শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিচারের বাণী নীরবে কাঁদার জন্য নয়

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

বিচারের বাণী নীরবে কাঁদার জন্য নয়

বরগুনার মঞ্চে গত কদিন ধরে একের পর এক যে নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে তাতে দেশবাসী শুধু হতবাকই নন, শঙ্কিতও বটে। দুঃখের বিষয় এই যে, এ নাটকগুলো ঘটাচ্ছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর পুত্র সুনাম দেবনাথ, যার বিরুদ্ধে মাদক গডফাদার বলে সবারই অভিযোগ রয়েছে। নাটকের মূল চরিত্রে আরও রয়েছেন বরগুনা জেলার এসপি, যার নাম মো. মারুফ হোসেন।

ঘটনার শুরু ২৬ জুন। সেদিন প্রকাশ্য দিবালোকে কয়েকজন অস্ত্রধারী মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রিফাত শরীফ নামক এক তরুণকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে কয়েক শ লোকের উপস্থিতিতে। সেই রোমহর্ষক, অমানবিক ও নিষ্ঠুর দৃশ্য ভিডিওতে প্রচারিত হলে গোটা দেশবাসী স্তম্ভিত হয়। ভিডিও ধারণের ফলে হত্যাকারীদের পরিচয় আর গোপন রাখা যায়নি। যে কজন কুপিয়ে হত্যাকান্ড ঘটাল, তাদের নেতৃত্বে ছিল বরগুনার কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী নয়ন বন্ড। আরও ছিল দুজন সহোদর যাদের নাম রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী। দুজনই জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন, যিনি একসময় স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যও ছিলেন, তার পুত্রসম আত্মীয়। এ নৃশংস হত্যা ঘটনার পর স্বভাবতই নিহতের পিতা দুলাল শরীফ এজাহার দায়ের করেন। আসামিদের মধ্যে অন্যতম ছিল নয়ন, রিফাত ফরাজী, রিশান ফরাজী প্রমুখ। এজাহার দায়েরের পরপরই মূল আসামি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। এজাহারে এক নম্বর সাক্ষী হিসেবে দেখানো হয় নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে। যে ভিডিও মারফত গোটা জাতি এ নৃশংস হত্যাকান্ড দেখে হতবিহ্বল হয়, তাতে দেখা যায় স্ত্রী মিন্নি নিঃসহায়ভাবে তার স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে এবং উপস্থিত জনতার সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে। শুধু তাই নয়, মিন্নি তার আহত স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালে যান, হাসপাতালের রেকর্ড তাই বলছে।

কয়েক দিন পরই শুরু হয় নাটক। নিহতের পিতা হঠাৎ করেই দাবি করেন মিন্নিও হত্যাকারীদের একজন এবং এজন্য তিনি মানববন্ধন করে মিন্নির গ্রেফতার দাবি করেন। তখন নয়নের মাও সাংবাদিকদের বলেন, মিন্নি তার খুনি ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখত। এর মধ্যে আরও একটি নাম বিশেষ করে উচ্চারিত হতে থাকে, সেটি বরগুনা জেলার পুলিশের এসপি, যার নাম মারুফ হোসেন। যার রহস্যজনক তৎপরতা কারও দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী পুলিশই মিন্নির বিষয়ে নিহত রিফাতের পরিবারে সন্দেহ ঢুকিয়েছে। এই অমানুষিক হত্যাকান্ডের পরপরই বরগুনার সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর পুত্র সুনাম দেবনাথের সঙ্গে বরগুনার এসপি মারুফ হোসেনের রুদ্ধদ্বার কক্ষে দীর্ঘ বৈঠক হয়। যে খবর আড়াল করে রাখা যায়নি।

অভিযোগ রয়েছে, মূল আসামি নয়ন, বরগুনায় এক সন্ত্রাসী এবং মাদক ব্যবসায়ী বাহিনী গড়ে তোলার কারণে তার নাম হয় ‘নয়ন বন্ড’, বহু বছর ধরে মাদক ব্যবসার গডফাদার হিসেবে ব্যবসা চালিয়ে গেলেও সে রয়েছে পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারণ এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথ সব সময়ই তাকে রক্ষা করে আসছে এবং এই রক্ষাকার্যে জেলার এসপিরও বড় ভূমিকা ছিল। এসব তথ্য-উপাত্ত মোটামুটি অকাট্য। শোনা যায়, এই মাদক ব্যবসায়ে এসপি মারুফেরও অংশ থাকতে পারে, যার কারণে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর যুদ্ধ ঘোষণার পরও নয়ন বন্ড এবং তার সহযোগীরা পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।

নাটকে আশ্চর্য পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় যখন নিহতের পিতা আকস্মিকভাবে বলে বসেন যে মিন্নিও একজন আসামি এবং তার গ্রেফতার দাবি করেন। অথচ কদিন আগেই একই ব্যক্তি তার দায়ের করা এজাহারে মিন্নিকে এক নম্বর সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করেন; অত্যন্ত যৌক্তিক কারণে, কেননা স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টার দৃশ্য ছিল নিখুঁত এবং স্বচ্ছ। মিন্নি নিজের জীবন বিপন্ন করে এ কাজটি করেছেন বলেই ভিডিওচিত্র বলছে। আইনে একটি কথা আছে- মানুষ মিথ্যা বলতে পারে, কিন্তু ছবি এবং পরিস্থিতি মিথ্যা বলতে পারে না। তা ছাড়া তার ছেলের সঙ্গে মিন্নির বিয়ের বয়সও বেশ কয়েক মাস। বরগুনা ছোট্ট একটি জেলা। সেখানে মিন্নি এবং নিহত রিফাত একত্রেই রিফাতের বাবার বাড়ি বসবাস করতেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কিছুই না জেনে হঠাৎ এক রাতের ব্যবধানে এত কিছু জেনে যাওয়াটা সবাইকে অবাক করেছে। আরও অবাক করেছে খুনি নয়নের মায়ের এই মর্মে বক্তব্য যে মিন্নি তার পুত্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখত। অবাক এজন্য, মাত্র এক দিন আগেই যার পুত্র নিহত হয়েছে তিনি তার পরদিনই পুত্রশোক থেকে উঠে এসে অন্যসব কথা বাদ দিয়ে মিন্নির বিরুদ্ধে বক্তব্যে নেমে গেলেন।

মিন্নিকে জড়ানোর দাবি জানিয়ে যে সংবাদ সম্মেলন করা হয় সেখানে উপস্থিত থেকে দৌড়ঝাঁপ দিতে দেখা গেছে শম্ভুপুত্র সুনাম দেবনাথকে। তার সঙ্গে প্রধান আসামির সম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত। এ সময় এসপি মারুফের তৎপরতাও দৃশ্যমান। একজন আইনজ্ঞ হিসেবে আমার বার বার যে কথাটি মনে পড়ছে তা হলো, গোটা জাতিকে নাড়া দেওয়া এবং গোটা জাতির জন্য উদ্বেগজনক ঘটনায় একটির পর একটি নাটকের পেছনে যে উদ্দেশ্য কাজ করছে, যা হলো নরপিশাচ হত্যাকারীদের রক্ষা করা, যার পেছনে মূল মদদদাতা হচ্ছে এলাকার এমপি শম্ভুপুত্র, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন এবং তাদের আজ্ঞাবাহী হয়ে অতিবিশ্বস্তজনের ভূমিকায় কাজ করছেন এসপি। রক্ষা করার কথা এজন্য বলছি যে, এ ঘটনা যদিও শতাধিক লোক দেখেছে, কিন্তু তাদের কাউকে সাক্ষী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি এবং চিহ্নিত করা হলেও এত প্রভাব এবং ভয়ভীতি কাটিয়ে কেউ সাক্ষ্য দিতে আসবেন কিনা সেটা বড় প্রশ্ন। একমাত্র বিশ্বস্ত সাক্ষী ছিল মিন্নি এবং তাই প্রভাবশালীদের সিদ্ধান্ত হলো মিন্নিকে আসামি করা গেলে সে আর সাক্ষী দিতে পারবে না, মামলা ভেস্তে যাবে। শম্ভুপুত্রের দোসর আসামিরা বেঁচে যাবে। আরও ধারণা করা হয়, এ মামলা বিচারে গেলে এবং মিন্নি সাক্ষ্য দিলে থলের বিড়াল বেরিয়ে গেলে বরগুনার মাদক ব্যবসায়ে সুনাম দেবনাথ ও এসপি মারুফের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হয়ে যাবে। হত্যাকারীরা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বেঁচে যাবে। তাই তাদের দৃঢ় সিদ্ধান্ত হলো, যে করেই হোক মিন্নিকে সাক্ষীর তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে আর তার সবচেয়ে বড় সফল পন্থা হবে যদি মিন্নিকে আসামি হিসেবে দাঁড় করানো যায়। এ উদ্দেশ্যেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় শম্ভুপুত্র এবং তার আজ্ঞাবাহী এসপি। তারাই যে নিহত রিফাতের পিতা এবং নয়নের মাকে বাধ্য করেছেন সংবাদ সম্মেলন ডাকতে, মিন্নির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে, তা প্রমাণিত। ফলে ন্যায়বিচার কতটুকু দিনের আলো দেখতে পাবে, সে প্রশ্ন জনমনে দেখা দিয়েছে। এ ধরনের নৃশংস হত্যাকারীরা যদি বিচারের কঠিন হাত থেকে বেঁচে যায়, তাহলে সেটি হবে একটি জাতীয় দুর্ভাগ্য। দেশবাসী এ হত্যার পরিণতির দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাক্ষ্য আইনের ৩০ ধারামতে কোনো ব্যক্তি অপরাধ স্বীকার করে বক্তব্য দিলে, আদালত সে বক্তব্যের ভিত্তিতেই তাকে সাজা দিতে পারে যদি মনে করে তার স্বীকারোক্তি সত্য এবং স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অর্থাৎ ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে সে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে, শুধু স্বীকারোক্তিকারীকেই সাজা দেওয়া যায়, স্বীকারোক্তিকালে সে ব্যক্তি যদি অন্য কারও নাম উল্লেখ করে, তাহলে শুধু সেই তৃতীয় ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া যায় না। তৃতীয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্য সাক্ষ্য থাকলে স্বীকারোক্তিকারী তৃতীয় ব্যক্তির বক্তব্যকে বিবেচনায় নেওয়া যায় মাত্র।

প্রথম দিন যখন মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হলো, তখন তার পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়াননি। অভিযোগ রয়েছে, সুনাম গংদের হুমকির কারণে কেউ দাঁড়াতে সাহস করেননি। সে অবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের উচিত ছিল মিন্নির বিরুদ্ধে কোনো আদেশ দেওয়ার আগে তার পক্ষে কোনো আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে তার বক্তব্য শোনা। তদুপরি কোনো অবস্থায়ই ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের উচিত হয়নি এক তরুণীকে কোনো পুরুষ পুলিশের হাওলায় রিমান্ডে দেওয়া। এ ব্যাপারে ম্যাজিস্ট্রেট উচ্চ আদালতের নির্দেশনা খেলাপ করে তার যোগ্যতা এবং সম্ভবত নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।

নাটকের এখানেই শেষ নয়। অবশেষে যখন মিন্নির পক্ষে একজন স্থানীয় আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হলো, তিনি একজন আইনজীবীর নীতিমালা ভঙ্গ করে চলে গেলেন সেই সংসদ সদস্য শম্ভুর সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করতে। সে সভায় শম্ভুপুত্রও উপস্থিত ছিলেন। অ্যাডভোকেট সাহেবের এহেন বৈঠক নিশ্চিতভাবে বার কাউন্সিলের বিধান পরিপন্থী। কোনো অবস্থায়ই তার সেদিন শম্ভুর ডাকে যাওয়া উচিত হয়নি। তিনি অবশ্যই এই বলে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেছেন যে, উক্ত বৈঠক ছিল ভিন্ন বিষয় আলোচনার জন্য। কিন্তু বৈঠকের সময় এবং সেখানে শম্ভুপুত্রের উপস্থিতি এ সাফাইকে সমর্থন করে না। শুনানির আগের দিন মিন্নির আইনজ্ঞকে ডেকে, রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে শম্ভু ও তদীয় পুত্র আবারও নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণ করলেন নয়ন এবং মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কথা এবং তাদের বাঁচানোর জন্য শম্ভুপুত্র গং মরিয়া হয়ে আছে।

সুতরাং অ্যাডভোকেট সাহেবের কার্যকে কেউ রহস্যজনক বললে তা উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। রিমান্ডের বিষয়ে সদ্যপ্রয়াত বিচারপতি হামিদুল হক সাহেবের ১৫ দফা নির্দেশনা রয়েছে যেগুলো আপিল বিভাগ বহাল রেখেছে। এ নির্দেশনা ভঙ্গ করে কোনো স্বীকারোক্তি নেওয়া হলে তা আইনত অগ্রহণযোগ্য। মিন্নির রিমান্ডকালে বিচারপতি হামিদুল হকের নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করা হয়নি নিশ্চিতভাবে। সেখানেও ম্যাজিস্ট্রেটের যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তিনি বললেন, স্বীকারোক্তির কারণে জামিন দেওয়া গেল না। অথচ একবারও প্রশ্ন করলেন না বিচারপতি হামিদুল হক প্রদত্ত নির্দেশনা পালিত হয়েছে কিনা।

এ অবস্থায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে এবং বিচারের বাণীকে যেন নীরবে কাঁদতে না হয়, সেজন্য মামলাটি বরগুনা থেকে সরিয়ে অন্য কোনো জেলায় বা এমনকি সরাসরি শুনানির জন্য হাই কোর্টে নিয়ে আসা অপরিহার্য। এত প্রভাব খাটিয়ে মামলায় ন্যায়বিচার বরগুনায় হতে পারে না। এ ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হাই কোর্টও সিদ্ধান্ত নিতে পারে বা মিন্নির আইনজীবী ৫২৬ ধারায় হাই কোর্টে দরখাস্ত করতে পারেন। জেলা পরিবর্তনের পক্ষে প্রচুর যুক্তি ও তথ্য রয়েছে। তদুপরি এ মুহূর্তেই মামলার তদন্ত বরগুনা পুলিশ থেকে সরিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) প্রদান ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য একান্ত আবশ্যক। বরগুনা পুলিশের তদন্ত ন্যায়বিচারের অনুকূলে হবে না। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ নীরব থাকলে মিন্নির পক্ষ থেকে রিট করে সুফল পাওয়া যেতে পারে। কেউ কেউ এসপি পরিবর্তনের কথা বলেছেন। তবে বর্তমান এসপির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে সেগুলো সর্বোচ্চভাবে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক তদন্ত হওয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে। তা না হলে শুধু বিচারের বাণীই নীরবে কাঁদবে না, বরং জনমনে প্রশ্ন থেকে যাবে।

মিন্নি ১৬৪ ধারায় তথাকথিত বক্তব্য দেওয়ার আগেই এসপি গণমাধ্যমে বলে ফেললেন মিন্নি দোষ স্বীকার করেছে। এ ধরনের মিথ্যাচারের মাধ্যমে তিনি শুধু জনগণকেই বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টাকে জোরালো করার চেষ্টা করেননি বরং একটি গর্হিত অপরাধমূলক কাজও করেছেন বিচার ও তদন্তকে নির্লজ্জভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। তা ছাড়া তার উক্ত অগ্রিম বক্তব্য এটাও প্রমাণ করছে, তিনি জানতেন মিন্নি ১৬৪ ধারায় তথাকথিত স্বীকারোক্তি দেবেন, কেননা বরগুনা পুলিশ তো তিনিই নিয়ন্ত্রণ করছেন তার নিজ স্বার্থ ও সুনামদের স্বার্থের কথা নিশ্চিত করে। গত কয়েক বছর বাংলাদেশ পুলিশ অনেক প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়েছে। এ অবস্থায় মারুফ হোসেনের মতো দৃশ্যত অসৎ পুলিশ কর্মকর্তা যেন গোটা পুলিশ সম্প্রদায়ের গৌরব বিনষ্ট করতে না পারে, সেদিকে পুলিশ হেডকোয়ার্টারকে লক্ষ্য রাখতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়কে এবং সে উদ্দেশ্যেই কালবিলম্ব না করে মারুফ এসপির বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। নয়ন বন্ডের সঙ্গে তার অবৈধ বাণিজ্যে শেয়ার ছিল কিনা তাও দুর্নীতি দমন কমিশনের অবিলম্বে তদন্ত করা উচিত। যেমনটি তারা করেছে, ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে।

এটিও দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, এসপি মারুফ আসামিদের গ্রেফতার প্রক্রিয়া না চালিয়ে মিন্নিকে আসামি হিসেবে দাঁড় করানোর ব্যাপারেই বেশি সক্রিয়। গণমাধ্যমে তার কথা শুনে মনে হয়েছে, মিন্নিকে আসামি করাই তার মূল উদ্দেশ্য। তিনি বলেছেন, তিনি কারও দ্বারা প্রভাবিত নন। অথচ ঘটনাপ্রবাহে এবং সুনামের সঙ্গে তার একাধিক রুদ্ধদ্বার বৈঠক, গণমাধ্যমে তার বক্তব্য থেকে সর্বস্তরের জনগণই ভাবছে, হত্যাকারী এবং সুনামকে বাঁচানোই তার মূল উদ্দেশ্য এবং সেজন্যই তিনি পরিকল্পিতভাবে শম্ভুপুত্রের প্রভাবে, তাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমেই তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে চলেছেন। পুলিশের সুনামের স্বার্থেই তার বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ ও উচ্চতর তদন্ত সম্পন্ন করা উচিত। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কাম্য। এটি যে একটি সাধারণ হত্যাকান্ড নয়, এটি এমন একটি ঘটনা যার দিকে গোটা দেশ তাকিয়ে আছে, যে মামলার তদন্তের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসনের মৌলিক প্রশ্ন।

ম্যাজিস্ট্রেটের বিষয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই জেগেছে। মিন্নির পক্ষে কোনো কৌঁসুলি না থাকার পরও রিমান্ড আদেশ দিয়ে ন্যাচারাল জাস্টিস-তত্ত্ব ক্ষুণœ করেছেন এই ম্যাজিস্ট্রেট।

দ্বিতীয়ত, উচ্চ আদালতের বহু নির্দেশনা ভঙ্গ করে তিনি একজন তরুণীকে পুরুষ পুলিশের হাওলায় রিমান্ডে দিয়ে শুধু নিয়মই ভঙ্গ করেননি বরং চরম অবিচারকসুলভ আচরণ করেছেন। তিনি শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেওয়ার মতো কাজটিই করেছেন। তৃতীয়ত, মিন্নি যখন তার ১৬৪-র জনাববন্দি তুলে নেওয়ার জন্য দরখাস্ত দিলেন, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব একবারের জন্যও জিজ্ঞাসা করলেন না যে, রিমান্ডকালে বিচারপতি হামিদুল হক নির্দেশিত পন্থা অনুসরণ করা হয়েছে কিনা, কেননা সেই নির্দেশনাগুলো এখন আইন এবং সে নির্দেশনা ভঙ্গ হয়ে থাকলে, যা দৃশ্যত হয়েছে, কোনো তথাকথিত স্বীকারোক্তিই আইনত গ্রহণযোগ্য নয়।

চতুর্থত, মিন্নির পক্ষে যখন চিকিৎসার সুবিধার জন্য দরখাস্ত করা হলো, সেটি নাকচ করে ম্যাজিস্ট্রেট শুধু অমানবিক কাজটিই করেননি, বরং মিন্নিকে একটি বড় ধরনের আইনি অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেছেন। মিন্নির অভিযোগ, তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে (মিন্নিকে রিমান্ডের পর তার ওপর নির্যাতনের প্রমাণ ছিল খালি চোখেই দৃশ্যমান, যা গোটা দেশ দেখেছে)। সে অবস্থায় একজন বিচারক হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের ন্যূনতম দায়িত্ব ছিল একজন চিকিৎসককে দিয়ে মিন্নির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো। কোনো আসামি অসুস্থতা দাবি করে চিকিৎসার সুবিধা চাইলে তা নাকচ করার নজির বিরল। তা ছাড়া জামিন আদেশ নাকচ করার ব্যাপারে তিনি এটি মোটেও নজরে নেননি যে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় বিচারাধীন মহিলা আসামিদের জন্য বিশেষ সুবিধার কথা বলা আছে।

এসব বিবেচনায় নেওয়ার পর বিচারক হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের যোগ্যতা, তার নিরপেক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, তদন্ত, জামিন, রিমান্ড মামলার জেলা বদল ইত্যাদি প্রশ্ন শিগগিরই হাই কোর্টে উঠবে। মিন্নির আইনজীবীদের উচিত হবে ম্যাজিস্ট্রেটের হেন কার্যকলাপ হাই কোর্টের নজরে আনা, যাতে হাই কোর্ট যথোপযুক্ত নির্দেশনা দিতে পারে। আওয়ামী লীগের উচিত শম্ভুপুত্রের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানো।

বর্তমান সরকার আইনের শাসন নিশ্চিত রাখতে বদ্ধপরিকর। এ সরকারের সময়ে রিফাত হত্যা তদন্ত/মামলা যেন নীরবে না কাঁদে সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে। সত্যিকার হত্যাকারী যেন দৃষ্টান্তমূলক সাজা পায়, নিরপরাধী কাউকে যেন হেনস্তা করা না যায়; সেটা দেখা সবার দায়িত্ব।

 

লেখক : সাবেক বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর