বকওয়াছ বলে উড়িয়ে দিয়ে সম্পাদিত সব বিশ্বচুক্তি থেকে সরে গেছেন।

বিশ্বাস আমাদের বর্তমান জীবনের সব কার্যক্রম ও পাঠ থেকে উঠে গেছে। সন্দেহের ও বিশ্বাসভঙ্গের বিষাক্ত বাতাস থেকে নিজেদের অধিকার রক্ষা করি আইন-আদালত ও উকিল-ব্যারিস্টারের শরণাপন্ন হয়ে যা ব্যয়বহুল বলে নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য সম্ভব হয় না। যেমন সম্ভব হয় না সাধারণ মানুষের জন্য উচ্চমানের চিকিৎসাসেবার। পাঁচ তারকা হোটেলের মতোই পাঁচ তারকা হাসপাতাল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

নতুন নতুন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন একদিকে যেমন জীবনে নতুন নতুন সুযোগ-সুবিধার দ্বার খুলে দিচ্ছে, অন্যদিকে নিত্যনতুন ক্রাইমের জন্ম দিচ্ছে। অপরাধপ্রবণতা উসকে দিচ্ছে। সাইবার ক্রাইমের প্রসার ঘটছে। যে সমাজের মানুষের মনে বিবেকের বালাই নেই সেই সমাজে প্রযুক্তির শুধু ভালো দিকটাই চোখে পড়ে কিন্তু তার অপপ্রয়োগ রোধ করার পথ কী? সেদিকে আমাদের বিশেষ নজর নেই, গরজ নেই। শুধু মুনাফার দিকটাকেই বড় করে দেখি, ক্ষতির দিকটা তলিয়ে দেখি না।

সুদূর অতীতে মানবসভ্যতার বিকাশ ঘটেছে একেক সময় একেক অঞ্চলে। যেমন গ্রিক সভ্যতা, পারস্য সভ্যতা, ব্যাবিলনিয়ান, ইনকা, চীন, ভারত এবং নাম জানা অজানা অনেক অনেক সভ্যতার। মানুষের মধ্যে বিশেষ কিছু গুণাবলির জন্য সভ্যতার উত্থান হয়েছে। আবার সামাজিক চরম অবক্ষয়ের কারণে পতন ঘটেছে। এখন বিশ্বব্যাপী একই সভ্যতা- মানবসভ্যতা যা এখন বাজারসভ্যতায় রূপ নিয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে একই সূত্রে গেঁথে ফেলেছে। আধুনিক সভ্যতার উত্থান এখন যেমন বিশ্বব্যাপী, পতন এলে তাও হবে বিশ্বব্যাপী। আমার প্রশ্ন, আমরা কি নই এখন পতনের দ্বারপ্রান্তে?

বিজ্ঞানের জ্ঞান ও অর্জন ইন্দ্রিয়সাপেক্ষ। শুধু মনের সন্তুষ্টিতে সীমাবদ্ধ। আত্মার সন্তুষ্টির তাগাদা নেই সেখানে। মানুষের জীবন গঠিত মন ও আত্মার সমন্বয়ে। আত্মা আছে বলেই আমরা পশু না হয়ে হয়েছি মানুষÑ শ্রেষ্ঠ জীব। মানবজীবনে আত্মার প্রতিফলন ঘটে বিবেকে। বিবেকহীন মানুষ আত্মাহীন মানুষ। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, যারা পাপাচারে লিপ্ত হয় তারা নিজেদের আত্মাকে কষ্ট দেয়।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে নিত্যনতুন সামগ্রী উদ্ভাবন করে জীবনকে সুশোভিত করতে পারে, ব্যবসার সুযোগ ও ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করতে পারে। কিন্তু পারে না বিবেক দান করতে, প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসা সঞ্চার করতে, ব্যক্তিজীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার সঠিক নিয়মনীতি নির্ধারণ করতে। সেজন্য যে জ্ঞান ও ভাবাবেগের দরকার তা ক্রমে লোপ পাচ্ছে আমাদের শিক্ষা, দীক্ষা ও চর্চা থেকে। আল্লাহর উক্তি, তিনি মানুষকে জ্ঞানদান করেন প্রেরণার মাধ্যমে। এখনকার মানবসভ্যতা আল্লাহর ভালোবাসা ও প্রেরণা থেকে বঞ্চিত। বঞ্চিত হব না কেন আমরা, যখন আল্লাহকে গ্রাহ্য করি না আর। তবু বলব আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

আমাদের ক্ষয়িষ্ণু সমাজকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন নৈতিকতা ও মানবিকতার জ্ঞানে উদ্দীপ্ত ও আলোকিত করে প্রতিটি শিশুকে স্কুলজীবনের শুরু থেকে পাঠদান করা। আর সেই প্রয়োজনে প্রাথমিক থেকে শুরু করে প্রতিটি স্কুলে এজন্য আলাদা ক্লাস চালু করা। অন্যান্য পাঠক্রমের সঙ্গে এ বিষয়ে পড়াশোনা ও পাস করা বাধ্যতামূলক করা। শুধু জেল পুলিশের ভয় দেখিয়ে অপরাধ রোধ করা যাবে না, যদি না অপরাধপ্রবণতা মন থেকে উপড়ে ফেলা যায়। শৈশব থেকে বেড়ে ওঠার কালে যে মূল্যবোধ জন্মায় মানুষের মনে তা-ই প্রতিফলিত হয় পরবর্তীকালে তার আচার-আচরণে। অতএব আমাদের সময়ে যদি পরিবর্তন নাও আসে, অন্তত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে নৈতিকতা ও মানবিকতার বোধ নিয়ে জীবন যাপন করে সমাজে সুখ ও শান্তিতে বসবাস করতে হলে। কার ধর্ম কী তা বিচার্য নয়, কেননা সব ধর্মেরই আবির্ভাব ঘটেছে মানুষকে এ ব্যাপারে জ্ঞানদানের জন্য। ধর্ম যা আছে আমাদের সমাজে তা শুধু আনুষ্ঠানিকতা ও স্বার্থ আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে। আমার এ প্রস্তাবের ব্যাপারে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সজাগ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। জানি না শেষ পর্যন্ত তার গোচরীভূত হবে কিনা! আমার বিশ্বাস তার নজরে এ প্রস্তাব এলে তিনি তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবেন। কেননা তিনি একজন ডায়নামিক সরকারপ্রধান।

লেখক : সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।  

Email : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর