শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রতারিত এক ভূস্বর্গ কাশ্মীর

বোরহানুল হক সম্রাট

ভারত সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের পর কাশ্মীরের খরস্রোতা কোনো পাহাড়ি নদীর পানির চলাচল থেমে পড়েনি। গাছ থেকে খসে পড়েনি কোনো টিউলিপ ফুলও। অপার রহস্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কাশ্মীর ভ্যালির কোনো পর্বতের সৌন্দর্যেও হঠাৎ ঘাটতি পড়েনি। লাদাখের কোনো পর্বত থেকে ধসে পড়েনি বড় বরফখ-। কিন্তু যা হয়ে গেল তাতে থমকে গেছে শুধু সেখানকার মানুষ। নতুন বিশ্বে যে মানুষের দাম আর তার প্রত্যাশার মূলে আঘাত পড়ছে দিন দিন। কিন্তু তার ক্ষিপ্ততা, হিংস্রতা আর অমানবিকতার সংযোজন থেকে বাদ পড়ল না ভূস্বর্গও।

কাশ্মীর। ঠিক কতটি পাহাড় বা পর্বত অথবা পর্বতশ্রেণি আছে নির্দিষ্ট করে তার হিসাব জানা যায়নি। যেমন হিসাব আছে কতটি নদী প্রবাহিত হয়েছে এ অঞ্চলজুড়ে। অথবা বাগান বা বনরাজি বা সমতলভূমির হিসাবও খুঁজে মিলতে পারে। কিন্তু পাহাড়ের মতোই সংখ্যার গণনায় অন্তহীন সেখানে বাস করা মানুষের জীবনের যত গল্প। শহর পেরোলে কাশ্মীরে ফলবাগানের মালিক, পশতুনি শালের কারিগর-দোকানদার শ্রেণি ছাড়া অন্য মানুষের এত বেশি কষ্ট যে তাদের নিয়েও করা রাজনীতি আমাদের আধুনিক জগতের এক বড় স্বার্থপরতার গল্প। বসবাস করে যেতে হয় বলে যে অন্তহীন হিমশীত তাদের সইতে হয়, তার চেয়ে বেশি কষ্ট এই ভূরাজনীতির স্ক্রিপ্ট। একজন কাশ্মীরি অগ্রসর যুবক শ্রীনগরে ডাল লেকের নৌকায় বসে গত শীতে আমার কাছে তীব্রভাবে যে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন তা হলো- আসলে কে ঘটিয়েছে পুলওয়ামা হত্যাকা-। তার দাবি, ওই ঘটনার পর যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জম্মু-কাশ্মীরবাসী, তাতে দিন দিন উত্তরটা পাল্টে চলেছে। সবশেষ বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে সেখানে এখন যখন ভারতের অন্য প্রান্তের মানুষ বসতি গড়ে তুলবেন, ধীরে ধীরে বদলে ফেলবেন চিরায়ত কাশ্মীরের চেহারা- পুলওয়ামার অপরাধী কে সেই প্রশ্ন এবং তার উত্তরটাও হয়তো সেই সঙ্গে হারিয়ে যাবে।

কাশ্মীরের রাজধানী থেকে ৯৬ কিলোমিটার দূরের পেহেলগাম। সম্ভবত ভূস্বর্গ বলতে এ অঞ্চলটিকেই বোঝানো হয়েছে। শহর ছেড়ে ঘন হয়ে আসা পাহাড়চূড়া আর হঠাৎ শব্দে হাজির খরস্রোতা নদীর মুগ্ধতায় এখানে পৃথিবী অনাবিল হতে শুরু করে। কিন্তু আপনাকে মানতেই হবে যে, এখানে একই সঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটতে থাকে। আসলে আপনি পাহাড় ভেদ করে গভীরে ঢুকে যত বেশি আনন্দ উপভোগ করবেন একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টে থাকা মানুষগুলোর দিকে ধেয়েও যাবেন। নদীর স্রোতের বিপরীতে পাহাড়িপথে পেহেলগামের শেষ দিকেও তারা বাস করেন। পেহেলগাম পেরিয়ে ৭, ১০ বা ১৫ কিলোমিটার দূরের যে পাহাড়ের ভাঁজ, সে ভাঁজে ভাঁজে যতটা সুন্দর উপস্থিত, ততটাই কষ্ট সেখানকার স্থায়ী মানুষের। কী কষ্ট? কষ্টটা বেঁচে থাকার। কী নিয়ে, কী খেয়ে বাঁচবেন তারা। পর্বতের মাথায় জমে থাকা বরফ অথবা অনাবিল সুন্দর যে সবুজ দেখেন ভ্রমণপিসাসু পর্যটক, তারই মাঝে মাঝে এমন অনেক মানুষের বসবাস, সব দিন যাদের খাবার জোটে না। শীতের তীব্রতা পেরিয়ে প্রকৃতির আভিজাত্য দেখতে সেখানে যাওয়া পর্যটকরাই যে ওই মানুষগুলোর ভরসা। তাদের জন্য শীতের পোশাক নিয়ে, হাঁটু পর্যন্ত দীর্ঘ জুতা ভাড়া দিতে দাঁড়িয়ে থাকেন তারা। পারলে পায়ের জুতা খুলে সেটা পরিয়ে দিতেও পিছপা হন না। তাতেও রাজি না হলে পিছু ছাড়া নেই। বরফঘেরা জনপদে একটু চা বা কফি অথবা গরিবের ঘরে বানানো পশতুনি শাল কিছু একটা খরিদ করুন। পেহেলগামের মিনি সুইজারল্যান্ড খ্যাত বৈসরনের পাহাড়ে যুবকের দল তৈরি স্লেজিংয়ের কষ্টসাধ্য পাহাড়ি খেলায় মাতাতে। ইউরোপে যে দড়ি টানে কোনো পশুকুল এখানে তা টেনে নিয়ে ঘোরে কাশ্মীরি অসাধারণ সুদর্শন কোনো যুবক। তারও আগে বৈসরনের ২ ঘণ্টার পাহাড়ি পথে ঘোড়ার দড়িটা যার হাতে সে হয়তো কোনো ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ। পিচ্ছিল বরফের পথে ঘোড়ারও একটা পথ বানানো আছে, যা নেই তার জন্য। তবু সে ঘোড়ায় অথবা স্লেজিংয়ের গাড়ি ওঠার জন্য কত রকম আকুতি! রাগ করে রাজি হবেন না। এসে বলবে, না গেলে না চড়লে খাব কী? এই তো ভূস্বর্গ। তবু সেই স্বর্গে ভারী কাপড় আর বুকের চামড়ার ভিতরে যা লুকানো ছিল তার নাম বিশেষ রাজ্য, বিশেষ সম্মান।

স্বাধীন থাকতে চেয়েও ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর কাশ্মীরের রাজা হরি সিং পাকিস্তানি আগ্রাসনের মুখে ভারতভুক্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। তবে নিশ্চিত করেছিলেন, কাশ্মীরবাসীর স্বায়ত্তশাসনও। তা মেনে নিয়েই ১৯৫০ সালে ভারতের সুস্থ রাজনীতির ধারকরা সংবিধানে ৩০৬ ধারা (বর্তমানে ছিল ৩৭০) বলে এক বিশেষ মর্যাদা দেন। কাশ্মীর উপত্যকাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে, ৫ আগস্ট সেই অনুচ্ছেদ রদ করা হলো, এক প্রমাণিত প্রতারণায় ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়ল কাশ্মীরবাসীর স্বর্গও।

শুধু পেহেলগাম বা গুলমার্গে এটা নয়, রাজধানী শ্রীনগরের বুকের মধ্যে থাকা ডাল লেকেও কখনো কখনো এমন সময় আসে। দূরের পাহাড় যত সৌন্দর্যই তৈরি করুক মনে শান্তি না এলে ওদিকে তাকান না সেখানকার মানুষ। অথবা অমনোযোগী হয়ে তাকিয়ে থাকেন যখন টিউলিপ, সবুজ বা বরফে ঢাকা পাহাড় ভেদ করেও তারা কোথাও পৌঁছে যান। ভূরাজনীতির বেড়াজালে পড়া এই ভূমিতে যখন জঙ্গিরা কোনো খুনোখুনিতে মত্ত হয় তার পরই সেখানে নেমে আসে এমন উ™£ান্ত জীবন। একটা ঘটনা, একটা গুলি বা বোমার আঘাতে সেখানে স্বজাতির কেউ নিহত হলেই কাশ্মীরমুখো হন না পর্যটকরা। কারণ, দম ফেলার আগে আগেই শান্তি ফেরাতে সেখানে মিলিটারি কনভয়ের দেখা মেলে। ডাল লেকের হাউস-বোটগুলো তখন যত সাজেই রঙিন হোক না কেন কেউ সেখানে যান না। ফল আবার অভুক্ত জীবনের শঙ্কা, বাস্তবতা। গুলমার্গের কথাটা না বললেই নয়। শ্রীনগর থেকে দূরত্ব ৫২ কিলোমিটার। শহর ছাড়ার মিনিট ত্রিশ পরই দূরের সারি সারি পর্বতই আপনার চোখ টেনে নেবে। তবে কাছ থেকে সেখানে চোখ মেলার আগেই হয়তো আপনি থমকে দাঁড়াবেন দীর্ঘ এক মিলিটারি কনভয়ের সামনেও। কাশ্মীরিরা যে দৃশ্য তাদের নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছিলেন। আসলে এমনিতেই তারা কেউই আর ভালো ছিলেন না। কারণ, অনেক দিন থেকেই কাশ্মীর আর কাশ্মীর নেই। কিন্তু খাতায়-কলমে আর হৃদয়ে ছিল আলাদা সংবিধান ও পতাকার গর্ব। সেই গরিমা এবার কেড়ে নিল এক দিশাহারা ভারত- যে পথে মাত্র এক দশক আগেও হাঁটার কথা চিন্তা করেননি বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির কোনো শাসক।

             লেখক : বার্তা সম্পাদক, নিউজ টোয়েন্টিফোর।

সর্বশেষ খবর