দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক দখল করার পর বিজেপি তথা গেরুয়া বাহিনী আর কোনো রাখঢাক না করেই বলছে আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে তারা মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, পন্ডিচেরি- এ চারটি রাজ্য দখল করে নেবে। বিপুল অর্থের বিনিময়ে গেরুয়া বাহিনী তাদের স্বপ্ন এক জাতি, এক দল, এক ভাষা- এ পথে এগোচ্ছে। ১৪ মাস আগে কর্ণাটক কংগ্রেস ও জনতা দল সেক্যুলার কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। কর্ণাটকে তারা ১৬ জন জনতা দল সেক্যুলারের বিধায়ককে কিনে নেয়। শুধু কিনেই নেয়নি, চার্টার্ড বিমান ভাড়া করে মুম্বাইর একটি পাঁচতারা হোটেলে তাদের রেখে দিয়েছিল। বিদায়ী ভাষণে বিধানসভায় জনতা দল সেক্যুলারের মুখ্যমন্ত্রী কুমারেশস্বামী অভিযোগ করেছেন, কংগ্রেস ও তার দলের ১৬ জন বিধায়ককে কেনার জন্য বিজেপি খরচ করেছে প্রতি বিধায়কের জন্য ৫ থেকে ২০ কোটি টাকা। পরিস্থিতি দেখে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঈদের আগে রামগঞ্জে পশু বিক্রির হাট বসে। ভারতেও এখন নির্ধারিত বিধায়ক, সংসদ, পৌরসভা প্রভৃতি সংস্থা থেকে তারা কেনাবেচা করে সরকার গঠন করছে। কর্ণাটকে বিগত শতকের শেষভাগে আরেকবার এ ধরনের কেনাবেচা হয়েছিল। সেবার বিধায়কদের নিয়ে সরাসরি রাখা হয়েছিল মরিশাসে। সেবারও বিজেপি নেতা ছিল ৭৫ বছর বয়স্ক ইয়েদুরাপ্পা, এবারও তার হাত দিয়েই কেনাবেচা করেন মোদি-অমিত শাহরা। সে সময় অটল বিহারি বাজপেয়ি আর লালকৃষ্ণ আদভানি ইয়েদুরাপ্পাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। ১৪ মাস আগে নির্বাচনের সময় তাকে আবার দলে ফিরিয়ে আনা হয়, তার বিরুদ্ধে ছিল ভূরি ভূরি দুর্নীতির অভিযোগ। কর্ণাটকে বিজেপি পরিচালনা করেন ওই দেশের কোটি কোটি টাকার মালিক মাইনিক ব্যরন। দিল্লির রাজনৈতিক মহলের দৃঢ়বিশ্বাস, তারা করেছিল কংগ্রেসমুক্ত ভারত, আর দ্বিতীয় ইনিংসে তারা শুরু করছে বিরোধীমুক্ত ভারত। প্রধানমন্ত্রী মোদি ও অমিত শাহের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইতিমধ্যে তারা তেলেঙ্গানায় বিরোধী দলের ৪০ জন সদস্যকে কিনেছেন, গোয়ায় কংগ্রেসের মোট সদস্যসংখ্যা ১৫। এর মধ্যে ১০ জনকে কিনে নিয়েছেন। সংসদের উচ্চকক্ষে বিজেপি সংখ্যালঘু ছিল। গত দুই মাসে অন্ধ্রে তেলেগুদেশম পার্টির চার সদস্যের মধ্যে দুজনকে কিনে নিয়েছেন। উত্তর প্রদেশে বহুজন সমাজবাদী পার্টির চার সদস্যের মধ্যে দুজনকে কিনেছেন। ঠিক একইভাবে উত্তর প্রদেশের আরেকটি আঞ্চলিক দল সমাজবাদী পার্টির দুজনকে কিনেছেন। সব মিলিয়ে জনবিরোধী সব আইন পাস করানোর জন্য রাজ্যসভায় বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে, তারা মোদি সরকারের সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন মানুষকে ঢুকতে বাধা দিচ্ছেন। আট মন্ত্রণালয় তো পুরো নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। শুরুতেই তারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়েছেন, ড. মনমোহন সিংয়ের আমলে আরটিআই (তথ্য জানার অধিকার) আইনটিকে সংশোধন করে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না। বিরোধীরা চেয়েছিল বিলটি সংসদের সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হোক, মোদি তাতে কর্ণপাত করেননি। এত গেল দেশের অভ্যন্তরের অবস্থা। এবার দেখা যাক মোদি সরকারের পররাষ্ট্রনীতি। কিছুদিন আগে মোদি তার বন্ধু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলে এসেছেন, আমি চাই কাশ্মীরের ব্যাপারে আপনি মধ্যস্থতা করুন। মোদি হয়তো জানেন না বা তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঝানু কূটনীতিক তাকে জানাননি, ১৯৭২ সালে শিমলায় ইন্দিরা গান্ধী ও ভুট্টোর মধ্যে চুক্তি হয় যা শিমলা চুক্তি নামে পরিচিত। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, কাশ্মীরসহ ভারত-পাকিস্তান যাবতীয় সমস্যা দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলোচনার মাধ্যমে মেটাতে হবে। তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার কোনো প্রয়োজন নেই। সুতরাং কাশ্মীর একটি দ্বিপক্ষীয় বিষয়। সাম্প্রতিককালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ওয়াশিংটনে গেলে ট্রাম্প ইমরানকে বলেন, মোদি চান আমেরিকা কাশ্মীর সমস্যার মধ্যস্থতা করুক। তাদের এই কথোপকথন ভাইরাল হয়ে গেলে অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিবিদরা প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে বলেন, মোদির একটু পূর্বসূরিদের সিদ্ধান্তগুলো পড়াশোনা করা উচিত ছিল। একাধিক কূটনীতিবিদ ঠাট্টার সুরে বলেন, বিদেশে গিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে কোলাকুলি করলেই সব সমস্যার মীমাংসা হয় না।
নাম বলতে অনিচ্ছুক একাধিক কূটনীতিক সরাসরি মোদিকে আক্রমণ করে অভিযোগ করেন, ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তি তিনি না জানতে পারেন; কিন্তু তার বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর তো একজন ঝানু কূটনীতিক, তিনি কী করছিলেন। আর একজন কূটনীতিবিদ সরাসরি বলেন, ১৯৭২ সালে যুবক মোদি আমেরিকার বিভিন্ন শহরে আরএসএসের প্রচারক হিসেবে সে দেশের বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে বেড়িয়েছেন। ২০১৪ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি যখন আমেরিকা যান, তখন নিউইয়র্ক শহরে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল গুজরাটি, আফ্রিকান ও আমেরিকায় বসবাসকারী ব্যবসায়ীরা। আফ্রিকার দেশগুলো স্বাধীন হওয়ার পর সে দেশের লাখ লাখ আফ্রিকান গিয়ে আশ্রয় নেয় আমেরিকায়। ট্রাম্পকে জেতানোর জন্য এই আফ্রিকান ব্যবসায়ীরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিল। আমেরিকায় তাদের একটি সংগঠন আছে, তার নাম হিন্দু-আমেরিকান ফাউন্ডেশন (এইচএএফ)। এরা ট্রাম্পের খুব ঘনিষ্ঠ। এ সংস্থার সুপারিশে সম্প্রতি ১৯ জুলাই বাংলাদেশের প্রিয়া সাহা আমেরিকা সফরের আমন্ত্রণ পান। প্রিয়া জানতেন না ট্রাম্পের পূর্বসূরি নিক্সন বাংলাদেশে গণহত্যার সময় পাকিস্তানকে সাহায্য করেছেন এবং গণহত্যাকে সমর্থন করেছেন। কাজেই তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে ট্রাম্পের কাছে নালিশ জানিয়েছেন তাতে বাংলাদেশ সরকার খুব একটা আমল দেয়নি। তবে প্রিয়া সাহারও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার দরকার ছিল, তা তিনি নেননি। তিনি মোদির কায়দায় হোয়াইট হাউসে গিয়ে বক্তব্য তুলে ধরেছেন। হয়তো তিনি জানতেন না বা বুঝতে পারেননি যে, তাকে আরএসএস ব্যবহার করছে। হিন্দু-আমেরিকান ফাউন্ডেশনের সুপারিশেই আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রিয়া সাহাকে আমেরিকায় পাঠানোর জন্য ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিরোধী দলগুলো বিশেষ করে কংগ্রেস দল গণতন্ত্র, সংবিধান বিপন্ন তা জেনে-বুঝেও এখন অভিভাবকহীন। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে ভারত যে দাবি করে আসছিল, তা এখন আর নেই। কারণ, ভারত এখন একদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। মোদির কণ্ঠে শান্তির বাণী এখন কবির ভাষায় ‘ব্যর্থ পরিহাস’ ছাড়া আর কিছুই নয়। সুতরাং ভারত এখন কপট রাজনীতির উত্তাল সমুদ্রে দিশাহীন জাহাজ।
লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।