বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

গণতন্ত্রের ওপর আন্তর্জাতিক জরিপ

এ কে এম শহীদুল হক

গণতন্ত্রের ওপর আন্তর্জাতিক জরিপ

ডালিয়া রিসার্চ জার্মানির একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ২০১৩ সালে এর যাত্রা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও বাণিজ্যসংক্রান্ত বিষয়ে বার্ষিক গবেষণা করে এবং হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করে। Rasmussen Global কোপেনহেগভিত্তিক একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালে এটি ডেনমার্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও NATO -এর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল Anders Fogh Rasmussen প্রতিষ্ঠা করেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনীতি, কূটনীতি, যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয়ে জরিপ করে।

Dalia Reaserch, Rasmussen Global-এর সহায়তায় গণতন্ত্র সম্পর্কে নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি জানার জন্য একটি আন্তর্জাতিক জরিপ করে। ১৮ এপ্রিল থেকে ৬ জুন, ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জরিপ চলে। ৫৪টি দেশের ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮৭০ জন নাগরিকের অনলাইনে অথবা টেলিফোনে ইন্টারভিউ নেওয়া হয়। ৫৪টি দেশের মোট জনসংখ্যা বিশ্বজনসংখ্যার ৭৫%। ৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নেই। জরিপে বিভিন্ন দেশের ২ হাজার থেকে ৪ হাজার নাগরিকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। জরিপে ৫টি প্রশ্নের মাধ্যমে নাগরিকদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

প্রথম প্রশ্ন ছিল-  জনগণ কি মনে করে গণতন্ত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ? (Do people think that democracy is important?)

এ প্রশ্নের জবাবে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ অর্থাৎ ৭৯% লোক বলেছেন তাদের দেশের জন্য গণতন্ত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিসের ৮২% (সর্বোচ্চ) ও ইরানের ৫৫% (সর্বনিম্ন) লোক গণতন্ত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মত দিয়েছেন। স্বস্তির বিষয় যে, ৭৯% মানুষ গণতন্ত্রের পক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু বাকি ২১% লোক কেন গণতন্ত্রের পক্ষে নেই, তাও ভাবনার বিষয়। প্রত্যেক নাগরিকেরই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চাওয়া উচিত, যেখানে তার মূল্যায়ন হবে, তার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত হবে। ওই ২১% লোকের গণতন্ত্র সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই হয়তো তারা গণতন্ত্রের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। ইরানের ৪৫% লোক মনে করেন তাদের দেশের জন্য গণতন্ত্র বিশেষ একটা গুরুত্ব বহন করে না। বিশ্বের ৭৫% লোকের মধ্যে ২১% লোক গণতন্ত্রকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এর কারণ গবেষণায় উঠে আসেনি। এ বিষয়েও গবেষণা করা প্রয়োজন।

দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল-  জনগণ কি মনে করে তাদের দেশ গণতান্ত্রিক? (Do people think their countries are democratic?)

এ প্রশ্নের উত্তরে পৃথিবীর শতকরা ৫৫ ভাগ বলেছেন, তাদের দেশ গণতান্ত্রিক। নিশ্চয়ই বাকি শতকরা ৪৫ ভাগ নাগরিকের মতে তাদের দেশ গণতান্ত্রিক নয়। সুইজারল্যান্ডের ৭৮% (সর্বোচ্চ) ও ভেনেজুয়েলার ২০% (সর্বনিম্ন) মানুষ মনে করেন তাদের দেশ গণতান্ত্রিক। বাকিরা তাদের দেশকে গণতান্ত্রিক মনে করেন না। বিশ্বের শতকরা ৪১ ভাগ লোক মনে করেন তাদের দেশ পুরোপুরি গণতান্ত্রিক নয়। মজার ব্যাপার হলো, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে খ্যাত দেশগুলোয় বসবাস করেন এমন নাগরিকের গড়ে ৩৮% মনে করেন তাদের দেশে পর্যাপ্ত গণতন্ত্র নেই।

গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে খ্যাত যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত ইত্যাদি দেশের গড়ে ৫৫% নাগরিক বলেছেন তাদের দেশ গণতান্ত্রিক। বাকি ৪৫% নাগরিক মনে করেন তাদের দেশ গণতান্ত্রিক নয়। গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকদের নিজ দেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গণতন্ত্রের জন্য শুভসংবাদ নয়। জরিপে এর কারণ সম্পর্কে কোনো তথ্য না থাকলেও এটা বুঝতে বাকি থাকে না যে, জনগণ তাদের নির্বাচিত সরকারের কর্মকান্ডে সন্তুষ্ট নয়।

ডালিয়া রিসার্চের মতে গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে এটা বলা যাবে না যে, জনগণ গণতন্ত্রের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। বরং তারা অধিকতর গণতন্ত্র চাচ্ছে।

গবেষণায় আরও বেরিয়ে আসে পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে অনেকেই মনে করে-  ১. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ২. বৈশ্বিক অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান  ৩. যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ গণতন্ত্রের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কিন্তু পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশের অনেক নাগরিকই মনে করেন এসব factor গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। অস্ট্রিয়ায় ৪৩%, কানাডায় ৪৩%, যুক্তরাষ্ট্রে ৪২% ও অস্ট্রেলিয়ায় ৪১% নাগরিক মনে করেন সোশ্যাল মিডিয়া গণতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

গ্রিসের ৬৪%, ইতালির ৬১%, জার্মানির ৫৬%, ফ্রান্সের ৫৫% ও বেলজিয়ামের ৫৩% নাগরিক মনে করেন ব্যাংক ও অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব রাখে।

অস্ট্রিয়ার ৬৬%, জার্মানির ৬২%, ডেনমার্কের ৫৯%, সুইজারল্যান্ডের ৫৮% ও কানাডার ৫৮% মানুষ মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ গণতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ডালিয়া রিসার্চ ৬ থেকে ১৮ জুন, ২০১৮ পর্যন্ত ৫০টি দেশের ১ লাখ ২৫ হাজার একই ধরনের গবেষণা জরিপ করেছিল। সে জরিপেও গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে। প্রশ্ন ছিল-  আপনি কি মনে করেন জনগণের মতামত রাজনীতিতে গুরুত্ব পায়? (

(Do you feel that the voice of people like you matters in politics?)

এ প্রশ্নের উত্তরে যুক্তরাজ্যের ৫০%, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৯%, মালয়েশিয়ার ৫১%, কানাডার ৫০%, সিঙ্গাপুরের ৫৭%, ইতালির ৫৭%, সুইডেনের ৫৫%, সুইজারল্যান্ডের ৪৫.৫, পাকিস্তানের ৪৫%, ভারতের ৪৪%, রাশিয়ার ৪৪%, চীনের ৪৩%, জার্মানির ৬০%, ফ্রান্সের ৬২%, ও জাপানের ৭৪% নাগরিক বলেছেন ‘কখনো না অথবা কদাচিৎ’ Never or Rarely).

অপর প্রশ্ন ছিল- আপনি কি মনে করেন আপনার দেশের সরকার আপনাদের স্বার্থে কাজ করছে? ((Do you feel that your government is acting in your interest?)  এ প্রশ্নের উত্তরে অধিকাংশ দেশের নাগরিকের জবাব ছিল- ‘কখনো না বা কদাচিৎ’ (Never or Rarely)। এমন দেশের মধ্যে অস্ট্রিয়ার ৭৩%, সুইডেনের ৭০%, জাপানের ৬৭%, অস্ট্রেলিয়ার ৬৭%, কানাডার ৬৭%, যুক্তরাষ্ট্রের ৬৬%, যুক্তরাজ্যের ৬৪%, সিঙ্গাপুরের ৬৪%, ইতালির ৬৩%, সুইজারল্যান্ডের ৬১%, পাকিস্তানের ৪৯%, ইন্দোনেশিয়ার ৪৭%, রাশিয়ার ৪৬%, ভারতের ৫২%, নাগরিক মনে করেন তাদের দেশের সরকার জনগণের স্বার্থে ‘কখনো না কিংবা কদাচিৎ’ কাজ করে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ও কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত দেশগুলোর জনগণের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ নাগরিক মনে করেন তাদের দেশের সরকার তাদের স্বার্থে কাজ করে না।

জরিপে গণতন্ত্র সম্পর্কে নাগরিকদের মূল্যায়নে বিভিন্ন দেশের সরকার কর্তৃক গণতন্ত্রচর্চার ক্ষেত্রে বিচ্যুতি ও বিচ্ছুরণের বিষয়টি উঠে এসেছে। জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, অধিকাংশ দেশের প্রায় ৪০% লোক তাদের দেশের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের প্রতি বিরূপ ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন এ অবস্থা? এর জবাব এক কথায় পাওয়া যাবে না। একেক দেশের জনগণের মনমানসিকতা, চিন্তাভাবনা, গণতন্ত্র সম্পর্কে মূল্যায়ন, সামাজিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, গণতন্ত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞতা এবং সরকারের আচরণ, কর্মকা- ও সরকারের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা একেক রকম। জরিপের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত আহরণে এই factor গুলো প্রভাব ফেলেছে। তবে এটা বলা যায় যে, সব সরকারই মানুষের প্রত্যাশা ও চাহিদা পুরোপুরি পূরণ করতে পারে না। কোনো রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় আসে তখন তাকে দেশের প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থা, নীতিমালা ও কর্মপদ্ধতির মধ্যে কাজ করতে হয়। সরকারকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অনেক বিষয় ও নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে চলতে হয়। সরকার যা ইচ্ছা তা করতে পারে না। সম্পদের সীমাবদ্ধতা তো অবশ্যই থাকে। সরকার তো আর রাতারাতি বিপ্লব ঘটাতে পারে না। সে ঝুঁকিও কেউ নেয় না। বিরোধী দলে থাকলে যেভাবে দাবি-দাওয়া করা যায়, সরকারে গেলে তা পূরণ করা খুবই কঠিন। কিন্তু সাধারণ মানুষ এত কিছু বুঝতে চায় না। সরকারের কাছে তাদের প্রত্যাশা অনেক। এখানেই সরকার ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যায়। তাই জনগণের একাংশের মধ্যে সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়।

আবার কিছু কিছু নির্বাচিত সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচরণ ও কর্মকান্ডের জন্য জনগণ বিগড়ে যায় এমন উদাহরণও আছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হলেও সরকার গঠন করার পর কোনো কোনো সরকারের মধ্যে একটা কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার জন্ম হয়। তারা নিজেদের স্বার্থে নিজস্ব আদলে প্রশাসন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে। তাদের এরূপ কর্মকান্ড নিরপেক্ষ ও নিখুঁত বিচারে গণতান্ত্রিক অনুশীলনের ও প্রচলিত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিচ্যুতি বলে সচেতন মহল মনে করে। এভাবে অন্যের মতামত তোয়াক্কা না করে নিজের একক সিদ্ধান্ত ও মতামতের ভিত্তিতে কাজ করায় সরকারবিরোধী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। এ কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারবিরোধী বিমূর্ত উপলব্ধি ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়। জরিপকালে পাবলিক পারসেপশনে তারই প্রতিফলন ঘটে।

প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। জনগণের আত্মতুষ্টি থাকে। নাগরিকরা নিজেদের সম্মানিত বোধ করেন। অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমনে অসন্তুষ্টি থাকে। দেশের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। ফলে জননিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা হুমকির মধ্যে পড়ে। উন্নয়ন কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হয়। ধীরে ধীরে মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে এবং আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে চায়। প্রতিটি দেশে যাতে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে যার মধ্যে নাগরিকদের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন হয় এটাই গণতন্ত্রকামী সব নাগরিকের একান্ত কাম্য হোক।

লেখক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ।

সর্বশেষ খবর