সোমবার, ৫ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

হজের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও আমাদের করণীয়

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

হজের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও আমাদের করণীয়

পবিত্র হজ আবেগময় একটি মৌলিক ইবাদত। এর রয়েছে ঐতিহাসিক তাৎপর্য। পবিত্র হজ আদায়ের সময়ে পবিত্র ভূমিতে ঘটে যাওয়া সেসব ঐতিহাসিক স্মৃতি এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অবদানের কথা হৃদয়ে জাগ্রত হলে এবং তাঁর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অনুধাবন করতে পারলে প্রত্যেক হাজীর মানসপটে ভেসে উঠবে আল্লাহ প্রেমের অনুপম এক আবেগ। উজ্জীবিত হয়ে উঠবে ইমান ও আমলের জযবা। মৌলিকভাবে পবিত্র মক্কা-মদিনায় কদম রাখার সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ে যায় ধু-ধু বালির এই মরুভূমিতে বাড়িঘর তো দূরের কথা, ছিল না কোনো জনমানুষের চিহ্নও। তাফসিরে ইবনে কাছির নামক কিতাবে রয়েছে। হজরত ইবরাহিম আলাইহে ওয়াসাল্লাম প্রিয় সহধর্মিণী পুণ্যময়ী নারী হজরত হাজেরা (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে এলেন মক্কার এ জনমানবহীন ভূমিতে। সঙ্গে রয়েছে দুগ্ধপোষ্য শিশু হজরত ইসমাঈল (আ.)। তাদের রেখে বিদায় নিতে চললেন। বিবি হাজেরা (আ.) বললেন, আপনি কি আমাদের এখানে এভাবে একা একা রেখে যাচ্ছেন আল্লাহরই নির্দেশে? তিনি বললেন, হ্যাঁ ‘অবশ্যই’। হজরত হাজেরা (আ.) বললেন, ‘তাহলে নিশ্চয়ই তিনি আমাদেরকে বিপদের মধ্যে ফেলে দেবেন না (কারণ তিনিইতো আমাদের আসল জিম্মাদার)’ এদিকে হজরত ইবরাহিম আলাইহে ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দরবারে আবেদন করছেন, পবিত্র কোরআনে এভাবে ইরশাদ হয়েছে। ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমি আমার পরিবার-পরিজনকে এমন একটি প্রান্তরে রেখে এলাম, যেথায় নেই কোনো ফসলাদির চিহ্ন, আপনার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে, এ জন্য যে, তারা যেন তথায় সালাত কায়েম রাখে। হে আমাদের পালনকর্তা! কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করুন। আর তাদের ফল ফসলাদির রিজিক প্রদান করুন, যাতে করে তারা আপনার শোকর গুজার হতে পারে’। (সূরা ইবরাহিম : ৩৭)। সেদিন হজরত হাজেরা (আ.)-এর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় তাঁর সাফা-মারওয়ায় পানির তালাশে ছোটাছুটিতে মহান রব্বুল আলামিন প্রবাহিত করে দিলেন জমজমের ফোয়ারা। সে জমজম থেকেই আজকে আমরা পানি পান করছি। পবিত্র হজ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় শিশু হজরত ইসমাইল (আ.)-এর কোরবানির ইতিহাস। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর ইস্পাত কঠিন সিদ্ধান্তের কাছে ইবলিস শয়তান সেদিন কঠিনভাবে পরাজিত ও লাঞ্ছিত হয়ে পশ্চাদাবন করতে বাধ্য হয়েছিল। হজরত ইবরাহিম (আ.) শয়তানকে দূর করার জন্য বারবার কংকর মেরেছিলেন। এই কংকর নিক্ষেপ ও কোরবানির ঘটনাকে পবিত্র হজের জরুরি বিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। হজ আরও স্মরণ করিয়ে দেয় পবিত্র বাইতুল্লাহ শরিফের নির্মাণের ইতিহাস। সেই সময় পিতা-পুত্র প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম করে নির্মাণ করছেন আল্লাহর ঘর। আর প্রভুর কাছে আবেদন জানালেন, হে প্রভু! আমাদের এ প্রচেষ্টা কবুল করুন। আল্লাহ কবুল করলেন এবং নির্দেশ দিলেন ইবরাহিম (আ.)-কে এ পবিত্র ঘরে হজ আদায়ের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর প্রিয় বান্দারা ছুটে যাবে দুনিয়ার সব প্রান্ত থেকে সে ঘরের দিকে। প্রিয় পাঠক! আরও দেখুন, এ ঘরকে এবং পবিত্র ভূমিকে ঘিরে রয়েছে আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জন্মের ইতিহাস। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনায় হিজরতের কথা। মদিনা থেকে ৮ বছর পর পুনরায় বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলেন তিনি তাঁর জন্মভূমিতে। তিনি হজ করলেন, উম্মতদের হজের নির্দেশ শুনিয়ে দিলেন। সেই থেকে শুরু হলো এ উম্মতের হজ প্রক্রিয়া, যার ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে। ইনশা আল্লাহ কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। প্রিয় পাঠক! হাজী সাহেবরা যখন মক্কা-মদিনায় হজ করতে যান তখন এমন অনুভূতি আর ইতিহাস মনে রেখেই হজ করা উচিত। যাদের আল্লাহতায়ালা তৌফিক দিয়েছেন তারা অনেকেই ইতিমধ্যে হজ আদায় করতে পবিত্র ভূমিতে পৌঁছে গেছেন বা সহসাই পৌঁছে যাবেন। হজের দিনগুলোতে হাজী সাহেবান তাওয়াফ, সাই, মিনা, মুজদালেফা, আরাফাতে অবস্থান, মিনায় কংকর নিক্ষেপ, কোরবানি ইত্যাদি বহুবিধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফজিলতের আমলসমূহে সদা ব্যস্ত থাকবেন। আমরা যারা হজের মতো গুরুত্বপূর্ণ আমলে শরিক হতে পারিনি আমাদের জন্য কিছু নেক আমল রয়েছে। প্রথমত, ১০ জিলহজ কোরবানির ঈদের দিন হাজী সাহেবরা যেমন কোরবানি আদায় করবেন, আমাদের মধ্য  থেকে যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব হাজী সাহেবদের মতো শরিয়ত তাদের জন্যও কোরবানি করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের আমলকে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সূরা আল ফজরে ইরশাদ হয়েছে, ‘ওয়া লায়ালিন আশর’, অর্থাৎ দশটি রাত বলতে জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিন বুঝানো হয়েছে বলে মুফাসসিরীনে কেরামদের মতামত পাওয়া যায়। এই ১০ দিনের মধ্যে আবার রয়েছে আরাফার দিন ৯ জিলহজ। যা মর্যাদার দিক থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ‘সেদিন আল্লাহ যত লোককে মাফ করে দিয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তিদান করেন, তা আর কোনোদিন ঘটে না’। (মুসলিম শরিফ)। এই ১০ দিন বেশি বেশি সালাত আদায়, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, ইস্তেগফার, দোয়া ও দরুদ ইত্যাদির মাধ্যমে কাটানো উচিত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের রোজা (ঈদের দিন ছাড়া) রাখা কখনো ছাড়েননি। (আহমদ, নাসায়ী)। মহান রব্বুল আলামিনের দরবারে দোয়া করি তিনি যেন আমাদের সব মুসলিম ভাই বোনকে পবিত্র হজের ঐতিহাসিক তাৎপর্য উপলব্ধি করে হজ আদায় করার তৌফিক দান করেন। আমিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও টিভি উপস্থাপক।

সর্বশেষ খবর