বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

২১ আগস্টের সেই গ্রেনেড হামলা

শফী আহমেদ

২১ আগস্টের সেই গ্রেনেড হামলা

বছর ঘুরে সামনে এসেছে ভয়াবহ সেই গ্রেনেড হামলার কালো দিন, ২১ আগস্ট। যখন বন্যা কাটিয়ে ডেঙ্গু আর চামড়া সংকট মোকাবিলায় সরকারকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। নানা সমালোচনাও আছে। তবে এসব সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। দায়িত্বশীলদের পরিকল্পনায় ত্রুটি থাকলেও সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

আমি এ লেখাটি যখন লিখছি তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংকট মোকাবিলার দিক দিয়ে আরও পরিপক্ব, শক্ত। কারণ, হাজারো সংকট আর দুর্যোগের মধ্যে আমাদের পথচলা। একটি সংকট যায়, আরেকটি সামনে আসে। বন্যা-চামড়াসহ আরও কিছু সংকট আমাদের সামনে। এসবের মধ্যে আছে-  রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, জম্মু-কাশ্মীর ইস্যু, প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে দেওয়ার হুঙ্কারসহ ছোটখাটো আরও কিছু সমস্যা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিলিয়ে উদ্বিগ্ন পরিস্থিতির মধ্যে থাকলেও বিশ্বাস আছে আমরা অবশ্যই এ দুর্যোগ কাটিয়ে উঠব।

পৃথিবীর কোনো কোনো দিন আসে সূর্যের প্রখর তীব্রতা নিয়ে, কোনো কোনো দিন অমাবস্যার রাতের চেয়েও অন্ধকারময়। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন আজানের ধ্বনি ভেসে আসছিল, ঠিক তেমনি এক ভোরে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ক্রীড়নক, কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য।

একই বছরের ৩ নভেম্বর কারাবন্দী জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকেও নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়েছে। যারা ’৭১ সালে বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানি কারাগারে আটক, সেই কঠিন ক্রান্তিলগ্নে তাঁর অসমাপ্ত কর্মকে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমাদের এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার লাল সূর্য।

কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির ক্রমাগত আক্রমণ বার বার স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক সমতাভিত্তিক সমাজের অগ্রগতির ধারাকে। এই জঘন্য অপশক্তি ২০০১ সালে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। শুরু হয় রাজনীতির নতুন মেরুকরণ। ফের ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে রক্তাক্ত হতে শুরু করল বাংলাদেশ। নতুন করে শুরু হলো হত্যাকান্ড। শুধু নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার কারণে ধর্ষিত হয়েছে শত শত তরুণী। হাজার হাজার ঘরবাড়ি আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর চলে নির্মম অত্যাচার।

বিএনপি-জামায়াত জোটের হত্যা আর অপরাধের ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সন্ত্রাসবিরোধী এক মিছিলপূর্ব সমাবেশ আহ্বান করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো তাঁকে লক্ষ্য করে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। এ গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রাণ হারান আইভি রহমানসহ ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী। চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান শত শত নেতা-কর্মী।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এই গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে হামলাকারীরা নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃত্বকে। আমরা একটু অতীতের দিকে ফিরে যাই, ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে ছিল আইএসআই ও সিআইএ। তাদের ক্রীড়নক ছিল খুনি ডালিম, ফারুক, রশীদ চক্র ও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে মীরজাফর মোশতাক চক্র। কিন্তু এ কথা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, জিয়াউর রহমান ছিলেন বঙ্গবন্ধু খুনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদদাতা। ঠিক তেমনিভাবে এ কথাও অনস্বীকার্য যে, হাওয়া ভবনের অধীশ্বর তারেক রহমান ছিলেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মূল মদদদাতা। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত চক্র ক্ষমতাসীন হওয়ার পর জিয়াপুত্র তারেক রহমান বিকল্প ক্ষমতা কেন্দ্র গড়ে তোলেন হাওয়া ভবনে। ২১ আগস্ট গ্রেনেডে হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই তাজউদ্দিন ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জেএমবির ঘাতকরা। এই পুরো নীলনকশা হাওয়া ভবন ও তারেক রহমানের মস্তিষ্কজাত। খুনিরা চেয়েছিল নির্বিঘ্নে এ হত্যাকান্ড সম্পাদন করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে জননেত্রী শেখ হাসিনা বেঁচে যাওয়ায় খুনিদের সেই দুরাশা পূরণ হয়নি। অনেক আন্দোলন সংগ্রাম ও নেতা-কর্মীর আত্মত্যাগের মাধ্যমে জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে উন্নয়নের ধারায়। চালকের আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। যে দলটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো বাঙালি জাতির ভাগ্যের উন্নয়ন সাধন। জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে ও রায় কার্যকর হচ্ছে। ঠিক তেমনিভাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাস্টারমাইন্ড তারেক রহমানসহ অন্য আসামিদের বিচার কার্যক্রম চলছে।

কেবল এই নৃশংস হত্যাকান্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি খুনির দল। তারা সাজিয়েছিল জজ মিয়া নাটক। বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে যখন তৎকালীন সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান এই গ্রেনেড হামলা নিয়ে কথা বলতে চেয়েছেন, তখন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘এটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি দেখছি!’ যা কিনা সামরিক গোয়েন্দাপ্রধান তার জবানিতে বলেছেন।

আজ এই দিনে আমরা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ যারা সেদিন প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, যারা পঙ্গু ও আহত অবস্থায় অপরিসীম কষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন। আমাদের প্রত্যাশা-  মৌলবাদ, জঙ্গিবাদসহ সমাজে বিরাজমান সব অপচেষ্টা মোকাবিলা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের উন্নত ও শান্তির দেশ।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা ও নব্বইয়ের গণআন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতা।

সর্বশেষ খবর