রবিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

পরিবেশ-প্রকৃতি : পাহাড়ের কান্না থামবে না?

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী

পরিবেশ-প্রকৃতি : পাহাড়ের কান্না থামবে না?

পরিবেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আমার চির-অনুভূতি, পরিবেশ রক্ষা অভিযানের স্মৃতি আমার চিরসঙ্গী। তাই ১২ বছর মামলা ঝুলিয়ে রাখার এক অবিশ্বাস্য কাহিনি নিয়েই আমার এ লেখনী। চট্টগ্রাম পরিবেশ আদালতে ২২৪টি মামলা বিচারাধীন। তার বিপরীতে ৯৮টির তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেনি পরিবেশ অধিদফতর। পাহাড় কেটে আবাসিক প্লট তৈরির অপরাধে ১২ বছর আগে মামলা হয়েছিল, কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। অন্য এক পাহাড় কাটার মামলায় ১১ বছর ধরে একজন সাক্ষীরও সাক্ষ্য হয়নি। অধিদফতর জনবল সংকটকে দায়ী করেছে। অথচ ২০০৯ সালে এ সংস্থায় লোকবল ছিল ১৯৩ জন, ২০১৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৭৭ জনে। নিরেট কর্তব্যে অবহেলা, যা অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য। মূলত এ সংকট অনেক গভীরে। তা হলো, প্রাতিষ্ঠানিক শাসনের ভঙ্গুরতা। এভাবে অসংখ্য মামলা চোরাবালিতে ডুবিয়ে দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা যথারীতি বেতন-ভাতা তুলেছেন, ইনক্রিমেন্ট নিয়েছেন, কাক্সিক্ষত পদায়ন ও পদোন্নতি নিয়েছেন, সরকারি অর্থে বিদেশ সফর করেছেন। কিন্তু সরকারি স্বার্থ রক্ষায় গভীর তলানিতে! নদী-নিসর্গ ও পাহাড় রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিবেশ অধিদফতরের জন্য সরকারের বার্ষিক ব্যয় ৭৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। সুতরাং এর value for money ? এ উপলব্ধিহীনতাই জবাবদিহিহীনতা। মূলত যত ক্ষমতাবান আদালতই হোক, প্রসিকিউশন দুর্বল হলে আদালতের কিছু করার নেই। একটি শক্তিশালী প্রসিকিউশন আদালতকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। প্রসিকিউশন দুর্বল হলে প্রতিষ্ঠান কোন যুক্তিতে রায় প্রত্যাশা করে? এভাবে কচুরিপানার জঞ্জালের মতো আমরা মামলার জট বাঁধিয়ে রেখেছি, আর প্রতিনিয়ত আদালতের সমালোচনায় মুখর হচ্ছি। ফলে দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫ লাখ ৮২ হাজার ৩৪৭। মামলার এ পাহাড় সৃষ্টির পেছনে কত সরকারি সংস্থার অবহেলা যে দায়ী, এটি তার অনন্য দৃষ্টান্ত। এভাবে পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস করে যেমন উল্লম্ফন করছে অপরাধীরা, তেমনি হিমশীতল হয়ে আছেন পরিবেশরক্ষকরা। একে বলে এক মোহনায় মিশে যাওয়া, অনন্য জুটিবদ্ধতা। বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ বিশ্লেষণ-২০১৮ শীর্ষক গবেষণা রিপোর্টমতে, দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশ শীর্ষে। দূষণে বার্ষিক ক্ষতি ৫৩ হাজার কোটি টাকা। পাহাড় কাটা বন্ধে মাননীয় উচ্চ আদালত এযাবৎ অসংখ্যবার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এর পরও অবিরাম আবাসন আর শিল্পায়ন প্রকল্পের উদরে পাহাড় নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। আর অপরিণামদর্শী পাহাড় কাটায় ভূতাত্ত্বিক গঠন ক্রমে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। পাহাড়-পর্বত কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, পৃথিবীর জন্য প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ। আল কোরআনের সূরা নাবায় আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘আমি কি করিনি ভূমিকে শয্যা এবং পাহাড়-পর্বতকে কীলক বা পেরেক?’ পাহাড়-পর্বত ইকোসিস্টেমের অংশ। মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের একে অন্যের ওপর চিরন্তন নির্ভরতাই প্রকৃতির পূর্ণতা। এ পাহাড়ই মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের খাদ্যের আধার, খনিজ সম্পদের আধার। পাহাড়ে ছড়িয়ে আছে মানুষের রোগ নিরাময়কারী ভেষজগুণসম্পন্ন হাজারো ঔষধি গাছ, লতাগুল্ম। পাহাড়কে ক্ষতবিক্ষত করলে পাহাড় কীভাবে ভূমিকম্পের মতো আমাদের ওপর আছড়ে পড়ে এবং তছনছ করে দেয় সড়ক ও জনপদ, তার প্রমাণ সাম্প্রতিককালের একের পর এক পাহাড়ধস। ২০১২ সালে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেডের ধ্বংসাত্মক এক পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছিলাম। স্বয়ং চোখে না দেখলে অনুধাবন করা যাবে না কত ভয়ঙ্কর হতে পারে প্রকৃতির প্রতি এ নিষ্ঠুরতা। ১০টি বুলডোজার জব্দ করে এবং মামলা দায়ের করে তছনছ করে দিয়েছিলাম পাহাড়ঘাতকদের পরিকল্পনা। এ পাহাড় কাটায় জড়িত বহুজাতিক করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী দম্ভোক্তি করেছিলেন, Who cares law in Bangladesh? ? ওই সাঁড়াশি অভিযানে তার দর্প চূর্ণ হয়ে যায়। পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট)-এর দায়িত্বে থেকে পরিবেশ অধিদফতরকে একান্ত আপন করে বুকে স্থান দিয়ে পরিবেশ রক্ষার যে কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম, পরে পরিবেশ অধিদফতর থেকে বিদায় নিলেও পরোক্ষে এবং নেপথ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলাম পরিবেশ রক্ষার নিরন্তর অভিযানে। দুর্নীতি দমন কমিশনে যোগদানের পর অনুধাবন করলাম, পরিবেশ অপরাধের বীজ লুক্কায়িত আছে পরিবেশ দুর্নীতিতে। পাহাড় কাটা, নদী দখল, নদীতীর কেটে ফেলা, সবুজের সমাধি রচনা করে ইটভাটা নির্মাণের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট এবং পরিবেশ অধিদফতরের সমন্বিত টাস্কফোর্স নিয়ে দুদকের নেতৃত্বে প্রচ- গতিবেগে অভি যান শুরু করলাম। মাঠে জাগ্রত হলো পরিবেশ অধিদফতর। ২০১৮ সালে বান্দরবানের লামায় মধ্যরাতে পাহাড় ধ্বংস করা হচ্ছে, এ অভিযোগ পেয়ে তৎক্ষণাৎ স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতরের সমন্বিত টিম পাঠালাম। সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া হলো। গভীর রাতে বুলডোজার জব্দ করে পাহাড় কাটা থামানো হলো। দুর্ভাগ্য, এসব পাহাড় এক রজনিতে ধ্বংস হয়নি। পরিবেশঘাতকরা সদা সক্রিয়, বিনিদ্র। অগণিত রজনিজুড়ে টনে টনে মাটি ইটভাটায় বিক্রি করা হয়েছে। অথচ পরিবেশ অধিদফতর ওই পাহাড় কাটার মূল আসামিকে গ্রেফতার না করলেও প্রায় দুই সপ্তাহ পর দুদক ভবনের সামনে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছিলাম। সম্ভবত এ কারণেই লর্ড ব্যাথাম মন্তব্য করেছিলেন, ‘আইন যেখানে শেষ, সেখানেই অত্যাচার শুরু’।পাহাড় কাটার সৃষ্ট দুর্যোগ যেমন ভয়াবহ, তেমন এর প্রাণহানি, সম্পদহানি এবং অর্থনৈতিক ক্ষতিও অপরিমেয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক দশকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড়ধসে ২ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। বাংলাদেশের মোট আয়তনের যে ১২ শতাংশ পাহাড়ি এলাকা, তার সব কি অক্ষত আছে? চট্টগ্রামের জাকির হোসেন রোডের উত্তরে, ঢাকা ট্রাংক রোডের পূর্বে এবং বায়েজিদ বোস্তামী রোডের পশ্চিম পাশের বিশাল এলাকাজুড়ে পাহাড়গুলো নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। দেয়াং পাহাড়কেও ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। নতুন প্রজন্ম প্রকৃতির এ বিবর্তিত রূপ দেখে বুঝতেই পারবে না অতীতে কী ছিল এখানে। পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহরের অবস্থান পাহাড়ের শীর্ষে। উঁচু উঁচু পাহাড় অক্ষত রেখে ঢালু জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে অনিন্দ্যসুন্দর জনপদ। একখ- পাহাড়ও কাটা পড়েনি, এক টুকরো গাছও হয়নি নিধন। এটিই টেকসই উন্নয়ন। অথচ দানবীয় প্রক্রিয়ায় আমরা পাহাড়-টিলা ধ্বংস করছি। ডেকে আনছি প্রকৃতির ওপর শোষণ, লুণ্ঠন ও অভিঘাতের এক ভয়ঙ্কর পরিণতি। অথচ পাহাড়ের ভৌগোলিক গঠনকে অক্ষত রেখে পাহাড়কেন্দ্রিক চা চাষ, মাল্টা চাষ, কমলা চাষ এবং ইকো পার্কের প্রকল্প নিলে তা দারিদ্র্য বিমোচন, পর্যটনের বিকাশ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল হতে পারে। চীন, নেপাল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন কত নিখুঁতভাবে পাহাড় রক্ষা করছে। ব্রাজিলিয়ান এক দম্পতি ২০ বছরে ২০ লাখ গাছ লাগিয়ে মরুভূমিকে অরণ্যে রূপান্তর করেছে, সেখানে এখন ১৭২ প্রজাতির পাখি, ৩৩ রকমের স্তন্যপায়ী, ২৯৩ প্রজাতির গাছপালা ও ১৫ প্রজাতির সরীসৃপ আছে। ওদের আছে সৃষ্টির নেশা, আমাদের হলো ধ্বংসের নেশা। আমাদের পাহাড় প্রস্তরময় নয়, মাটির তৈরি টারশিয়ারি পার্বত্য এলাকা। প্রতিটি জীবজন্তু ও গাছপালা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে স্মরণ করে। তাদের ভাষা আমরা বুঝি না। ঘাতকরা যখন ধারালো অস্ত্র দিয়ে মানবদেহে আঘাত করে, সেই আঘাত সইতে পারে না মানুষ। এবার ভাবুন, পাহাড়ের গায়ে কি নির্মমতায় আমরা বুলডোজার চালাই! পাহাড়েরও নীরব অশ্রুপাত ও দীর্ঘশ্বাস আছে। পাহাড় ধ্বংসকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা পরিবেশ অধিদফতরের ম্যান্ডেট। পরিবেশ অধিদফতরের নবাগত মহাপরিচালককে অনুরোধ জানাব, প্রাতিষ্ঠানিক অনুশাসন কঠোরভাবে নিশ্চিত করুন। পরিবেশরক্ষকদের হৃৎপি-, মগজ ও রক্ত থেকে দায়িত্বে অবহেলার মানসিকতা উপড়ে ফেলুন। মামলা পরিচালনায় দায়িত্বে অবহেলার কারণে সংশ্লিষ্টদের প্রশাসনিক শাস্তি নিশ্চিত করুন। এনফোর্সমেন্টে সাহসী কর্মকর্তা নিয়োগ করুন। শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে পরিবেশ অধিদফতরকে সক্রিয় করুন, প্রত্যেককে পরিবেশ অ্যাকটিভিস্টে পরিণত করুন। শুধু বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদ্যাপন বা সেমিনার অনুষ্ঠানের জন্য পরিবেশ অধিদফতর সৃষ্টি হয়নি। স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, ‘যে গ্রহে আমরা বাস করি তা ধ্বংস করার প্রযুক্তি আমরা আবিষ্কার করে ফেলেছি, কিন্তু এই গ্রহ থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রযুক্তি এখনো আমরা বের করতে পারিনি।’ আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ান নেতা জেরেনিমোর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘যখন শেষ গাছটি কাটা হবে, শেষ মাছটি ধরা হবে এবং শেষ নদীটির পানি বিষাক্ত হবে, তখন আমরা উপলব্ধি করব, শুধু টাকা খেয়ে বেঁচে থাকা যায় না।’ সুতরাং পাহাড়-পর্বত ধ্বংসের পাওনা একদিন পাই পাই করে বুঝিয়ে দিতে হবে মানুষকে। মানুষের জীবন শুধু প্রাণীজীবন নয়, এটি পাপ-পুণ্যের হিসাবের আলোকে একটি জবাবদিহিমূলক জীবন, যে জবাবদিহি নিয়ে একদিন মহান স্রষ্টার আদালতে দাঁড়াতে হবে। গ্যাংরিন আর ক্যান্সারের মতো দায়িত্বহীনতা ও জবাবদিহিহীনতার রোগ যেখানে বাসা বেঁধে আছে সেখানে প্যারাসিটামল দিয়ে রোগ সারানোর চেষ্টা বৃথা। কঠোর অনুশাসন ছাড়া প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয় না, যতই অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগুক প্রতিষ্ঠানে। প্রকৃতির নিবিড় সৌন্দর্য রক্ষার যোগ্যতা যেমন থাকতে হবে, তেমন থাকতে হবে মানসিকতা। পরিবেশকে অবহেলা ক্ষমাহীন অপরাধ, যে অপরাধের পরিণতিতে আজ নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্যের এ মরণাপন্ন অবস্থা। সুতরাং পাহাড় ধ্বংসের মতো গুরুতর অপরাধের বিরুদ্ধে আইনের কেমোথেরাপি ডোজ প্রয়োগ এখন অপরিহার্য। পাহাড় কাটা বন্ধে অব্যাহত নজরদারি, কঠোর এনফোর্সমেন্ট অভিযান, পরিবেশ আইনের শতভাগ প্রয়োগ, আদালতে দক্ষতার সঙ্গে মামলা পরিচালনা এবং পাহাড়জুড়ে বৃক্ষায়ন-বনায়ন, পানি নিষ্কাশনের ড্রেনেজ স্থাপন, পাহাড়ের মাটির পতন রোধে সিলট্র্যাপ (ফাঁদ), গাইডওয়াল নির্মাণের মাধ্যমে নিরাপদ বেষ্টনী গড়ে তোলাই পাহাড় রক্ষার একমাত্র প্রেসক্রিপশন। এ লেখনী যেন পাহাড় রক্ষায় জাগ্রত করে আমাদের বিবেক- এ আশায় বুক বেঁধে আছি।

লেখক : মহাপরিচালক, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর