শনিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি

বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণে আছে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন। পরদিন (৪ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মোতাবেক ১ হাজার ৮৭০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ রেকর্ড। এ তথ্য থেকে একটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত (৫ আগস্ট, ২০১৯) ‘মশা কি মন্ত্রীর কথা শোনে?’ শিরোনামে মন্তব্যটি যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে। এডিস মশা তো দূরের কথা, ডেঙ্গুও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথা শোনে না। তাই ডেঙ্গু পরিস্থিতি বর্তমানে সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এডিস মশার ক্ষমতাকে পাত্তা না দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিদেশ যাওয়া ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়রের গুজব বিষয়টিকে এডিস মশককুল তাদের ক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন ও অবজ্ঞা করা হয়েছে বলে ধরে নিয়েছে। তাই এডিস মশককুল তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে সারা দেশে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তা ছাড়া এডিস মশা নিধনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে মন্ত্রী, মেয়র ও জনপ্রতিনিধিরা শুকনো রাস্তায় ঝাড়– হাতে ফটোসেশনে ব্যস্ত রয়েছেন। পরিস্থিতি ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা দেখে এডিস মশককুল আরও উৎসাহিত ও সাহসী হয়ে উঠেছে।

ইতিমধ্যে ডেঙ্গু বাংলাদেশে মহামারী আকার ধারণ করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা এবং দক্ষিণ সিটি মেয়রের ‘গুজব’ তত্ত্বকে অতিক্রম করে দেশের মিডিয়া ও সংবাদমাধ্যমে প্রকৃত তথ্যটি প্রকাশিত হয়েছে। মিডিয়ার কল্যাণে বাংলাদেশে ডেঙ্গু যে এখন ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তা আর কারও অস্বীকার করার উপায় নেই। যারা ডেঙ্গুকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও উদাসীনতা দেখিয়েছিলেন, তারাও বর্তমানে ডেঙ্গু মহামারীকে প্রতিরোধের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ড টানিয়ে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ডেঙ্গুর এহেন আতঙ্কজনক প্রাদুর্ভাবের জন্য সব মহলই সরকার তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্বহীনতা, অদক্ষতা, উদাসীনতা, গাফিলতি, দুর্নীতিসহ সার্বিক ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে। অতীতের মতো এবারও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গুরুত্বসহকারে উপযুক্ত সময়ে সমন্বিত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করে সহনীয় অবস্থায় রাখা সম্ভব ছিল। এ কাজে যেসব সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ জনগণের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে কর্মকৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন, তারা আদৌ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নতুন নয়। ১৯৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশে সীমিতভাবে ডেঙ্গুজ্বরের অস্তিত্ব দেখা গেছে। ২০০০ সালে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সব মহলের উদ্বেগের কারণ। ২০০২ সালে ৬ হাজার ২৩২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়। এর পর থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ঢাকা সিটি করপোরেশন সমন্বিতভাবে ডেঙ্গু সংক্রামক এডিস মশা নিধন ও ডেঙ্গু চিকিৎসার ম্যানেজমেন্ট মডিউল প্রণয়ন করে ডেঙ্গু সমস্যা মোকাবিলা করে আসছে। ফলে বাংলাদেশে ২০০৩ সালে ৪৮৬, ২০০৪ সালে ৩৪৩৪, ২০০৫ সালে ১০৪৮, ২০০৬ সালে ২২০০ ও ২০০৭ সালে ৪৬৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সময়ে আমি দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলাম।

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের বেশ কয়েক মাস আগে (মার্চ-এপ্রিল) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা, কাউন্সিলর, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি এবং সংবাদমাধ্যমের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে নগর ভবনের অডিটোরিয়ামে দিনব্যাপী আলোচনা সভার আয়োজন করা হতো। বর্ষা শুরু হওয়ার আগে থেকেই এডিসসহ মশা নিধন এবং বিশেষ করে এডিস মশা সংক্রমিত ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও করণীয় সম্পর্কে মতামত গ্রহণ করা হতো। সমন্বিত ও লাগসই কর্মকৌশল প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদানের লক্ষ্যে প্রতি বছর উল্লিখিত সভায় ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সভাপতিত্বে আমি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতাম। বলাই বাহুল্য, ডেঙ্গু প্রতিরোধ করার প্রধান ও প্রথম পদক্ষেপ হলো এডিস মশা নিধন। যে কারণে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঢাকা সিটি করপোরেশনকেই তখন আমরা গুরুত্ব দিয়েছি এবং সিটি করপোরেশনও এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র-স্বচ্ছ পানি আটকে থাকতে পারে, সেসব স্থান (পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের কাটা খোল, পরিত্যক্ত পাত্র, নির্মাণাধীন ইমারতের গ্রাউন্ড ফ্লোর, সরকারি-বেসরকারি বিল্ডিংয়ের ছাদ, পরিত্যক্ত পানির পাত্র, উন্মুক্ত পানির চৌবাচ্চা ইত্যাদি) চিহ্নিত করে কার্যকর ওষুধ প্রয়োগ ও অপসারণের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করেছে। তার পরও বেঁচে যাওয়া এডিস মশার সংক্রমিত ডেঙ্গুকে সহনীয় পর্যায়ে রেখে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে।

কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এবার ডেঙ্গু প্রতিরোধের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দুই সিটি করপোরেশন, এমনকি এক সিটি করপোরেশনের সঙ্গে অন্যের কোনো সমন্বয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বরং প্রথম দিকে পত্র-পত্রিকা ও মিডিয়ায় ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের খবর প্রকাশিত হওয়ায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যাকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আরও দুঃখজনক, স্বাস্থ্যমন্ত্রী এক সেমিনারে ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশাকে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তুলনা করে নিষ্ঠুরভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যার তুলনায় ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা নগণ্য বলে নিষ্ঠুর মন্তব্য করে তার উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, দেশের মানুষ যখন ডেঙ্গুর প্রকোপে আতঙ্কিত তখন দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিদেশ সফরে চলে গিয়েছিলেন। তুমুল সমালোচনার মধ্যে তিনি অবশ্য দেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন। পত্র-পত্রিকা, মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ড টানিয়ে ডেঙ্গু চিকিৎসায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী নির্দেশনা প্রচার করে লোক দেখানো দায়িত্ব পালন করেছেন। সরকারের মন্ত্রী ও নেতারাও জনগণের মধ্যে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কিছু ফটোসেশনে অংশগ্রহণ করে নিজের প্রচার করে বেড়াচ্ছেন।

বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ৪ আগস্ট প্রচারিত ছবিতে দেশের তথ্যমন্ত্রীর একটি ফটোসেশনে দেখা যায়, তিনি চলচ্চিত্র অঙ্গনে শিল্পী ও কলাকুশলীদের সঙ্গে নিয়ে ঝাড়– হাতে রাস্তা পরিষ্কার করে এডিস মশা নিধন করছেন। অন্যরাও একই ধরনের লোক দেখানো ফটোসেশন করছেন। বর্তমানে সাধারণ মানুষও জানে এডিস মশা বংশ বিস্তার করে স্বচ্ছ পানির স্থিতি অবস্থায় থাকা পাত্রে বা স্থানে। ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করে এডিস মশা নিধন করার চিত্র হাস্যকর এবং জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকার এবং দুই সিটি করপোরেশনের উদাসীনতা, অবহেলা, দায়িত্বহীনতা ও দুর্নীতির ফলে ডেঙ্গু আজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অতীতে ডেঙ্গু শুধু শহরে সীমাবদ্ধ থাকলেও এবার সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ৮ আগস্ট পর্যন্ত সরকারি হিসাবে দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৩৪ হাজার ৬৬৬-এর বেশি। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ২৯, তবে বেসরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ৯৩। (সূত্র : দৈনিক সমকাল; ৯ আগস্ট)। বিভিন্ন পত্রিকায় সংগৃহীত তথ্য মোতাবেক মৃতের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। এরই মধ্যে সিভিল সার্জনসহ চারজন চিকিৎসক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারির স্ত্রী, অতিরিক্ত আইজিপির স্ত্রী, পুলিশ কর্মকর্তা, শিক্ষয়িত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। আগস্টের গত কয়েকদিনের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, দৈনিক গড়ে দেড় হাজারের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গু ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। প্রতিদিন বিভিন্ন জেলার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজধানীসহ সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের চিত্র দেখলে বোঝা যায়, দেশের ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলমান সবাই আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। অথচ সরকার বলছে, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে!

জাতীয় এ দুর্যোগকালে সরকারের শুধু আশ্বাস কোনো সুফল বয়ে আনবে না। হাসপাতালে শয্যা খালি নেই, ডেঙ্গু শনাক্তকরণে ব্যবহৃত উপকরণ (কিট) নেই এবং চিকিৎসা দেওয়ার জন্য চিকিৎসকের অভাব। এ বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে সরকার, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, এনজিও এবং সর্বোপরি জনগণের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় ও সচেতনতা সৃষ্টি করে জাতীয়ভাবে সংকটকে মোকাবিলা করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এবারের ঈদের ছুটিতে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। এই দৃষ্টিতে জনসংখ্যার বিশাল অংশ শহর থেকে গ্রামে এবং গ্রাম থেকে শহরে যাতায়াত করবে। উভয় দিক থেকেই সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। এ অবস্থায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত মহল এই দুর্যোগের ভয়াবহতাকে ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সাংবাদিকদের ধমক দিয়ে বা অসত্য প্রচার করলে পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে না। বরং বাস্তবতা উপলব্ধি করে দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সংকট সমাধানে আগ্রহী হওয়া অতীব জরুরি।

এবারে ডেঙ্গু পরিস্থিতি প্রকট হতে পারে বলে বিভিন্ন সংস্থা থেকে আগাম হঁশিয়ারি দেওয়ার পরও সরকার এবং সিটি করপোরেশন তা কেন আমলে নেয়নি, এ নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ডেঙ্গুর ভয়াবহতায় সতর্কবার্তা দিয়েছিল। আইসিডিআরবি বর্ষা মৌসুমের আগেই মশা নিধনের ওষুধ যে কার্যকর নয়, তা দুই সিটি করপোরেশনকে অবহিত করেছে এবং কার্যকর ওষুধ আমদানি করার পরামর্শ দিয়েছিল। এ ছাড়া ডেঙ্গুর ভয়াবহতার বিষয়টি গত ফেব্রুয়ারিতে উচ্চ আদালতে গড়িয়েছিল। উচ্চ আদালত দুই সিটি করপোরেশনকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় এবং দুই সিটি করপোরেশন এ সতর্কবার্তা বা নির্দেশ আমলে নেয়নি। জুন-জুলাইয়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার সময়ও তাদের ঘুম ভাঙেনি। অকার্যকর মশার ওষুধ ছিটিয়ে জনগণকে ধোঁকা দিয়েছে। একতান্ত্রিক শাসনের দেশ লন্ডন থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও মশা নিধনে কার্যকর ওষুধ আমদানির জন্য পরামর্শ দিতে হয়। তার পরও এখন পর্যন্ত মশা নিধনের কার্যকর ওষুধ আমদানির দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। জানা গেছে, দুই সিটি করপোরেশন দুই দেশ থেকে এত দিনে শুধু স্যাম্পল (নমুনা) সংগ্রহ করেছে। বর্ষা মৌসুম থাকতে মশা নিধনের কার্যকর ওষুধ আমদানি করা সম্ভব হবে বলেও মনে হয় না।

এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতার কারণে বিভিন্ন সতর্কবার্তা পাওয়ার পরও ডেঙ্গু চিকিৎসার বিষয়ে অগ্রিম তারা কোনো প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি। আগে থেকেই বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু ইউনিট বা সেন্টার চিহ্নিত করে রাখা হয়নি। ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষার জন্য উপকরণ (কিট ও রিয়েজেন্ট) পর্যাপ্ত মজুদ না থাকায় বর্তমানে শনাক্তকরণ পরীক্ষা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। উপকরণ (কিট) পাওয়া গেলেও তা ক্রেতাকে বাজার দর থেকে অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা ও অবহেলা ক্ষমার অযোগ্য।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ও রোগীর মৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ লুকোচুরি করছে। পরিসংখ্যানে বিভিন্ন ফাঁকফোকর সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবার কাছে নির্ভুল তথ্য না থাকলে সমস্যা সমাধানে কার্যকর কৌশল ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ও ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন প্রকাশ করা হয়। এ তথ্যই সরকারি তথ্য হিসাবে পরিগণিত হয়। সরকারি তথ্য মোতাবেক এ বছর ৮ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৩৪ হাজার ৬৬৬ ও ডেঙ্গু রোগে মৃতের সংখ্যা ২৯। তবে বেসরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ৯৩। সরকারি এ তথ্যের সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও রোগীর স্বজনদের থেকে সংগৃহীত পত্র-পত্রিকার রিপোর্টের ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কন্ট্রোল রুম থেকে যে তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে, তা রাজধানীর ১৩টি সরকারি ও ২৬টি বেসরকারি হাসপাতাল এবং সারা দেশের জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি রোগী গণনার ভিত্তিতে দেওয়া হয় বলে জানা যায়। রাজধানীর প্রায় ৩৫০টি বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক, চিকিৎকদের প্রাইভেট চেম্বার এবং দেশের অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও চেম্বারে ভর্তি রোগীর হিসাব অজানা। এ অবস্থায় রাজধানীসহ সারা দেশের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সরকারি তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তের পাশাপাশি এ রোগে মৃতের সংখ্যা নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। পত্র-পত্রিকায় সংগৃহীত তথ্য মোতাবেক ৫ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু সংখ্যা ৮৫ (৬ আগস্ট, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক)। এই সময়ে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা মাত্র ১৮। ওই তারিখের সরকারি পরিসংখ্যানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো ডেঙ্গু রোগী মৃত্যুবরণ করেনি। অথচ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মেডিকলে কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কে এম নাছির উদ্দিন জানিয়েছেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নয়জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু ঘটেছে (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৫ আগস্ট, ২০১৯)। ৪ আগস্ট, ২০১৯ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক সমন্বয় সভায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ঢাকার দক্ষিণাঞ্চলের ১১টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুমুক্ত বলে দাবি করেন। কিন্তু উল্লিখিত অঞ্চলে অবস্থিত স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওইদিন পর্যন্ত ১ হাজার ৯৭ জন ডেঙ্গু রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে বলে হাসপাতালসূত্রে জানা যায়। একই দিনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর বৃদ্ধির কারণে ১০০ শয্যা ধারণসম্পন্ন নতুন ওয়ার্ড উদ্বোধন করেছেন। জনসন রোডে অবস্থিত ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালসূত্রে জানা যায়, ৪ আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালে ১০৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণের ১টি ওয়ার্ড যদি ডেঙ্গুমুক্ত হয়ে থাকে তাহলে উপরোক্ত দুটি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হলো কোথা থেকে? অতএব, এটা পরিষ্কার যে, ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যু সম্পর্কে সরকারি পরিসংখ্যানে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে।

ডেঙ্গু মহামারীর বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে সরকারি পরিসংখ্যান লুকোচুরি না করে এ সংকটকে জাতীয় দুর্যোগ বিবেচনা করে জনগণের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে। সমস্যা সবার আর সবাই মিলে তা মোকাবিলার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সেই লক্ষ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের সকল পর্যায়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। তার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ। আগের অভিজ্ঞতার আলোকে এবং বর্তমান সংকটের ভয়াবহতা আমলে নিয়ে প্রত্যেকে যদি যার যার বাসস্থান, অফিস, বিল্ডিংয়ের ছাদ ও আশপাশে এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজনন স্থানগুলো ধ্বংস, জমাকৃত স্বচ্ছ পানি অপসারণ এবং তার সঙ্গে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কার্যকর ওষুধ প্রয়োগে এডিস মশার লার্ভা বিনষ্ট করতে পারে তাহলে মশার বিস্তার অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। কার্যকর ওষুধ আমদানির বিষয়ে দুই সিটি করপোরেশনকে অতিদ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এডিস মশা নিধন করার কাজে ফটোসেশনের সংস্কৃতি পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। ডেঙ্গু রোগের ম্যানেজমেন্ট/চিকিৎসা কার্যক্রমকে আরও জোরদার করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডেঙ্গু কেন্দ্র বা ওয়ার্ড চিহ্নিত করা প্রয়োজন। দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসককে যথাযথ ভূমিকা পালনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে রোগীদের বিনামূল্যে ডেঙ্গু শনাক্ত করার পরীক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পরীক্ষা করার উপকরণ (টেস্টিং কিট) অতিদ্রুত আমদানি করে বিনামূল্যে সব সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সরবরাহ করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও প্রাইভেট চেম্বারের কর্তৃপক্ষকে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি পরিহার করে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় এ দুর্যোগ মোকাবিলার লক্ষ্যে সরকারকে অতিরিক্ত অর্থায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুই সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তার সঙ্গে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের সবার মধ্যে ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য কার্যকর ঐক্য সৃষ্টি করে কর্মকৌশল গ্রহণ করতে হবে। ডেঙ্গু মহামারীর হাত থেকে জনগণকে বর্তমানে ও ভবিষ্যতে রক্ষা করতে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে কার্যকর সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

লেখক : সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি-বিএনপি এবং সাবেক অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ভূ-তত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর