হঠাৎই একটি খবরে চোখ আটকে গেল। খবরটির শিরোনাম- ‘দেশে বর্তমানে ৭ শতাংশ শিশু গৃহশ্রমিক ধর্ষণের শিকার হয়।’ বেসরকারি সংস্থা ‘দ্য লিনসেন কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড’ পরিচালিত ‘অসংগঠিত খাতে শিশুশ্রমের অবস্থা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্মক্ষেত্রে ৫৭ শতাংশ শিশু শ্রমিক মারধরের শিকার হয়। আর প্রায় ৪৬ শতাংশ শিশু শ্রমিকের সঙ্গে খারাপ ভাষা ব্যবহার করা হয়। যেসব শিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছে, তাদের মধ্যে ৭ শতাংশ ধর্ষণ ও ৬৬ শতাংশ শিশু শ্রমিক মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় (সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন ডটকম)। বাংলাদেশের শিশুশ্রমের পেছনের অন্তর্নিহিত কারণ এবং এর সম্ভাব্য প্রতিকার খুঁজে বের করার জন্য নিলসেন ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকায় বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত ৬০০ শিশু শ্রমিকের তথ্য নিয়ে এ গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। গবেষণায় আর্থিক সহায়তা দেয় বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ৭৯ শতাংশ শিশু শ্রমিক প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শিশু শ্রমিকরা দৈনিক ১০ ঘণ্টারও বেশি কাজ করে মাসে ১৪০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে।
গবেষণায় উঠে এসেছে শতকরা ২২ শতাংশ শিশু শ্রমিক বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ৩৫ শতাংশ শিশু শ্রমিকের কর্মস্থলে খাবার ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া ৮০ শতাংশ শিশু শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রে কোনো ধরনের ওভারটাইমের সুযোগ নেই। এ ছাড়া, গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে ১১ বছর বয়স থেকেই শিশুরা শ্রমে নিয়োজিত হয়। শতকরা ৭৯ ভাগ শিশু শ্রমিক স্কুল থেকে ঝরে পড়ে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই। এ গবেষণায় শতকরা ৫২ ভাগ শিশুর বয়স ছিল ১৫ থেকে ১৮.৮৮ ভাগ ছিল ১০ থেকে ১৪ বছরের এবং ৪ ভাগ শিশুর বয়স ছিল ৫ থেকে ৯ বছর।
আমার প্রশ্ন, আমরা এত অমানবিক কেন? বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র কর্তৃক সব শিশুর জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৮ অনুযায়ী-রাষ্ট্র চাইলে শিশু শ্রমিকদের কল্যাণে, বৈষম্যমূলক হলেও ইতিবাচক বিধান প্রণয়ন করতে পারবে। শিশু শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকল্পে অনুচ্ছেদ ৩৪-এ সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ করে রাষ্ট্রীয় আইনানুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর ধারা ২-এ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে (ফরমাল সেক্টর) শিশুদের বিধানকল্পে ‘শিশু’ ও ‘কিশোর’-এর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী-১৪ বছর বয়স পূর্ণ করেনি, এমন যে কেউ শিশু হিসেবে গণ্য হবে। আর ১৪ বছর বয়স পূর্ণ করেছে কিন্তু ১৮ বছর বয়স পূর্ণ করেনি, তাহলে কিশোর হিসেবে গণ্য হবে। শ্রম আইনের এই ধারা ৩৪-অনুযায়ী কোনো পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিশুকে নিয়োগ করা যাবে না বা কাজ করতে দেওয়া যাবে না। আর একজন কিশোরকে নিয়োগের পূর্বে রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কর্তৃক প্রদত্ত সক্ষমতা প্রত্যয়নপত্র (সার্টিফিকেট অব ফিটনেস) লাগবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে- প্রাতিষ্ঠানিক খাতে শিশু ও কিশোরকে নিয়োগের ক্ষেত্রে উপরোল্লিখিত আইনকানুন ছাড়া আরও বাধাধরা পলিসি থাকলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত (যেমন গৃহকর্মী হিসেবে শিশু নিয়োগ) শিশু কিংবা শ্রমিকদের জন্য তেমন সুনির্দিষ্ট কোনো শ্রম আইন এখনো বাংলাদেশে তৈরি করা হয়নি। ফলে বাংলাদেশের শিশু শ্রমিকদের বেশির ভাগই যেখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যুক্ত সেখানে তারা আইনি সুরক্ষার বাইরেই থেকে গেল। উপরোক্ত গবেষণা প্রতিবেদন ছাড়াও আমরা অনুমান করতে পারি- দেশের শিশু শ্রমিকদের একটি বড় অংশ (বিশেষত কন্যাশিশু) গৃহকর্মে যুক্ত। এই গৃহশ্রমিকদেরও শ্রম আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। ফলে এদের মজুরি, নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, ছুটি কোনো কিছুরই কোনো নির্ধারিত নিয়মকানুন নেই। শ্রমের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হলে বা অন্যায় আচরণের শিকার হলে অভিযোগ জানানো বা শ্রম আদালতে আশ্রয় লাভের কোনো সুযোগ এদের নেই। আরও আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে- বাংলাদেশ শিশুশ্রম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদে এখনো অনুস্বাক্ষর করেনি। উপরন্তু এ দেশে শিশু আইন, ২০১৩; শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন, ২০০৬; জাতীয় কৃষিনীতি, ২০১৩ প্রণয়ন করা হলেও সেসবে গৃহকর্মের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শিশুদের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। সুতরাং দেশের প্রচলিত আইনে গৃহকর্মীদের নিয়োগ তথা দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা এখন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। যদি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি তবে শিশু-কিশোরদের সক্ষমতার বাছ-বিচার ছাড়া গৃহকর্মে নিয়োজিত করে তাদের ওপর আমরা যে লাগাতার অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছি, তা শুধু বড় মানবিক অপরাধই নয় বরং এটা সভ্যতার এক ভয়ঙ্কর মানসিক রোগ। প্রায়ই খবরের কাগজে দেখি, টেলিভিশনের পর্দায় দেখি- দেশের নামকরা ক্রিকেটারসহ বড় বড় নেতা ও চাকরিজীবী তাদের বাসার শিশু গৃহকর্মীর ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন।