বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

যে বাড়ি কাঁদায় সবাইকে

ফাতিমা পারভীন

যে বাড়ি কাঁদায় সবাইকে

ছোটবেলা থেকেই কত স্বপ্ন আমরা দেখি। স্বপ্ন এখন হয়ে গেছে সৃজন-শীল। মানুষের চিন্তার জগতে এখন ভেসে বেড়ায় ড্রোন তৈরির কল্পনা। নতুন নতুন অ্যাপ তৈরি নিয়ে ব্যস্ত অনেকেই। কেউ মানসপটে ছবি আঁকে চাঁদকে মুষ্টিবদ্ধ করার প্রত্যয়ে। স্বপ্ন আমিও দেখেছি, অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন লালন করেছি বছরের পর বছর। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘুরে দেখব, প্রিয় বাংলাদেশকে দেখব। কিন্তু আমার বড় হতে অনেক সময় লাগল। অনেক বড় হতে না পারলেও, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অন্তরাল থেকে ডানা মেলতে পেরেছি। ২০১৪ সালে প্রথম বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি দেখার সৌভাগ্য হলো। সারাটাকাল মনের ফ্রেমে বন্দী স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল সেদিন।

বাড়ির মূল কাঠামোর কোনো পরিবর্তন না করেই এখানে গড়ে তোলা হয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি জাদুঘর। এখানে সুনিপুণভাবে রাখা হয়েছে বঙ্গবন্ধু আর তাঁর প্রিয় পরিবারের ব্যবহার্য বিভিন্ন সামগ্রী, সেগুলো দিয়েই সাজানো হয়েছে এ জাদুঘরটি। ভেবেছিলাম এত বড় একজন নেতার বাড়ি, হয়তো বঙ্গবন্ধুর বিত্ত-বৈভব ও বিলাসী জীবনের ছোঁয়া পাব কিন্তু ভিতরে গিয়ে হতবাক হয়েছি। এত আটপৌরে অতিসাধারণ আসবাবপত্র, টিভি, রেডিও আর কাপড়-চোপড়গুলো দেখে অবাক না হয়ে পারিনি। জাদুঘরের দেয়ালে বুলেটের চিহ্ন আর বঙ্গবন্ধু যে সিঁড়িতে গুলির আঘাতে নিহত হয়েছিলেন সেই সিঁড়ির দিকে নজর আটকে গেল। রক্তাক্ত সিঁড়িতে বেশি সময় স্থির চোখে তাকিয়ে থাকতে পারিনি। বাড়ির দেয়াল ও বিভিন্ন জায়গায় ঘাতকের বুলেটের চিহ্ন ’৭৫-এর নির্মমতা আর বীভৎসতার কথা মনে করিয়ে দেয় প্রতিটি মানুষকে। এক তলার প্রথম কক্ষটিতে বঙ্গবন্ধুর ও বিশ্বনেতাদের সঙ্গে ছবি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ছবি ও পরিবারের অন্য শাহাদাতবরণকারীদেরও তৈলচিত্র রয়েছে। দোতলায় বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষ। ১৫ আগস্ট ভোরে বেগম মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল ও বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত মৃতদেহ এখানে পড়ে ছিল। এ ঘরের করিডোর থেকে নিচে নামার জন্য যে সিঁড়িটা রয়েছে ঠিক সেখানেই ঘাতকদের গুলিতে প্রাণ হারান বঙ্গবন্ধু। তাঁর কক্ষের ভিতরে টেলিফোন সেট, রেডিও, রক্তমাখা পোশাক রাখা আছে।

সামনে খাবার ঘরে সাদামাটা জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্র। হঠাৎ আমার নজর কাড়ে একটি ছোট্ট বাইসাইকেল। ঠিক উল্টো দিকে শেখ জামালের কক্ষে দেখা গেল তার সামরিক পোশাক। ওই একই তলায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার অতি সাধারণ শয়নকক্ষ। যতই এগোচ্ছি বার বার দৃষ্টি যেন বাইসাইকেলের দিকে, দৃশ্যমান এক অনুভূতি মনের ফ্রেমে নাড়া দিতে লাগল। বাড়ির তৃতীয় তলায় শেখ কামালের কক্ষ। পর্যায়ক্রমে বাড়িতে রাখা আছে বঙ্গমাতার ব্যবহার্য জিনিসপত্র, সুলতানা কামালের নতুন সবুজ বেনারসি আর লাল ঢাকাই জামদানি, বিয়ের জুতা, ভাঙা কাচের চুরি, চুলের কাঁটা ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে আছে। শিশু শেখ রাসেলের রক্তমাখা ছোট্ট জামাটি দেখে বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। রক্তমাখা জামাটি আমার মাতৃত্বে সজোরে ধাক্কা দিল।

সামনে যেতে বার বার দৃষ্টিগোচর হয় ছোট্ট এক শিশুর ছবি, তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র আর বাইসাইকেলটি আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিল। মনে হলো এসব ব্যবহার্য জিনিসের অন্তরালে ছোট্ট এক শিশুর কোমল স্পর্শ, মান-অভিমান, ভালোবাসার ছোঁয়া লেগে আছে। মুহূর্তে মনে হলো শিশু রাসেল স্কুলে চলে গেছে; স্কুল ছুটি হলে সে আবার ফিরে আসবে। স্পর্শ করবে প্রিয় জিনিসপত্র, মান-অভিমান করবে, হাসবে, খেলবে, দুরন্ত মন তার ছুটবে যোজন যোজন মাইল দূরে। মাতিয়ে তুলবে সারা বাড়ি। নতুন কোনো সৃষ্টির জগতে দাঁড়িয়ে সোনার মানুষ হওয়ার প্রত্যয়ে আদুরে কণ্ঠে ডাকবে ‘হাসু আপু’। তার ডাকে বাড়িটি আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। দুরন্ত টগবগে হাস্যোজ্জ্বল স্বাধীন শিশুকে স্পর্শ করতেই মুহূর্তে হাত বাড়িয়ে দিলাম, স্পর্শ করলাম; কিন্তু ছুঁতে পারিনি। শক্ত একটা গ্লাসের ছোঁয়ায় আমিও শক্ত হয়ে গেলাম। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না; চলে এলাম। বাকরুদ্ধ হয়ে আসার পথে নৈঃশব্দ্যের উৎকর্ণতার বিবর্ণ ঘটল আমার। বের হতে দেখে একজন দর্শনার্থী বললেন ছয় তলা ভবনটি পরিদর্শনের জন্য। আমি তাকে কোনো জবাব দিতে পারলাম না। বেঁকেচুরে হেলে পড়া আমার দেহের ভার আর বইতে পারছিল না কিছুতেই। ওই ছোট্ট শিশুর মানবাধিকার লঙ্ঘনের আর্তচিৎকার আমাকে অহোরাত্র ব্যাকুল করে ফেলেছে। সেদিনের অদেখা সেই ছয় তলা ভবন দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ২০১৬ সালে। সারা বাড়ি ঘুরে মনে হলো বঙ্গবন্ধু তাঁর যাপিত জীবনকে বাঙালির অধিকার আদায়ের প্লাটফরমে পরিণত করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য, মানবিকতা, রাজনৈতিক সংকটে প্রদত্ত সমাধান, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে গৃহীত পদক্ষেপ পর্যালোচনা করলে কেবল গণশক্তির প্রকাশ পাওয়া যায়। আর এটা সুস্পষ্ট হলো কেন, পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকচক্র শত চেষ্টা করেও বঙ্গবন্ধুকে পথভ্রষ্ট করতে পারেনি। সততা, দেশপ্রেম, ন্যায়পরায়ণতা, বুদ্ধি ও সুবিবেচনা, সাহস আর বীরবিক্রমে অটুট বঙ্গবন্ধুকে পরাস্ত করা পাকিস্তানি শাসকবর্গের পক্ষে সম্ভব হয়নি। মূলত বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় মাপের একজন নেতার অতিসাধারণ জীবনযাপনের বাড়িটি না দেখলে তাঁকে অনুধাবন করা কঠিন। পরিশেষে বলতে চাই, একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ, দেশপ্রেমিক, নিরহংকারী মানুষ হিসেবে, নিজেকে শোধরাতে হলে প্রতি মাসে না হলেও বছরে অন্তত একবার বঙ্গবন্ধুর মতো এমন একজন নেতাকে অনুসরণ করার জন্য এ বাড়িটি প্রত্যেক নাগরিকের পরিদর্শন করা উচিত।

লেখক : শিশু ও নারী অধিকার কর্মী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর