বুধবার, ৭ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

এডিস মশা থেকে রেহাই পেতে

প্রফেসর ড. তাহসিন ফারজানা

সম্প্রতি ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুহার বৃদ্ধির এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে একজন মশা গবেষক হিসেবে পেশাগত দায়িত্ববোধ থেকেই লিখছি। জাপানের কানাজাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সময় এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি, বায়োলজি ও ইকোলজি আমার গবেষণার মূল বিষয়বস্তু ছিল। এডিস এজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস দুই প্রজাতির মশা নিয়েই আমি কাজ করেছি। এডিস মশার বৃদ্ধির ওপর বৈশ্বিক উষ্ণতার তথা তাপমাত্রা ও খাদ্যের প্রভাব; এডিস এজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস দুই প্রজাতির একসঙ্গে বেড়ে ওঠার প্রভাব নিয়ে আমি বিস্তারিত গবেষণা করেছি। এ ছাড়া এডিস মশা একাধিকবার রক্ত খায় (Multiple blood feeding)  কিনা ও একাধিকবার পোষক খোঁজে (Host seeking) কিনা-  এ বিষয়গুলোও আমার কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ওই পরীক্ষাগুলো করার জন্য মশাগুলো -কে আমার নিজের হাতের রক্ত খাওয়াতে হয়েছে। অবশ্য এর কারণও ছিল। নিজের হাতের রক্ত খেতে দিলে ঠিকমতো নিরীক্ষণ করা যায় ওরা কত সময় নিয়ে কতটুকু রক্ত খায় এবং রক্ত খাওয়া শেষ হলে আরও পোষকের খোঁজ করে কিনা। এ কাজে আমাকে সহযোগিতা করেছেন আমার পিএইচডি সুপারভাইজার প্রফেসর ড. নোবোকো সুনো। অনেক দিন আমরা দুজন একসঙ্গে মশাকে রক্ত খাইয়েছি। উল্লেখ্য, মশাগুলো গবেষণাগারে আমিই উৎপাদন করেছি এবং এরা সংক্রমণমুক্ত ছিল।

ঢাকাসহ সারা দেশে বিপজ্জনক হারে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে নতুন নতুন রোগী। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত করা গেলেও এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর কারণ, এ বছর বৃষ্টিপাত একটু আগেই শুরু হওয়ায় হঠাৎ করে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার প্রজনন বেড়ে গেছে। আমরা সবাই জানি, এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু ছড়ায়। এডিস এজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস নামক মশার দুটি প্রজাতি ডেঙ্গু রোগের বাহক। এর মধ্যে এডিস এজিপ্টি হলো প্রাইমারি ভেক্টর বা প্রধান বাহক। অন্যদিকে এডিস এলবোপিকটাস হলো দ্বিতীয় প্রধান বাহক। এডিস এজিপ্টিকে বলা হয় গৃহপালিত মশা। এরা সাধারণত ঘরের ভিতর, বারান্দা বা ছাদে ফুলের টব, জমানো পানির পাত্র, গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার, নির্মাণাধীন বাড়ির পাশে রাখা চৌবাচ্চা বা ড্রাম, কনডেন্সড মিল্কের কৌটো, নারিকেলের খোল ইত্যাদি মানুষের তৈরি কৃত্রিম পানির পাত্রে বংশ বৃদ্ধি করে।

এদের শহরের মশাও বলে। সাধারণত বদ্ধ পরিষ্কার পানি এডিস মশার প্রজননস্থান। তবে এডিস মশা সরাসরি পানিতে ডিম পাড়ে না। পানির স্পর্শ থাকে এ রকম জায়গায় অর্থাৎ পানির পাত্রের গায়ের ভেজা অংশে বা পানিতে ভাসমান পাতায় এডিস মশা ডিম পাড়ে। এ ডিমগুলো শুকনা অবস্থায় ছয় থেকে নয় মাস বেঁচে থাকতে পারে (এমনকি বিজ্ঞানীরা সর্বোচ্চ পাঁচ বছর এদের ডিমের বেঁচে থাকার প্রমাণ পেয়েছেন)। পরে পানির স্পর্শে ডিম ফুটে লার্ভা বের হয় এবং স্বচ্ছ পানিতে বৃদ্ধি লাভ করে। সাধারণত দেখা যায়, কোনো বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এডিস মশা যেসব পাত্র/স্থানে ডিম দেয় পরবর্তী বছরের এপ্রিল-মের বৃষ্টিপাতে সেসব পাত্র/স্থানে পানির ওভারফ্লো বা আধিক্য হলে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। এজন্য প্রতি বছর এপ্রিল-মে মাসে বৃষ্টি শুরু হলে মশার যে প্রজন্ম তৈরি হয় সেগুলো জুন-জুলাইয়ে ডেঙ্গু ছড়ায়। এ বছর ফেব্রুয়ারিতেই বৃষ্টিপাত হওয়ার দরুন একটু আগেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।

এডিস মশার লার্ভা সাধারণত ঘোলা বা অপরিষ্কার পানিতে বাঁচতে পারে না। কারণ, নোংরা পানিতে অতিরিক্ত মেটাবলাইটস জমা হয় এবং পানির উপরিভাগে একটি স্তর পড়ার দরুন লার্ভা বা পিউপা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। এডিস মশা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সর্বনিম্ন ৭ থেকে ১০ দিনে জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে। পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এডিস মশার বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। যদিও ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও তার ওপরের তাপমাত্রায় এডিস মশার বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং মৃত্যুহার বেড়ে যায়। কম তাপমাত্রায় বড় আকারের মশা জন্ম নেয় এবং বেশি তাপমাত্রায় ছোট আকারের মশা জন্ম নেয়। এই ছোট আকারের মশাগুলো তার প্রজনন চাহিদা পূরণে একাধিকবার রক্ত গ্রহণ (Multiple blood feeding) করে; যার ফলে ছোট আকারের মশাগুলো জীবাণু দ্বারা অধিক সংক্রমিত হয়।

পুরুষ মশা রক্ত খায় না, এরা সাধারণত ফুল ও ফলের রস বা যে কোনো শর্করার উৎস থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। স্ত্রী মশাও পুরুষ মশার মতো ফুল-ফলের রস বা শর্করার উৎস থেকে খাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। তবে স্ত্রী মশা তার ডিমের ক্রমবিকাশের জন্য রক্ত খায়। এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। এরা সূর্যোদয়ের দুই ঘণ্টা পর এবং সূর্যাস্তের কয়েক ঘণ্টা আগে বেশি সচল থাকে। এ ছাড়া এরা উজ্জ্বল আলোয় রাতেও কামড়াতে পারে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি ও বিস্তার রোধ করতে হবে এবং মশা যেন কামড়াতে না পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এডিস মশা নিধনের জন্য সমন্বিত মশা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণে দুটি দিক অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।

এক. মশার প্রজনন স্থানসমূহ ধ্বংস করতে হবে এবং দুই. পাশাপাশি বয়স্ক মশা নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মশার প্রজনন স্থানসমূহ ধ্বংস করতে হলে বাড়িতে ও আশপাশে বদ্ধ বা জমানো পানির পাত্র দু-এক দিন পরপর পরিষ্কার করতে হবে। ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোল, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। প্রয়োজনে লার্ভানাশক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। অন্যদিকে বয়স্ক মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু রাস্তায় ফগিং বা ধোঁয়া ছড়ালে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হবে না। কারণ এডিস মশা সাধারণত ঘরের ভিতর জন্ম নেয় এবং বিশ্রাম নেয়। তাই ঘরের ভিতরে স্প্রে করতে হবে যাতে ঘরের ভিতরের মশা মারা যায়।

দেশের এই দুর্যোগময় সময়ে ঘরের ভিতরে ও বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনবোধে বিশেষ ফোর্সের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, প্যারাসাইটোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর