শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

শুদ্ধ সমাজ গড়ে উঠুক

নূরে আলম সিদ্দিকী

শুদ্ধ সমাজ গড়ে উঠুক

বাংলাদেশ মৌলিক অধিকারবিবর্জিত এক বিচিত্র ও অদ্ভুত দেশ। দেশটি টোটালিটেরিয়ান স্টেটে পরিণত হয়েছে। এখানে এখন আর জনাকীর্ণ সভায় অধিকারবিবর্জিত মানুষের পক্ষে কোনো গগনবিদারী আওয়াজ ওঠে না। খুন, ধর্ষণ, গুমের বিরুদ্ধে দু-একটা মানববন্ধন হয়। প্রতিকারের এটিই যেন চূড়ান্ত পদ্ধতি। এত সংক্ষিপ্ত পরিসরে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো সফল প্রতিবাদ গড়ে উঠতে পারে না। সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদে এ দায়সারা গোছের অনুষ্ঠানটি আজকাল ফ্যাশনে রূপ নিয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার ও স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণের বিশাল বিস্তীর্ণ পথপরিক্রমণে সমুদ্রের যে গর্জন শোনা যেত, মিছিলে লাখো কণ্ঠের যে দৃপ্ত আওয়াজ উঠত, কোনো অন্যায়, অবিচার, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে মুষ্টিবদ্ধ বলিষ্ঠ হাত যে শক্তিতে ও সাহসে আকাশের দিকে উত্তোলিত হতো, অশান্ত বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের মতো যে আওয়াজ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতো- তা আজ শোনা যায় না। শুধু কি তাই? মানুষ দুর্ঘটনা অথবা আক্রমণের শিকার হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রাজপথে পড়ে থাকলে কেউ অকুতোভয়ে তার কাছে তো ছুটে যায়-ই না, এমনকি দুস্থ, বিপর্যস্ত, রক্তাক্ত মানুষটিকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার দৃষ্টান্তও বিরল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনও দেখা গেছে, রাজপথের পথচারী একটু সাহস দেখাতে পারলে একটি প্রাণ অকালে ঝরে যেত না, এমনকি দুর্বৃত্তকেও হাতেনাতে ধরা যেত। আমি বার বার বলেছি, লিখেছি- ১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত থেকেছি। গণমিছিলের অনেক পথ হেঁটেছি, অনেক স্লোগান দিয়েছি। অনেক অগ্নিঝরা স্লোগানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছি। সভা এবং মিছিল অনেক সময় আক্রান্ত হয়েছে কিন্তু বিভ্রান্ত হয়নি, ছত্রভঙ্গও হয়নি। অজেয় শক্তিতে সেই আক্রমণ মোকাবিলা করে আরও দৃপ্ত পদক্ষেপে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হয়েছি। আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ ঘটনাÑ ১৯৬৬-এর ঐতিহাসিক ৭ জুন মনু মিয়ার লাশ নিয়ে যখন মিছিল শুরু করি, তখন প্রারম্ভকালে অল্পসংখ্যক লোকই সেই মিছিলে অংশ নিয়েছিল। আমাদের কাঁধে মনু মিয়ার লাশ যেন একটি অগ্নিগর্ভ প্রত্যয়, সব চিত্তকে উদ্বেলিত ও উচ্ছ্বসিত করার একটি প্রত্যয়দৃঢ় চেতনা। সেই জাগ্রত জনতার দৃপ্ত পদক্ষেপের সঙ্গে আমিও মনু মিয়ার লাশ কাঁধে নিয়ে যখন হেঁটে আসছিলাম, তখন পুলিশ মারমুখী ও উদ্ধত মানসিকতায় বার বার আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল, লাঠিচার্জ করছিল, টিয়ার গ্যাস ছুড়ছিল অবিশ্রান্ত ধারায়। কিন্তু উদ্বেলিত জনতার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মিছিলের কলেবর আক্রমণের সব উদ্ধত ঔদ্ধত্যকে ভ্রুক্ষেপ না করে বজ্রনিনাদে স্লোগান দিতে দিতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। আমার কাঁধে যে মনু মিয়ার লাশ, একপর্যায়ে মারমুখী পুলিশ আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লাঠি ও বেয়নেটের প্রচ- আক্রমণে আমাদের পর্যুদস্ত ও পরাভূত করে লাশ ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয় বটে (তেজগাঁও রেলগেটের কাছে লাশ ছিনিয়ে নেয়) কিন্তু মিছিলকে অবরুদ্ধ করতে পারেনি, তার উচ্ছ্বাস ও অমিত শক্তিকে নিষ্প্রভ করতে পারেনি। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে লাশ আমরা ধরে রাখতে পারিনি কিন্তু মনু মিয়ার রক্তাপ্লুত গেঞ্জি আমাদের আয়ত্তে রয়ে যায়। সেই গেঞ্জিটাকেই বাঁশের আগায় ঝুলিয়ে দিয়ে রক্তনিশান বানিয়ে আমরা তেজগাঁও থেকে শাহবাগ হয়ে কার্জন হলে উপস্থিত হই। বিস্তীর্ণ পথের পদযাত্রায় মাঝে মাঝে আমরা পথ-সভা করি। সেই পথসভায় উদাত্ত আহ্বানে মানুষ উল্কার মতো ছুটে এসে মিছিলে অংশগ্রহণ করে এবং মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে অগ্নিঝরা স্লোগান দিতে থাকে। স্মরণ করলে এখনো আমার চিত্ত শিহরিত হয়। সেই উত্তপ্ত মিছিল পরিচালনা করে যখন আমরা কার্জন হলের দিকে আসছিলাম, তখন শাহবাগের কাছাকাছি একটি জায়গায় তখনকার ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক, মানিক ভাইয়ের দক্ষিণহস্ত ও বঙ্গবন্ধুর কলেজের সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু সিরাজুদ্দীন হোসেনকে সেখানে দেখতে পাই। সিরাজ ভাই হাত নেড়ে আমাদের উৎসাহ প্রদান করেন। সেদিনের সেই হাত নাড়া আমাদের আপ্লুত ও উজ্জীবিত তো করেছিলই, আজও এই জীবনসায়াহ্নে ওই ছোট্ট ঘটনাটি প্রচন্ড ভাবে দ্যুতি ছড়ায়, স্মৃতিকে আপ্লুত করে। যৌবনের আবেগ এতটাই প্রবল ও ভয়ঙ্কর ছিল যে, পুলিশের উদ্যত রাইফেলকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে শাহবাগ চত্বরে দাঁড়িয়ে মনু মিয়ার রক্তমাখা ওই গেঞ্জির পতাকা উঁচিয়ে ভীষণ উত্তেজিত মননে বক্তৃতা করি। সেই মুহূর্তগুলোতে মৃত্যু যেন কোনো আতঙ্কের বিষয় ছিল না, আলিঙ্গনের বিষয় ছিল। আজও যখন বিমুগ্ধ চিত্তে সেদিনের সেই অকুতোভয়, দুর্দমনীয় ও দুরন্ত সাহসিকতার কথা ভাবী, তখন প্রত্যয়দৃঢ় চিত্তে উপসংহারে উপনীত হই, হৃদয়ের কোনো জড়তা, ভয়ভীতি, গ্লানি আমাদের চিত্তকে বিচলিত, শঙ্কিত ও ভীতসন্ত্রস্ত করতে পারেনি বলেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একেকটি বিজয়ের মাধ্যমে একেকটি নতুন আন্দোলনের সোপান তৈরি করে বঙ্গবন্ধুকে আন্দোলনের প্রতীক বানিয়ে শুধু সম্মুখের দিকে ধেয়েই চলিনি, পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে অন্ধকার অমানিশার বক্ষ হতে ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলাম। আমি বলব, এই আন্দোলনের ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা এবং জনগণের দুঃসাহসিক ও মৃত্যুঞ্জয়ী আন্দোলনের অগ্রযাত্রা সব পৃথিবীর জন্যই একটি বিরল ও বিস্ময়কর ঘটনা। এ ব্রহ্মান্ডে দেশে দেশে বিপ্লব হয়েছে, বিপ্লবের সফলতাও এসেছে অকাতরে, যে সফলতার পূতপবিত্র ঘটনাসমূহ আজও বিশ^জোড়া মানুষের হৃদয়কে উদ্বেলিত করে, উজ্জীবিত করে, উৎসাহিত করে। কিন্তু আমি নিশ্চিত ও প্রত্যয়দৃঢ় চিত্তে বলতে চাই, পৃথিবীর অন্য কোনো আন্দোলন বা সফল বিপ্লবে জনগণের সম্পৃক্ততা এত ব্যাপক ছিল না। দেশে দেশে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে কিন্তু সর্বস্তরের মানুষের অংশীদারিত্ব বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি অবিস্মরণীয় এবং অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত। আদর্শ ও ভাবনার ভিন্নতা প্রচন্ড ভাবে থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার প্রশ্নে ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব বিনির্মাণে গোটা জাতি একটি অভিন্ন সত্তায় রূপ পরিগ্রহ করে। এখানে উল্লেখ করা আমার নৈতিক দায়িত্ব, ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন এবং সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর যে অতুলনীয় বিজয়, সে বিজয়ই স্বাধীনতার ম্যান্ডেট এনে দেয় এবং বঙ্গবন্ধুকেও কালজয়ী একক নেতৃত্বে প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম হয়। দুঃখ বা বেদনার ইতিবৃত্ত হিসেবে নয়, ’৭০-এর নির্বাচনটিতে অংশ নিতে ছাত্রলীগের গণতান্ত্রিক অংশের আমাকে এবং আমাদের যে দুরূহ, দুঃসহ ও বিস্ময়কর সফলতা এনে দেয়, তাই-ই স্বাধীনতার নিয়ামক শক্তি। আমাদের ছাত্রলীগের মধ্যে একটি প্রভাববলয়Ñ যারা সংখ্যায় ও শক্তিতে আমাদের চাইতেও সন্দেহাতীতভাবে বেশি শক্তিশালী ছিলেন, তারা ’৭০-এর নির্বাচনটিকে গ্রহণ করতে চাননি। বরং তাকে এটিকে একটি প্রহসন মনে করতেন। আমরা যারা নির্বাচনমুখী ছিলাম, তাদের কটাক্ষ করে তারা স্লোগান দিতেনÑ ‘মুক্তির একই পথ, সশস্ত্র বিপ্লব’, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘ভোটের কথা বলে যারা, ইয়াহিয়া খানের দালাল তারা’, ‘নির্বাচন নির্বাচন, বর্জন বর্জন’। স্বাধীনতার চেতনাকে সমগ্র জনতার মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়ার জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনের ম্যান্ডেট হিসেবেই ’৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনিবার্য ভেবেছিলাম। সেই ভাবনাটিকে প্রচন্ড সহিষ্ণুতার সঙ্গে যদি সফল করতে না পারতাম, তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন পথভ্রষ্ট হতো অথবা সম্পূর্ণভাবে আন্ডারগ্রাউন্ড অস্ত্রধারীদের হাতে চলে যেত। এই অমোঘ সত্যটি বঙ্গবন্ধুকেও বোঝাতে অনেক সময় আমার নিদারুণ বেগ পেতে হয়েছে। আমার বিপ্লবী বন্ধুদের বজ্রকণ্ঠের স্লোগানই তো ছিল- ‘ভোটের কথা বলে যারা, স্বাধীনতার শত্রু তারা’।

শুধু ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে বিপ্লবী বন্ধুরাই নন, সমগ্র বিশ্বে তখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তুলকালাম চলছিল। তার মধ্য থেকে গণতান্ত্রিক পথে হাঁটা ও ’৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সত্যি একটি দুরূহ ও দুঃসাধ্য কাজ ছিল। এত দিন পরে স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী অতিক্রম করার পরও সেই পুরনো ঘটনাগুলোকে দৃষ্টান্ত হিসেবে টেনে আনার বা উপস্থাপন করার একটিই উদ্দেশ্য। আর তা হলো- গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই এবং নির্বাচনই গণতন্ত্রের হৃদয়ে অমোঘ শক্তি। একে পাশ কাটানো, গণতন্ত্রের কথা বলে বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেশকে অভিহিত করে নির্বাচনের প্রশ্নে দ্বিধাদ্বন্দ্বে সংকুচিত থাকলে গণতন্ত্রের যথাযথ মূল্যায়ন করা যায় না। বাংলাদেশের গত নির্বাচন আমাকে সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছে, বাংলাদেশ বিরোধী দলের শক্তিবিবর্জিত বলেই নির্বাচনের আগের রাতে মহা-আনন্দে ৪০ ভাগ ব্যালটে সিল মেরে ব্যালটবাক্সে ঢুকিয়ে রেখে এবং সেই ব্যালটবাক্স নির্বাচনের ভোট গ্রহণের জন্য কেন্দ্রে নিয়ে আসা হলে সেটিকে পরখ করে দেখার মতো ন্যূনতম শক্তি বিরোধী দলের ছিল না। এই যে দৈন্য- এ দৈন্যই গত নির্বাচনকে প্রহসনে তো পরিণত করেছেই, দৃশ্যত বিশাল বিশাল বিজয়কে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধই করেনি, কলঙ্কিত করেছে। বিরোধী দল ন্যূনতম শক্তিশালী বা কার্যকর থাকলে কোনো দেশে কোনো অবস্থাতেই নির্বাচনে এরূপ দিনে ডাকাতি বা সমুদ্রচুরি সম্ভব হতো না। মাঠে-ময়দানে বাস্তবতাকে মোকাবিলা না করে ড্রইংরুমে বসে এক ধরনের লাল পানি পান করে জড়িত কণ্ঠে গণতন্ত্রের সপক্ষে প্রলাপ বকলে বা গণতন্ত্রের প্রতি অগাধ আস্থা ও প্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখালে গণতন্ত্র বিকলাঙ্গ হয়ে যায়, বিগত নির্বাচনে যেটির রূপ নিতে আমরা দেখেছি এবং তার খেসারত প্রতিনিয়তই আমাদের দিতে হচ্ছে। কষ্ট লাগে এখানেই- বাংলাদেশের গণতন্ত্র অর্জনে যে ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ পথ জাতিকে অতিক্রম করতে হয়েছে এবং সে পথে হাঁটতে গিয়ে গণতন্ত্র অর্জনে অনেক নির্যাতন-নিগ্রহের শিকার হয়ে বিস্তীর্ণ ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাধ্যমে এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রকে অর্জন করেছে, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সেই গণতন্ত্রকেই সুতীক্ষè ক্ষুরধার অস্ত্রের চাইতেও অধিক কার্যকর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। কার্যত সেই অস্ত্রটিই আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। শাসনতন্ত্রে মৌলিক অধিকার ও গণতন্ত্র সম্পর্কে যা-ই লিখিত থাকুক না কেন, বাস্তবে তা আজ কেবল নিষ্ঠুর উপহাস। এ যেন হীরা-মণি-মুক্তা খচিত অলঙ্কারটিকে সুকৌশলে সরিয়ে দিয়ে ইমিটেশন এবং শুধুই ইমিটেশনে ভরা চোখ-ধাঁধানো, লোকঠকানো মেকি ও কৃত্রিম আয়োজন।

সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল অথবা তারও পরবর্তীকালে হবস, লক, রুশো এমনকি বার্ট্রান্ড রাসেল ও হ্যারল্ড জি লাস্কি বেঁচে থাকলে কেউই বাংলাদেশের বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক হিসেবে স্বীকার করতেন না। গণতন্ত্রের ওপর বিশেষজ্ঞ ওইসব কালজয়ী ব্যক্তিত্বের অমোঘ উচ্চারণ হলো- গণতন্ত্রে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে এবং গণতন্ত্র কোনো বিমূঢ় মূর্তি নয়। গণতন্ত্রের মূল উপাদান হলো মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দেশের জনগণকে তার ব্যবহারের উন্মুক্ত সুযোগ দিতে হবে। গণতান্ত্রিক দেশ বলে চাপিয়ে দেওয়া বাংলাদেশে মৌলিক অধিকারবঞ্চিত মানুষকে খুন-গুম ও পুলিশি অত্যাচারের যেভাবে অহরহ শিকার হতে দেখা যায়, তাতে সহজেই প্রতীয়মান হয়, কিতাবি আইন প্রয়োগে নেই। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলতে পারে না। শুধু কাগজে-কলমেই আইন সবার জন্য সমান, এটি আদৌ বাস্তবে নয়। সমাজের প্রভাবশালী বিত্তবান ও রাজনৈতিক ক্ষমতাধররা আজকাল আইনকে তাদের ইচ্ছামতো ব্যবহারের অবাধ সুযোগের অধিকার ভোগ করেন এবং এ সুযোগের যথেচ্ছ ব্যবহারও তারা করেন।

এ দেশে যারা সাধারণ মানুষ, যারা ‘আকালু শেখ’ তারা দেশের জনসংখ্যার তালিকাতেই কেবল অন্তর্ভুক্ত। নাগরিক অধিকার ভোগের তেমন সুযোগ তাদের নেই। ক্ষমতাসীনদের প্রভাব আর অধিকারবঞ্চিতদের দীনতাÑ দুইয়ে মিলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে অসহায় করে তুলেছে। আফসোস! উন্নত দেশের নাগরিকদের মতো এখন আমাদের নির্ভীক চিত্তে মাথা তুলে মেরুদ- খাড়া করে সম্মুখপানে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাস্তব চিত্রটা সত্যিই ভিন্ন। সময় থেমে নেই। শুধু আইনই তার শক্তি ও প্রয়োগের সুযোগ হারাচ্ছে। আমাদের অবশ্যই এই দুঃসহ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে স্থিরপ্রত্যয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- অঘোষিত স্বৈরাচার মেনে নেওয়াও যায় না, চলতে দেওয়াও না। সামাজিকভাবে এর মোকাবিলা করতে হলে দলমতনির্বিশেষে সবাইকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ছাড়া অন্যায়কে রোখা যায় না। নতুন প্রজন্মের উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত প্রাণ- তারাই রাষ্ট্র ও সমাজের এই দুর্বিষহ মুহূর্তে অনির্বাণ আলোর মশাল জ্বালতে পারে। মাদকাসক্তি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, স্থবিরতার গ্লানি মুছে ফেলে সত্য ও সুন্দরের সূর্যস্নাত হৃদয়ে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে জীবন্ত প্রতিবাদ হিসেবে তরুণ তাজা দীপ্ত প্রাণ আজও সমাজকে উজ্জীবিত করার ক্ষমতা রাখে। এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজ এবং আমাদের মতো যারা জীবনসায়াহ্নে, তারা জাগ্রত হোক, উদ্দীপ্ত হোক, উজ্জীবিত হোক। সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদেরই কণ্ঠে উচ্চারিত হোক- ‘না’। তারুণ্যের কণ্ঠে উচ্চারিত এই বিস্ময়কর ‘না’ই জাতিকে সব অবক্ষয় ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে এনে দিতে পারে।

যে প্রক্রিয়ায় দেশের অর্থনীতি চলছে, তাকে হ-য-ব-র-ল বললেও যথেষ্ট হবে না। এ যেন এমন একটা গাড়ি চলছে, যার কোনো ব্রেক নেই। প্রয়োজনে ব্রেক দাবাতে দাবাতে হয়তো একপর্যায়ে এসে কার্যকর হবে। এর মধ্যে দুর্ঘটনাসমূহ ভাগ্য ছাড়া আর কারও নিয়ন্ত্রণে থাকে না, থাকবেও না। এই ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা তৈরি করা সোনার পাথরবাটির মতোই স্ববিরোধী অলীক এবং কল্পনাপ্রসূত। ব্রিটিশ আমলে কোনো কোনো ব্যাংকে যখন লালবাত্তি জ্বলত, তখন অনেক বর্ধিষ্ণু ব্যক্তি রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে যেত। এখন অনেকের আশঙ্কা, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তো বটেই, কবে না বাংলাদেশ ব্যাংক লালবাত্তি জ্বালিয়ে দেয়। এই দুঃসহ ও অসহনীয় আশঙ্কা নিয়ে দেশের অথনৈতিক কর্মকান্ড চলছে।

যুগে যুগে কালে কালে পৃথিবীর ইতিহাসে যত বিবর্তন ও কল্যাণমুখী পরিবর্তনÑ এর সবই এসেছে তারুণ্যের হাত ধরে। সমাজের যত আবর্জনা, অন্যায়, দুর্নীতি ও দুর্বিচার- সবকিছুর বিরুদ্ধে যুগে যুগে কালে কালে এ তারুণ্যই রুখে দাঁড়িয়েছে এবং সমাজের সব স্তরের মানুষকে উজ্জীবিত করেছে সমাজটাকে বদলে দেওয়ার সামাজিক আন্দোলনে।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর