শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

কোরবানির মাসায়েল ও পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব

মুফতি মিজানুর রহমান সিনিয়র পেশ ইমাম : বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

কোরবানি একটি আরবি শব্দ। অর্থ ত্যাগ, উৎসর্গ, বিসর্জন, নৈকট্যলাভ ইত্যাদি। ইসলামের পরিভাষায় জিলহজের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত সময়ের পরিসরে আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে বিশেষ কিছু পশু জবাইকে কোরবানি বলে। আমরা যদি কোরবানির উৎসমূলের দিকে তাকাই তাহলে এর নিগূঢ় তত্ত্ব, গভীর মর্ম বুঝতে পারব। মূলত আমরা আজ যে কোরবানি করছি এটা স্থূল দৃষ্টিতে সাধারণ পশু কোরবানি হলেও এটা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আপন পুত্র বিসর্জনের স্থলাভিষিক্ত। শুধুই কি পুত্র বিসর্জন, বরং নবী ইবরাহিম ও শিশু ইসমাইল (আ.)-এর ইলাহি-প্রেমের এক অপূর্ব নিদর্শন। যার ফলে তারা পেয়েছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশাল পুরস্কার। এ পুরস্কার পেতে হলে আমাদের পশু কোরবানির মধ্যেও থাকতে হবে ইবরাহিমি চেতনার পরশ ও ইসমাইলি ত্যাগের সুবাস। কোরবানি-সংক্রান্ত কিছু জরুরি মাসায়েল আমাদের জেনে রাখা দরকার। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি পশু শুধু এক ব্যক্তি কোরবানি দিতে পারবে। গরু, মহিষ, উট সর্বোচ্চ সাত ব্যক্তি মিলে কোরবানি দিতে পারবে। অনেকে মনে করে, কোরবানির পশুতে একাধিক শরিক থাকলে অংশ নির্ধারণ করতে হবে বেজোড় সংখ্যা হিসেবে। শরিক হতে হবে তিনজন, পাঁচজন বা সাতজন। এ ধারণা ঠিক নয়। সঠিক বিষয় হচ্ছে, এক থেকে সাত পর্যন্ত যে কোনো অংশে পশুটিকে ভাগ করা যাবে। তাই দুজন, তিনজন, চারজন, পাঁচজন, ছয়জন ও সাতজন মিলে একটি পশু কোরবানি দিতে পারবে। একাধিক শরিক থাকলে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, অংশ হিসেবে ভাগ যেন যথার্থ হয়। প্রাপ্য অংশের চেয়ে কেউ যেন কম বা বেশি না পায়। আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, কারও যেন নিয়তে গরমিল না থাকে। কোনো অংশীদারের যদি শুধু মাংস খাওয়া উদ্দেশ্য হয় তাহলে কারও কোরবানি হবে না। এজন্য কোরবানি শুদ্ধ হওয়ার জন্য সবার নিয়ত শুদ্ধ হওয়া জরুরি।

কোরবানির পশুর মাংস তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিব মানুষকে, এক ভাগ আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীকে দেবে ও বাকি এক ভাগ নিজে খাবে। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী মাংস নিতে আসবেÑ এ অপেক্ষা না করে নিজ দায়িত্বে তাদের ঘরে মাংস পৌঁছে দেওয়া উচিত। যদি একাধিক শরিক থাকে তাহলে মাংস ভাগ করবে ওজন করে। অনুমান বা আন্দাজ করে নয়। কারণ, অনুমান করে ভাগ করলে বেশকম হতে পারে, যা গুনাহের কারণ। যে কসাই মাংস তৈরি করে দেবে তাকে আলাদাভাবে কাজের মজুরি দিতে হবে। মজুরি হিসেবে কোরবানির মাংস দেওয়া জায়েজ নেই। তার প্রাপ্য মজুরি দেওয়ার পর ইচ্ছা করলে তাকে কোরবানির মাংসও দেওয়া যাবে।

কোরবানির সঙ্গে আকিকা দেওয়া যায়। এতে কোনো সমস্যা নেই। কোরবানির মাংসের মতো আকিকার মাংসও নিজে খেতে পারবে, অন্যকে খাওয়াতে পারবে, দিতেও পারবে। ছেলের আকিকা হলে দুটি ছাগল অথবা গরুতে দুই শরিক এবং মেয়ের আকিকা হলে একটি ছাগল অথবা গরুতে এক শরিক দিতে হবে। যেমন একটি হাদিসে এসেছে, হজরত আমর ইবনে শোয়াইব (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যার সন্তান হয় সে যদি চায় আকিকা দিতে, তাহলে ছেলেসন্তান হলে দুটি ছাগল এবং মেয়েসন্তান হলে একটি ছাগল আকিকা দেবে।’ একটি ভুল ধারণার অবসান হওয়া উচিত। কেউ মনে করতে পারে, এখানে মেয়েসন্তান হলে মাত্র একটি ছাগল দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর ছেলে হলে দুটি। এতে ছেলের মর্যাদা বেশি দেওয়া হয়েছে। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কোনোভাবেই ছেলের মর্যাদা বেশি দেওয়া হয়নি। কারণ, আকিকা দেওয়া হয় সন্তানের ওপর থেকে বিপদাপদ যেন দূর হয়ে যায় এই উদ্দেশ্যে। সাধারণত ছেলেসন্তানের ওপর বিপদাপদ বেশি আসে এবং মেয়েসন্তানের ওপর কম আসে। তাই ইসলাম ছেলের জন্য দুই এবং মেয়ের জন্য একটি ছাগল আকিকা দিতে বলেছে। জবাই করার আগে পশুকে ঘাস, পানি ইত্যাদি ভালোভাবে খাওয়াতে হবে। কোরবানির প্রাণীকে ক্ষুধার্ত বা পিপাসার্ত রাখা অন্যায়।

কোরবানি করার আগে, কোরবানি করার সময় এবং পরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। ইসলাম সব সময় সুন্দর, পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি জীবন -যাপনের প্রতি নির্দেশনা দেয় আর অপরিচ্ছন্নতা, অশ্লীলতা ও অপরিপাটি জীবনকে বর্জনের শিক্ষা দেয়। আল কোরআনে আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন, ‘তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখো, অপবিত্রতা হতে দূরে থাকো।’ সূরা আল মুদ্দাসসির, আয়াত ৪-৫। পোশাক-পরিচ্ছদের পাশাপাশি ব্যবহার্য অন্যান্য সামগ্রী ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখাও দরকার। পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার জন্যই রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘পানির ঘাটে, রাস্তার মাঝে, বৃক্ষের ছায়ায় মলত্যাগ হতে বিরত থাকবে।’ বর্তমানে দেশের প্রায় সবখানেই এডিস মশার উপদ্রব বিধায় প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর একটি প্রধান কারণ জলাবদ্ধতা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের চলাচলের রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব বলে ঘোষণা করেছেন। তাই কোরবানির মতো এমন মহান ইবাদত করতে গিয়ে আমাদের অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্নতার কারণে যেন কেউ কষ্ট না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

সর্বশেষ খবর