বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

সবিনয় নিবেদন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী

পীর হাবিবুর রহমান

সবিনয় নিবেদন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী

এ দেশের আদর্শিক রাজনীতির পবিত্র পুরুষ, কুঁড়েঘরের ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ শতবর্ষের দোরগোড়ায় এসে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে চিরনিদ্রা নিয়েছেন। পেশাগত জীবনে তার স্নেহ-সান্নিধ্য ও আস্থা লাভ করেছিলাম। বাঙালি জাতির মহত্তম নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, মানবতার রাজনীতিতে সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ে নিবেদিতপ্রাণ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে নিয়ে লেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আজকাল সামগ্রিক পরিবেশ-পরিস্থিতি নিজেকে এমন জায়গায় দাঁড় করায় যে, কোনটা রেখে কোনটা লিখব; কোনটা রেখে কোনটা বলব তা নির্ধারণ করতে পারি না। কখনোসখনো আগের ট্রেন পেছনে যায়, পেছনের ট্রেন সামনে চলে আসে। এক এক ইস্যু একেক সময় রকেট গতিতে এমনভাবে ছুটে আসে যে, একটি জ্বলন্ত ইস্যু বাদ দিয়ে আরেকটি জ্বলন্ত ইস্যুকে লুফে নিতে হয়। সামগ্রিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে কঠিন বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে একটি বিশাদগ্রস্ত হৃদয় ও মনের বেদনা নিয়ে এবার সবিনয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছেই কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমাদের মহান স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী সামনে রেখে এবং মহাকাব্য যুুগের দুনিয়া কাঁপানো এ বিশ্ববরেণ্য রাজনৈতিক নেতা, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী সামনে রেখে যে কথা হৃদয়ের সব আবেগ, অনুভূতি ও চেতনা থেকে বলতে চাই, তা হচ্ছে নিম্নরূপ-

১. মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের গণতন্ত্রের মহান নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন বন্ধুপ্রতিম ভারতসহ যতগুলো রাষ্ট্র ও বিশ্ববরেণ্য নেতা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, গণধর্ষণ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন সেসব জীবিতদের এবং যারা প্রয়াত হয়েছেন তাদের পরিবারবর্গকে নিয়ে সেই সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসবকে বাঙালি জাতির গণজাগরণের উৎসবে পরিণত করা। এ উৎসবে আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী ও জাতীয় বীরদের সম্মানজনক মর্যাদা দেওয়া। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর একাত্তরের পরাজিত শক্তির দোসররা মিলে খুনিচক্র ও সামরিক শাসকরা বাংলাদেশে যে ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়েছিল তা পুনরুদ্ধারের মধ্য দিয়ে সঠিক ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল অনাগত প্রজন্মের জন্য তৈরি করা। একই সঙ্গে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভিআইপি মর্যাদাদান।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ১৯৭৫-এর বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে পরিবার-পরিজনসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে আমাদের ইতিহাসের মহান ঠিকানা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটিকে রক্তগঙ্গায় ভাসিয়ে ৫৫ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে খুনিচক্রের সঙ্গে একাত্তরের পরাজিত শক্তি শুধু উল্লাস করেনি, মুক্তিযুুদ্ধে অবদান রাখা উগ্রপন্থি রাজনৈতিক সব শক্তি তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিল। আওয়ামী লীগ নামক দলটিতে বঙ্গবন্ধুর পর অবস্থান করা নেতাদের জেলখানায় হত্যাই করা হয়নি; সারা দেশে হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করে নির্যাতন করা হয়েছিল। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে দেশান্তরী করা হয়েছিল। সেদিনের সশস্ত্র বাহিনীর নায়করা যেমন হত্যাকা- প্রতিরোধ দূরে থাক; অবৈধ খুনি শাসকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। বিশ্বাসঘাতকতার সেই কলঙ্কের ইতিহাসে অস্ত্রের মুখেই হোক, আর স্বেচ্ছায় হোক বঙ্গবন্ধুর অনেক সতীর্থ যেমন কাপুরুষের মতো খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় শপথ গ্রহণ থেকে শপথ অনুষ্ঠান পর্যন্ত ভূমিকা রেখেছিলেন; তেমনি প্রতিরোধের ডাক দিতে ব্যর্থ হলেও দলের নেতারা খুনিদের চরম নির্যাতন ভোগ করে যেমন কারাদহনের পথ বেছে নিয়েছেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। একাত্তরের বাঘা সিদ্দিকী-খ্যাত বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের প্রতিরোধের ডাকে অসংখ্য বঙ্গবন্ধু-অন্তঃপ্রাণ তরুণ তাদের জীবন ও যৌবনকে বাজি রেখে অনিশ্চিত গন্তব্যে যেতে কার্পণ্য করেনি। এই প্রতিরোধ যোদ্ধারা আজ পথে পথে ঘুরছেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় তারা শুধু তাদের অবদানের স্বীকৃতিটুকু চাইছেন।

সুবর্ণজয়ন্তীর আগে তাদের সেই স্বীকৃতিটুকু দেওয়া হোক। কাদের সিদ্দিকীর আত্মাজুড়ে বঙ্গবন্ধুই নন, আপনাদের জন্যও দরদ আছে। বোনের জন্য ভাইয়ের দরদ থেকেই বলেন, শেখ হাসিনাকে সরিয়ে তারেককে তিনি চাইতে পারেন না।

মহান আল্লাহর অসীম রহমতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সেই কালরাতে আপনি ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। কিন্তু ’৭৫-এর পর অন্ধকার সময়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে এবং অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শের পথে যখন কঠিন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয়েছে; তখন মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা অতিবাম ও অতিবিপ্লবী উগ্রপন্থিরা সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষুর মতোই চরম মুজিববিদ্বেষী, আওয়ামী লীগবিদ্বেষী ভূমিকা নিয়ে সেই রাজনীতিতে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। বিশ্বরাজনীতিতে নির্লোভ, নিরাবরণ, গণমুখী রাজনীতির মহানায়ক ও মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু ও আপনার পরিবারকে নিয়ে দক্ষিণপন্থিদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তাদের বীভৎস আস্ফালন করতে দেখেছি। তাদের বিকৃত আনন্দ, হঠকারী পথ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। আমাদের রাজনীতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে যখন সেনাশাসকরা তাদের রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে নেতৃত্বের কোন্দলে লাগিয়ে ভাঙনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, তখন দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে অভিশপ্ত সময়ে গণতন্ত্রের বাতিঘর হয়ে পিদিমের মতো আলো জ্বালিয়ে আপনি গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আপনার রাজনৈতিক জীবন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। কণ্টকাকীর্ণ পথে আপনি গণতন্ত্রের সংগ্রামে বিজয়ের লক্ষ্যে নীলকণ্ঠ হয়ে সবাইকে নিয়ে দীর্ঘ লড়াই করেছেন ঐক্যবদ্ধভাবে। আপনার জীবনের বড় অর্জন ক্ষমতাসীন সামরিক শক্তি ও একাত্তরের পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাস্ত করে মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতার রাজনীতিতে একীভূত করে আমাদের মহান নেতার কন্যা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিতই করেননি, ’৭৫-এর পর উল্টে যাওয়া ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে এনেছেন। সেই দুঃসময়ে যারা চরম মুজিববিদ্বেষী, আওয়ামী লীগবিদ্বেষী এবং আপনার প্রতি বিরুদ্ধমনোভাব পোষণ করেছে; আপনার সংগ্রামের বিজয়ের কাছে তারাও নত হয়ে আজ মুক্তিযুদ্ধের মীমাংসিত সত্যকে গৌরবের সঙ্গে উচ্চারণ করছেন। এ আপনার রাজনৈতিক বিজয়ই নয়; দীর্ঘ কঠিন সংগ্রামের সোনালি ফসল। আপনি বেঁচে থাকায়, দলের নেতৃত্বে আসায় আওয়ামী লীগকেই জনপ্রিয় করেননি, শক্তিশালী করেননি; জাতীয় ঐক্যের প্ল্যাটফরম তৈরি করে পঁচাত্তর ও একাত্তরের খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন।

পায়ে পায়ে মৃত্যুর সঙ্গে হেঁটে, ২১ আগস্টের মতো ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা থেকে জীবন নিয়ে ফিরে এসে আপনি ভয়ে কুণ্ঠিত হয়ে ঘরে বসে থাকেননি, অগণিত কর্মীর লাশ টেনেছেন; তাদের পঙ্গুত্বের পাশে দাঁড়িয়েছেন, নির্যাতিতদের সাহায্য করেছেন। বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে একতরফা ষড়যন্ত্রের নির্বাচন প্রতিরোধ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফসল ওয়ান-ইলেভেনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পিতার মতো আপসহীন অমিত সাহস নিয়ে বিজয়ীর বেশে কারাগার থেকে বেরিয়ে ব্যালট বিপ্লবে বিজয়ী হয়েছেন। একাত্তর ও পঁচাত্তরের ঘাতকচক্রকে পরাজিত করে বা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বেনিফিশিয়ারিদের পঙ্গু করে দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিশ্বরাজনীতিতে যেমন নিজের নেতৃত্বের জায়গা করে নিয়েছেন; তেমনি প্রমাণ করেছেন আপনার বিকল্প আপনি নিজেই।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! দলীয় সভায় আপনি বার বার বলেছেন, আপনার বয়স হয়েছে, নতুন নেতৃত্ব দলকে খুঁজে নিতে হবে। আপনার পরে কে হবেন আপনার উত্তরাধিকার? তা সময়ই নির্ধারণ করে দেবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যে মেধা, রণকৌশল, বুদ্ধিমত্তা, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা নিয়ে রাজনীতির দাবা খেলায় আপনি একের পর এক কিস্তিমাত করে যাচ্ছেন, জনগণের শক্তির ওপর নেতৃত্বের যে শক্তির ওপর বাস করছেন; তার দিকে তাকিয়ে আপনার শত্রুরাও বলবে, ‘শেখ হাসিনার বিকল্প দলেই নয়; দেশেই দৃশ্যমান নয়। এখনো আপনি দিনে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করেন। সাম্প্রতিক সময়ে ষড়যন্ত্রকারীরা গোটা দেশকে নানা গুজবে ভাসিয়েছিল। পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে- এমন গুজব ছড়াতেও কার্পণ্য করেনি। বঙ্গবন্ধু যখন তার গলব্লাডার অপারেশনের জন্য বিদেশ গিয়েছিলেন; তখন যেমন ষড়ন্ত্রকারীরা গুজব রটিয়েছে, তেমনি আপনি চোখের অপারেশনের জন্য লন্ডন গেলে তারা গুজবেই মেতেছিল। সে সময় যেমন দেশের মানুষ নেতার অনুপস্থিতিতে নিজেদের এতিম-অসহায় মনে করেছে; তেমনি আপনার লন্ডন সফরকালে আপনি নিয়ত দেশের খোঁজ রাখলেও আপনার মন্ত্রীদের অতিকথন, বিরূপ মন্তব্য, মেয়রদের ভূমিকা মানুষকে এক অসহায় অবস্থায় ফেলেছিল ডেঙ্গু ও বন্যা আক্রান্ত সময়ে।

এমনি পরিস্থিতিতে আপনার শাসনামলে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে যেমন বাংলাদেশ মামলায় জিতেছে, তেমনি আপনার নেতৃত্বের কারণে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যার সমাধান ঘটেছে। দেশকে আপনি উন্নয়নের মহাসড়কে তুলেছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার অর্থনৈতিক উন্নয়নে পশ্চিমারা এখন বিস্মিত হয়ে এ দেশকে দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান বাঘই নয়; উন্নয়নের রোল মডেল বলছে। কিন্তু এত এত মেগা প্রকল্প দ্রুত সম্পন্ন করার চ্যালেঞ্জ যেমন আপনাকেই নিতে হবে; তেমনি সুশাসন নিশ্চিতেও আপনাকেই ভূমিকা রাখতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে আপনার সাহসী অভিযান বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে শান্তির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আপনার হাত ধরেই একদিন পাহাড়ে শান্তি এসেছিল। তেমনি আপনার হাত ধরেই সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্যের পর আমাদের তরুণ প্রজন্মকে রক্ষায় মরণ নেশা ইয়াবার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যুদ্ধ প্রশংসিত হচ্ছে। মাদক ও ইয়াবার সঙ্গে আপস হতে পারে না। আপনি নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী দুর্নীতির বিরুদ্ধেও অভিযান শুরু করেছেন। দুদকের অভিযানে অনেক দুর্নীতির বরপুত্র আটক হচ্ছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের কোনো কোনো কর্তাও ধরা পড়ছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনকে কীভাবে স্বচ্ছ, সৎ, সাহসী, দক্ষ অফিসারদের আরও যুক্ত করে সাঁড়াশি অভিযান ঘটানো যায়; তা বিবেচনায় নেওয়ার সময় এসেছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! রাজনীতিতে একটা গুঞ্জন উঠেছে যে, দল ও সরকারকে নাকি আলাদা করা হবে। ভারতে কংগ্রেসকে দুই দফায় ক্ষমতায় এনে সোনিয়া গান্ধী তা করেছিলেন। এ দেশে একসময় একদল গণবিচ্ছিন্ন প-িত আপনাকেও সোনিয়ার ভূমিকায় দেখতে চেয়েছিলেন। সোনিয়া-অক্সফোর্ডের মনমোহন সিং আর কুলীন পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত সালমান খুরশিদদের দিয়ে সরকার চালাতে গিয়ে লং টার্মে আজ দেখা যাচ্ছে, ভারতের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুরোধা কংগ্রেস হিন্দুত্ববাদের উগ্রশক্তিনির্ভর বিজেপির কাছে করুণ পরাজয় বরণ করেছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! জ্ঞানে, গরিমায়, রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আপনার টানা ৩৯ বছরের রাজনৈতিক আসন অনেক বেশি অভিজ্ঞতার। আপনি অনেক বেশি জানেন এবং বোঝেন। একজন বরেণ্য রাজনীতিবিদকে জানতে হয় সবার আগে মানুষের ভাষা। বঙ্গবন্ধুর পর আপনি জেনেছিলেন বলেই আমাদের মহান নেতা রাজনীতিতে যেমন সফল হয়েছিলেন; আপনি রাষ্ট্রক্ষমতায়ও সফল হয়েছেন। গোটা সমাজ এখন মূল্যবোধের অবক্ষয়ে পতিত। লাভ আর লোভের হিসাবের অস্থিরতায় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অস্থির, হয়রান হয়ে রাজনীতিকে রাজদুর্নীতিতে পরিণত করেছে। বঙ্গবন্ধু যেমন অনেক আকুতি-মিনতি করেছিলেন; তেমনি আপনিও বার বার রাজনীতি ত্যাগের ও মানবকল্যাণের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলছেন না। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারকে রাজনৈতিক নেতৃত্বনির্ভর হতে হয়। রাজনীতি ও সরকার আলাদা করলে মানুষ ক্ষমতার পেছনে ছোটে; দল সেখানে দুর্বল ও ভঙ্গুরই হয় না; মাঠের কর্মীরা শৃঙ্খলাভঙ্গ করে অনেকের ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ারে পরিণত হয়। এতে দল দুর্বল হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন সরকারে দুর্বল হয় তখন আমলাতন্ত্রের দাপট প্রবলভাবে বেড়ে যায়। দলের বিপদে এই আমলাতন্ত্র বিশেষ করে একদল পুলিশ কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তার মধ্যে উন্নাসিক দলীয় কর্মীর মতো দাম্ভিক আচরণ দেখা দেয়, যা সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন করে। জনগণের সঙ্গে সরকারের দূরত্বই শুধু নয়, গণঅসন্তোষও তৈরি করে। কোরবানি ঈদের চামড়া সিন্ডিকেটের পর বাণিজ্যমন্ত্রীর মন্তব্য কিংবা ডেঙ্গু নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কৌতুকপ্রিয়তা অথবা আরও কিছু মন্ত্রীর অতিকথন মানুষের মনে স্বস্তির বদলে ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আপনার দলের অভিজ্ঞদের নিয়ে ’৯৬, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে যে সরকার গঠন করেছিলেন; প্রশাসনের ওপর তারা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রীরা হবে মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী; সচিব নয়। তারা আপনার কাছেই জবাবদিহি করবেন, সংসদীয় কমিটির কাছেও। দলকে সুসংগঠিত, শৃঙ্খলিত ও শক্তিশালীকরণে দলের অভিজ্ঞ, দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে মন্ত্রিসভায় যুক্ত করে তা ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। আপনি গণতন্ত্রের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। আওয়ামী লীগকে যেমন দলীয় শৃঙ্খলা ও সাংগঠনিক শক্তি সুসংগঠিত করতে এবং জনমত পক্ষে রাখতে সাংগঠনিক কর্মকা- থেকে দেশজুড়ে জনসভায় যেতে হবে; তেমনি দেশের গুমোট আবহাওয়া নির্বাসনে পাঠাতে বিরোধী দলকেও সেই সভা-সমাবেশের অবাধ সুযোগ দেওয়ার ভীষণ প্রয়োজন। অন্যদিকে আমলাতন্ত্রের লাগাম একটু টেনে ধরা দরকার। বিএনপির কয়েকজন সংসদ সদস্য ছাড়া বাকি সব সংসদ সদস্য সরকারি দলেরই হোক আর বিরোধী দলেরই হোক; সবাই আপনার ক্ষমতা ও ইমেজের ওপর ভর করে এসেছেন। তাদের সবার আমলনামা যেমন সামনে নিয়ে আসা উচিত; তেমনি দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে নিজ দলের মন্ত্রী, এমপি, দলীয় নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদেরও নজরবন্দি করে যারা প্রকৃতপক্ষে অপরাধী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। দেশের অর্থনৈতিক খাতে যারা লুটপাট করেছেন, বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন, রাতারাতি অবৈধ বিত্ত-বৈভব গড়েছেন, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা যেমন জরুরি; তেমনি সব মহলকে এসব পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে এই কড়া বার্তা দিতে হবে যে, সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। অপরাধী যেই হোক, দলের যত বড় নেতাই হোক; তাকেও শাস্তি পেতে হবে। এতে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস যেমন ফিরে আসবে; তেমনি সবাই আইনের প্রতি নত হতে শিখবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আপনি অনেকবার বলেছেন, আপনার দলের সাধারণ সম্পাদকও বলেছেন; বিএনপি-জামায়াতের অনেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেছেন। গণমাধ্যম অনেক সময় তাদের চিহ্নিতও করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত তাদের তালিকা তৈরি করে দল থেকে বের করে দেওয়ার এবং যারা নিজের পাল্লা ভারী করতে অবাঞ্ছিতদের এনেছেন তাদের বিরুদ্ধে সংগঠন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ১৯৭৫ থেকে ’৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দলের মহাদুঃসময়ে যারা আপনার পাশে থেকেছেন, মাঠে-ময়দানে লড়াই করেছেন; তাদের নিয়েই সরকার ও দলকে শক্তিশালী রূপ দেওয়া প্রয়োজন। এমনকি গণবিরোধী বা জনঅসন্তোষ নিয়ে কেউ যদি আপনার পাশেও থাকেন, কেউ যদি সরকারে বা দলেও থাকেন; সেসব বিতর্কিতকে সরিয়ে গ্রহণযোগ্য, বিশ্বস্ত ও দক্ষদের সেসব জায়গায় প্রতিষ্ঠা করার সময় দরজায় কড়া নাড়ছে।

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার গণহত্যার মুখে ছুটে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে মানবিক হৃদয় দিয়ে আপনি আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেসব শরণার্থী আজ রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাখো মানুষের সমাবেশ করছে। তাদের মধ্যে বিদেশনির্ভর এনজিও-রাজনীতি প্রবেশ করেছে। এদের ফিরিয়ে দিতে গোটা দেশের জনগণের সমর্থন নিয়ে আপনি যে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছেন তা আরও জোরদার করা প্রয়োজন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আত্মাজুড়ে যে মহান বঙ্গবন্ধুকে লালন করি; সেই জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে এককালের মুজিববিদ্বেষী থেকে আপনার কঠোর সমালোচকই নয়; দেশের চিহ্নিত রাজাকারের সন্তানদেরও দেখা যাচ্ছে। এটা আমাদের মহান নেতার আত্মাকে কষ্ট দেবে কিনা জানি না; তবে তাঁর রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। যারা এটি করছেন তাদের ডেকে বলার দায়িত্ব আপনার। সমাজ শুধু লোভ ও লাভের নেশায় রাতারাতি বিত্ত-বৈভব গড়ার অস্থির প্রতিযোগিতাতেই ভাসেনি, বিভিন্ন জেলায় জনবিচ্ছিন্ন লুটেরা স্থানীয় নেতারা যেমন গানম্যান নিয়ে মিছিল করছেন; তেমনি সমাজের সর্বক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা এমনকি মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার শিক্ষক থেকে শুরু করে আধুনিক শিক্ষার শিক্ষক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সিরিজ ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে ধন্যবাদ। এদের সঙ্গে সঙ্গে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। শিশু থেকে নারী ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

          লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

 

 

সর্বশেষ খবর