শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

ডেঙ্গু : আগাম পদক্ষেপ কি নেওয়া যায় না

কামাল লোহানী

ডেঙ্গু : আগাম পদক্ষেপ কি নেওয়া যায় না

ইদানীং ডেঙ্গুকে নিয়ে মানুষ আতঙ্কের মধ্যে আছে। চিকিৎসকরাও কম আতঙ্কে নেই। সবচেয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত এলাকা হলো রাজধানী শহর ঢাকা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ক্রমে দেশের সর্বত্র বিশেষ করে শহর এলাকায় এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। চিকিৎসকরা নিত্যই এ রোগের ভয়াবহতা এবং প্রতিরোধে করণীয় বর্ণনা করে নানাভাবে কথা বলছেন।  এ ছাড়া সরকারের মন্ত্রী, সচিব ও ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা তো আছেনই। ডেঙ্গুর বিপদ নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন ফলে এ নিয়ে সরকার থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই নানা তর্কবিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন এবং একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করছেন। রোগ নিরাময়ের চেয়ে কথা বলা এত বেশি হচ্ছে যে, আক্রান্ত রোগী ও তাদের স্বজনরা বিরক্তি প্রকাশ করছেন; কারণ, ডেঙ্গু প্রতিরোধে শহর-নগরের পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব যাদের কাঁধে সেই মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন পর্যন্ত একে অন্যের বিরুদ্ধে না হলেও একজন যা বলছেন, অন্যজন তা থেকে আলাদা উচ্চারণ করছেন। এডিস মশা নিধন করতে, সে কারণে আমাদের উচ্চ আদালত পর্যন্ত দৌড়াতে হয়েছে। আজকাল বিচার বিভাগ দেশের যে কোনো অসংগতি ও ব্যত্যয়কে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে তার প্রতিকারের জন্য যেমন রায় দিচ্ছে, তেমনি ডেঙ্গুর প্রশ্নেও কী করণীয়, মশক নিধনে ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করার নির্দেশ জারি করছে। দেশের প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে বলে তাদের নাকি এ-জাতীয় সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। মজার ঘটনা হচ্ছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকে হাই কোর্টে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও সঠিক হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সচিব মহোদয়ের অজ্ঞানতার কারণে মাননীয় বিচারক এক ঘণ্টার সময় দিয়ে তার কাছ থেকে জানতে চাইছেন এডিস মশা নিধনে ওষুধ আমদানি করতে কত দিন লাগবে, তা যেন তিনি হাই কোর্টকে এক ঘণ্টার মধ্যে জানান। এদিকে মশক নিধনের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ ও সরকার একমাত্র নিজ দলের কর্মীদের প্রতিই নির্দেশ জারি করেছে। দেশে ডেঙ্গু নিয়ে যে ব্যতিব্যস্ত ভাব দেখানো হচ্ছে এবং প্রতিটি হাসপাতালে বেড না থাকায় মেঝেতে পর্যন্ত এমন রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শুধু কি তাই, হাসপাতালে হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার প্রতিষ্ঠা করা হলেও স্থানসংকুলান হচ্ছে না বলে শত শত বেডও সৃষ্টি করা হচ্ছে। তার পরও ডেঙ্গুর প্রকোপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিকিৎসক ও নার্সরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে জনপ্রতিনিধি বা বোদ্ধা ব্যক্তিদের মধ্যে এখনো কথাকাটাকাটি চলছেই। তারা উভয়েই মানুষের সচেতনতাকে বাড়ানোর জন্য নানান নতুন নতুন কৌশল প্রতিদিনই আবিষ্কার করছেন। কীভাবে জল জমে থাকলে এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি হয় সে সম্পর্কে সবাই বলছেন কিন্তু এত দিন ধরে ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে, তাতে প্রতিকারের যথার্থ তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সরকার ডেঙ্গু রক্ত পরীক্ষার জন্য মেশিন সব জেলায় পাঠিয়েছে। তা সত্ত্বেও আতঙ্কিত ও আক্রান্ত রোগীরা ঠিকমতো রক্ত পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন না। না পাওয়ায় তারা সবাই ক্ষুব্ধ। ডেঙ্গু আমাদের কাছে খুব বেশিদিনের রোগ নয়। এই বিশের দশকেই এর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে অথচ এর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য আগে থেকেই কোনো প্রস্তুতি বা জনগণকে সজাগ করার কোনো কার্যক্রম লক্ষ্য করিনি। ঢাকা ছোট শহর হলেও করপোরেশন কত বড় জানি না, কাজের সুবিধার জন্য এবং জনগণের কাছে ত্বরিত পৌঁছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটি মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনকে ভেঙে দুই টুকরো করা হলো। উত্তর-দক্ষিণে বিভক্ত এই করপোরেশনের মেয়ররা সদাই ব্যস্ত ডেঙ্গুবিরোধী প্রচারণায় এবং প্রতিরোধ কর্মসূচি বৃদ্ধি করায়। এরা দুজনই এডিস মশা নিধনের জন্য যে ওষুধ ছিটাচ্ছিলেন, তা নাকি সবাই বলছে কার্যকর নয়। বোধহয় তারাও স্বীকার করেছেন ওষুধের কার্যকারিতা কমে গেছে। নতুন ওষুধ আমদানি করতে হবে। দক্ষিণের মেয়র আমাদের চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের ‘চোঙা’ ফোঁকার মতো খালি গলায় নানান আশ্বাস ও সাধারণ মানুষকে সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন। আবার খোদ উত্তরের করপোরেশন ভবনেই এডিস মশার ‘প্রজনন ক্ষেত্র’ আবিষ্কৃত হচ্ছে। জানি, আলোর নিচে অন্ধকার থাকে কিন্তু সেই আলোই সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়ে এলাকাকে আলোকিত করে। অথচ আমরা বোধহয় অন্ধকারকেই ছড়িয়ে যাচ্ছি। আমার মনে হয়, এসব ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য চিকিৎসক, স্বাস্থ্য-বিভাগীয় কর্মকর্তা বা প্রাসঙ্গিক ব্যক্তিদের নিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মধ্যে তুমুল আলোচনা চলছে কিন্তু আজও পর্যন্ত নাগরিক পর্যায়ে প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার কিংবা করপোরেশন কোনো পরামর্শ সভা করেনি।

এখনো শহরে প্রায় সব স্কুলই খোলা। তবে শুনেছি দু-একটি স্কুলে ছাত্রদের ডেঙ্গু রোগের বিস্তার প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতা অভিযানে কাজে লাগানো হচ্ছে। তারা নাকি পাড়ায়-মহল্লায় অর্থাৎ নিজেদের আওতার ভিতরে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে রাস্তাঘাটে এডিস জন্মানোর লক্ষণকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে এবং সেইসঙ্গে সচেতন করছে গৃহবাসীকে। আমার কেন অনেকেরই ধারণা, সব স্কুল বন্ধ করে জনগণকে সচেতন করার কাজটি খুবই কার্যকরভাবে করা যেতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে, তবে চোর পালালে যেন বুদ্ধি না বাড়ে। সিদ্ধান্ত ত্বরিত নিতে হবে। অভিযান চলছে চলবে। মশক নিধনের নতুন ওষুধ আমদানি করা হয়েছে বা হচ্ছে, এমন করতে করতে যেন সেপ্টেম্বর পার হয়ে না যায়। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মকর্তা ও ডেঙ্গুবিষয়ক সবাই বলছেন সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর আশঙ্কা থাকবে। হয়তো বা এডিস মশার চরিত্র বিশ্লেষণ করে ওরা এই সময়সীমা নির্ধারণ করেছেন। তাই বলছিলাম, কথা বলতে বলতে, করছি করবতেই যেন এই সময় পেরিয়ে না যায় সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাই যেন সচেতন থাকেন। হয়তো আছেনও তবু নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কের মধ্যে নিজেরাই সময়সীমা ভুলে না যান। আরেকটি প্রশ্ন যদি তারা জানেনই এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়, তারা কেন এর প্রতিকারের কোনো আগাম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না।

আমাদের দেশের কত হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে তার হিসাব যাই হোক না কেন অথবা মৃতের সংখ্যা যত কম দেখানোর চেষ্টাই করা হোক না কেন, এ সংখ্যানুপাতিক তুলনা অন্য দেশের সঙ্গে করাটা বালখিল্য। ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া কিংবা অন্য কোনো দেশে ডেঙ্গু কতটা বিস্তৃত হয়েছে, সেটা তো সেই দেশের সরকার বা সংশ্লিষ্ট দায়বদ্ধ ব্যক্তিদের চিন্তার ব্যাপার। আমরা কেন ওইসব ভেবে নিজেরা স্বস্তিবোধ করতে চাইছি এবং আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা অনেক কম বলে নিজেরা ‘তৃপ্তি’ পেতে চেষ্টা করছি। জনগণের সচেতনতা সৃষ্টির দায়িত্ব যেমন মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের প্রাথমিক দায়িত্ব তেমনি সাধারণ মানুষেরও এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে সেটাও ঠিক। তাই বলে জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের দায়িত্ববোধকে হালকা করে দেখবেন না। দুঃখটা হচ্ছে, দেশের ছোট-বড় কর্মকর্তারা বার বারই ‘জনগণ জনগণ’ বলে তাদের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চাইছেন। এটা কোনো কৌশল হতে পারে না। যার যার দায়িত্ব তারা সঠিকভাবে পালন করবেন এটা কর্মকর্তারা যেমন ভাবেন, তেমনি জনগণও ভাবে। অদ্ভুত ব্যাপার, প্রথম দিকে শুনছিলাম ডেঙ্গুর কোনো প্রতিষেধক এডিস নিধন ছাড়া কিছু নেই। সত্যি কথা বলতে কি, এই একমাত্র নিধন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করার জন্য পাড়ায় পাড়ায় হঠাৎ করে দিনে রাতে কোনো এক সময়ে ‘ফগার’ মেশিনের মাধ্যমে যে ধূম্রজালের সৃষ্টি করা হয় তাতে রাস্তার এডিস মশা অন্যত্র তাদের আশ্রয় খুঁজে নিতে পারে। তার ওপর শুনেছি মেশিনে যে ওষুধ ছিটানো হয় তাতে নাকি জল মেশানো থাকে। ফলে কার্যকারিতা সর্বনিম্ন। যাই হোক, এবারে আদালতের রায় যখন জনগণের পক্ষে তখন নতুন ওষুধ আমদানি করতে, প্রথমে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরে ১৫ দিনের মধ্যে ওষুধ আমদানি করা যাবে বলে কর্তারা জানিয়েছিলেন। এখন দেখছি উত্তরের মেয়র কয়েকদিনের মধ্যেই সেই ওষুধ আমদানি করে গত ৮ আগস্ট থেকে ছিটাতে শুরু করেছেন। করপোরেশনকে এ ক্ষেত্রে সাধুবাদ দিতে চাই।

যখনই ডেঙ্গু প্রকোপের আশঙ্কা দেখা দেবে বলে করপোরেশন ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানতে পারছেন, এর পর থেকে যেন তারা আগাম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তা ছাড়া সারা বছরই এই মশক নিধন অভিযান চালু রেখে ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা কি করা যায়?

বলছিলাম সরকার একে ‘দুর্যোগ’ না বললেও জনগণ যে ‘দুর্ভোগে’ পড়েছে সে কথা তো সত্য। মহামারী আকারে না ভাবলেও ডেঙ্গু ভয়াবহভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, এ বাস্তব স্বীকার করতে আপত্তি কেন?

 

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

সর্বশেষ খবর