বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

একজন গ্রিটা থানবার্গ

জাকারিয়া চৌধুরী

একজন গ্রিটা থানবার্গ

গ্রিটা থানবার্গ সুইডেনের এক স্কুলছাত্রীর নাম। ক্রমবর্ধমান বিশ্ব উষ্ণতা রোধ করার ব্যাপারে রাজনৈতিক অবহেলা, অর্থনৈতিক নীতি ও দর্শনে প্রয়োজনীয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার ব্যাপারে অপারগতা, উষ্ণায়নের লাগাম ধরে রাখতে না পারলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভেঙে পড়ে যে মহাবিপর্যয়ের সূচনা হবে সে সম্পর্কে উদাসীনতা মানবজাতির জন্য আজকের দিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা এখনো এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ব্যাপারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারিনি। মানবস্বার্থ, মানব অস্তিত্ব বিপন্ন করে আমরা যথারীতি জাতীয় স্বার্থ, দলীয় স্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থ ও বাণিজ্যিক মুনাফা নিয়ে মাতামাতিতে ব্যস্ত।

এই যখন বিশ্বপরিস্থিতি তখন কোনো চিন্তাবিদ, কোনো বুদ্ধিজীবী, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কোনো সমাজ সংস্কারক নয়, সুইডেনের এক স্কুলের ১৬ বছরের অজ্ঞাত ছাত্রী গ্রিটা কর্তৃক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক সমস্যার ব্যাপারে সংঘটিত ব্যাপক ও অদমনীয় আন্দোলন পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, ইউরোপব্যাপী স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কিশোর মনকে উদ্বুদ্ধ করেছে। ঢাকা শহরের স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে যেমন নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করেছিল তেমনি সুইডেনের ছাত্রছাত্রীরা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে আন্দোলন করছে নিরাপদ পৃথিবীর জন্য। গ্রিটা থান -বার্গ এখন একজন আন্তর্জাতিক সেলিব্রিটি। ব্রিটিশ সব রাজনৈতিক দল কর্তৃক গেল এপ্রিলে আমন্ত্রিত হয়ে পার্লামেন্টে বক্তব্য দানকালে সে যেসব কথা বলেছে তা যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক এক ভাষ্য। তার বক্তব্যে যে রূঢ় সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে তা অস্বীকার করা যেমন কঠিন, তা গলাধঃকরণ করা তার চেয়েও বেশি কঠিন। আমরা এ বাস্তবতা বুঝতে পারলেও মেনে নিতে পারছি না। কেননা, তা মানতে হলে আমাদের আজকের গতানুগতিক জীবনধারা ও প্রচলিত মূল্যবোধ পাল্টে নতুন জীবনধারা ও মূল্যবোধের সূচনা করতে হবে যা বড় কঠিন ও পীড়াদায়ক। সেজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লবের। এসব বুঝেই গ্রিটা বলেছে, সে অনাগত কোটি কোটি মানবসন্তানের হয়ে সংগ্রাম করছে।

জাতিসংঘ নিয়োজিত ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (Inter Governmental Panel on Climate Change) তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব উষ্ণায়নের ক্রমধারা রোধ করার ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা না নিতে পারলে বিশ্ব মহাবিপর্যয়ে পড়ে মানব অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলবে। এক-দুই শ বছর নয়, মাত্র ১১ বছরের মধ্যে তা করতে হবে। হাতে সময় খুবই কম। অথচ গেল দুই যুগ ধরে নানা বৈঠক, আলোচনা, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে মৌখিক অঙ্গীকার ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকা হয়েছে কিন্তু বাস্তবে এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি এখনো নেই। তাই মানব-ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না।

গ্রিটা তার ভাষণে বলেছে, মানুষের চিন্তাধারা, ভাবধারা, জীবনধারা সবকিছুতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। বর্তমানের প্রচলিত অর্থনীতি ও রাজনীতি প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের পথে বড় বাধা। এখনকার গণতান্ত্রিক কাঠামোয় আবদ্ধ থেকে বর্তমানের কিছু সুখসুবিধা পরিত্যাগ করে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য অপ্রিয় কিন্তু দরকারি আইন ও নীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হয় না। সেদিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে গণমুখী স্বৈরতন্ত্র বা benign dictatorship।

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দর্শন হলো মানুষ rational animal। সে স্বার্থপর ও হিসাবি জীব। সে মুনাফা বাড়ানোর জন্য সদাউদ্যোগী। সে কলকারখানা স্থাপন করে উৎপাদন বাড়ায়, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। এ ব্যবস্থায় মানুষের চাহিদার শেষ নেই, মানবজীবনের লক্ষ্য হবে মুনাফা ও আধিপত্য বিস্তার। যখন থেকে চাহিদা কমে যাবে তখন থেকে পুঁজিবাদের চাকাও গতি হারাবে, মিলিয়নিয়ার-বিলিয়নিয়ারের সংখ্যাও কমে যাবে। অপ্রয়োজনীয় চাহিদা বাড়ানোর জন্য অবিরত চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্ররোচিত করা হচ্ছে মানুষকে নিত্যনতুন পণ্য কেনার জন্য। তাতে ভূসম্পদ ও জলবায়ুর ওপর চাপ দিনে দিনে বেড়ে চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ২০১৯ সালের জুলাই মানবেতিহাসের সর্বোচ্চ উষ্ণ মাস হিসেবে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। চিন্তা হয় আরও কত রেকর্ড সৃষ্টি হবে এবং মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। তদুপরি পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭০০ কোটি থেকে বেড়ে ১ হাজার কোটি হতে বেশি দেরি নেই। তাহলে এই বাড়তি জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদা আমরা মেটাব কী দিয়ে?

গ্রিটা থানবার্গকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার কথা উঠেছে। আমি বলি তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তার বক্তব্যের যথার্থতা অনুধাবন করে যতই পীড়াদায়ক ও অপ্রিয় হোক, ভালোভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে যা কিছু পরিবর্তন সামাজিক নীতি ও অবকাঠামোয় আনা দরকার তা জরুরি ভিত্তিতে করা হোক ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে।

লেখক : বাংলাদেশ সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর