রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আমলা কেলেঙ্কারি ও প্রতিশোধের রাজনীতি

নঈম নিজাম

আমলা কেলেঙ্কারি ও প্রতিশোধের রাজনীতি

সদ্যবিদায়ী একজন জেলা প্রশাসকের প্রেম-ভালোবাসার ভিডিও নিয়ে তোলপাড় চলছে ডিজিটাল দুনিয়ায়। উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে এমন গসিপিং নতুন কিছু নয়। পাকিস্তান আমলে সিএসপিদের নানামুখী প্রেমকাহিনি ছিল। এমনকি কেউ কেউ মামি-চাচিকে বিয়ে করেও হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। তেমন একজন কর্মকর্তা পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন। বগুড়ায় থাকাকালে তিনি কান্ডটি ঘটান। ব্যুরোক্র্যাসির এসব কান্ড তাদের চারপাশের মানুষই ছড়িয়ে দেয় সমাজে। শুধু বাংলাদেশ, পাকিস্তান নয়, ব্রিটিশ আমলেও ব্যক্তিগত গুজব ও প্রেম নিয়ে শোরগোল উঠত মাঝে মাঝে। ব্রিটিশ শাসনকালে একবার তো ভারতবর্ষে এক কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীকে নিয়ে আলোচনা এই ভূখন্ড ছাড়িয়ে ইংল্যান্ডেও গড়ায়। আলোচিত সেই আমলার নাম ছিল মেহেদী হাসান। তার স্ত্রীর নাম এলেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ। আর মেহেদী ছিলেন রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব। এর আগে বিচারপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বনেদি পরিমন্ডলে চলাফেরা ছিল তার। এর মাঝে খবর ছড়ায়- রানী ভিক্টোরিয়ার দরবারে দাওয়াত খেয়ে ফিরেছেন মেহেদী ও এলেন। এ খবর বাকি ভারতীয় বন্ধুদের কেন ভালো লাগবে? ব্যস, ঈর্ষান্বিত বন্ধুরা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিলেন এ দম্পতিকে আর সামনে যেতে দেওয়া যায় না। তাদের টাইট দিতে হবে। যেই চিন্তা সেই কাজ। কিন্তু মেহেদীকে নিয়ে তন্ন তন্ন করে কেউ কিছু পায়নি। তাই শেষ অস্ত্র মেহেদীর স্ত্রী এলেন। ইংরেজ নারীকে নিয়ে সস্তা কিস্সা খুব সহজে জমাতে সুবিধা। এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি। নিন্দুকেরা প্রকাশ করল একটি পুস্তিকা। পুস্তিকার বিষয়বস্তু এলেনের কেলেঙ্কারি। উচ্চবিত্তদের সান্ধ্য আড্ডার রসালো বিষয়। সময়টা ১৮৯২ সাল। ইংরেজিতে লেখা আট পৃষ্ঠার পুস্তিকা মুহূর্তে ছড়িয়ে যায় সমাজের এলিট শ্রেণির মাঝে। পুস্তিকার রটনায় লেখা হলো- বিয়ের আগে মেহেদীর স্ত্রী এলেন লন্ডনে পতিতা ছিলেন। মেহেদী একজন পতিতাকে নিয়ে আসেন ভারতে, কিন্তু বিয়ে করেননি। বিয়ে ছাড়াই দুজনে বসবাস করছেন। আর সমাজের উচ্চবিত্ত ও ইংরেজদের কাছে এলেনকে পাঠিয়ে মেহেদী দাপুটে অবস্থান তৈরি করেছেন।

স্তম্ভিত হন মেহেদী। এ বইয়ের সত্যতা চ্যালেঞ্জ করে মামলা করে বসলেন। অবশ্য তার আপনজনেরা পরামর্শ দিয়েছিলেন এ বইয়ের কোনো কিছু পাত্তা না দিতে। বাস্তবে গসিপিংকে পাত্তা না দেওয়াই ভালো। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ইগোতে লাগে এই আমলার। মামলা চলতে থাকে ব্রিটিশ বিচারপতির কোর্টে। বইয়ের প্রকাশকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করেন স্বরাষ্ট্র সচিব মেহেদী হাসান। আদালতে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি শুরু হয়। ব্রিটিশ ভারতের মিডিয়ার চোখ পড়ে। ব্যস, আর যায় কোথায়? ব্রিটিশ মিডিয়া মামলার রগরগে বর্ণনা প্রকাশ শুরু করে প্রতিদিন। হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড! অভিজাত শ্রেণির চোখ অপেক্ষা করত পত্রিকার পাতায় মেহেদীর দায়ের করা মামলার খবরগুলো পড়ার জন্য। স্ত্রী এলেনের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে আদালতে মেহেদী বলেন, সব অভিযোগই মিথ্যা। তার বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে প্রকাশক বিশেষ মহলের স্বার্থ হাসিলে পুস্তিকাটি প্রকাশ করেছেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালত বইয়ের প্রকাশককে রেহাই দেন। মেহেদীর আবেদন খারিজ হয়ে যায়। হতাশায় ভেঙে পড়েন এই দম্পতি। এর মাঝে চাকরি হারান মেহেদী। রাজ্য ও ব্রিটিশ সরকার তার পাশে দাঁড়ায়নি। মনের দুঃখে এই দম্পতি হায়দরাবাদ ত্যাগ করে চলে যান লখনৌ। কিন্তু চাকরি জীবনের শেষ পেনশনও দেওয়া হয়নি মেহেদীকে। হতাশায় বঞ্চনায় ব্যথিত মেহেদী জীবনের মায়া ত্যাগ করে চলে যান। স্বামীর মৃত্যুর পর বাকি জীবন অনেক কষ্টে অতিবাহিত করেন এলেন। ভারতীয় আমলাকে বিয়ে করার পরিণতি ভালো হয়নি তার জীবনে। শেষ মুহূর্তে না পেলেন নিজ জাতির সহায়তা, না পেলেন ভারতীয়দের। আর ইংরেজদের চাকরি করে কংগ্রেসের বিপক্ষে কথা বলায় ভারতীয়দের সহানুভূতিও ছিল না মেহেদীর জন্য।

মানুষের জীবনটা আসলেই অদ্ভুত। এ অদ্ভুত জীবনে আমাদের কত ধরনের লড়াই করে কাটাতে হয়। অনেক সময় আমরা সুখের জন্য লড়াই করে অসুখকে ডেকে আনি। মনের স্বস্তির জন্য অস্বস্তিকে আশ্রয় দিই। সুখ, স্বপ্ন ও বাস্তবতা আসলেই আলাদা। যশ, খ্যাতি, অর্থ-বিত্ত কোনোটাই সুখ এনে দিতে পারে না। আর কোনো কিছুর স্থায়িত্বও দীর্ঘ সময় থাকে না। আজকের রাজা কাল ক্ষমতাহারাও হতে পারেন। ইতিহাস তাই বলে। এ কারণে ক্ষমতা হারানোর কষ্ট অনেকে তুলে ধরেছেন আর্তনাদের মাঝে। আক্ষেপ আর কষ্ট নিয়ে শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর নির্জনে জীবনের শেষ সময়টুকু কাটিয়েছিলেন। সম্রাটের শেষ সময়টা ছিল বড় কষ্টের। সারা জীবন ভোগবিলাসে থাকা মানুষটিকে ব্রিটিশ বেনিয়ারা বন্দী করে নির্বাসনে পাঠায় বার্মার (মিয়ানমার) রেঙ্গুনে। সম্রাট বাহাদুর শাহের মাজার আমি জিয়ারত করেছি। আমি অনেকক্ষণ মাজারের চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখি। দেয়ালের লেখনীগুলো পড়ি। মনে হলো, প্রতিটি ইট-পাথরের আড়ালে লুকিয়ে আছে দীর্ঘশ্বাস। নির্বাসনের আর্তনাদ। শেষ মুহূর্তের অশ্রু আর কষ্টের আহাজারি। ভারতের বাদশাহ কবরের জমি পাননি নিজের শহর দিল্লিতে। তাই তো বেদনার নীল কালির রক্তক্ষরণে বাহাদুর শাহ লিখেছিলেন, ‘কিতনা বদ নসিব হ্যায় জাফর, দাফনকে লিয়ে দু গজ জমিন ভি না মিলি কু ইয়ারমে।’ অর্থাৎ ‘কী দুর্ভাগ্য হে জাফর, তোমার ভালোবাসার জমিনে তোমার সমাধির জন্য দুই গজ জায়গা হলো না।’ অবশ্য মৃত্যুর পরে বাহাদুর শাহ তার সম্মান কিছুটা পান। নেতাজি সুভাষ বসু বাহাদুর শাহের মাজার থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের শপথ নেন। আর রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বাহাদুর শাহের মাজারে গিয়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য তার অবদানকে বড় করে তুলে ধরেন। ইতিহাস তার আপন গতিতেই চলে। বাহাদুর শাহ মোগলদের শেষ ইতিহাস। নির্বাসন থেকে সেই ইতিহাসে অসহায়ভাবে আর্তনাদ করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। ক্ষমতার মসনদে বসার সময় বাহাদুর শাহ কি জানতেন তার এই পরিণতি হবে? আমরা কেউই নিজেদের আগামীর কথা জানি না। জাগতিক মোহ আমাদের কোনো কিছু মনে করতে দেয় না। তবু আমরা নিজেদের জাগতিক সুখের জন্য চারপাশকে ধ্বংস করে এগিয়ে চলি। এই এগিয়ে চলায় অনেক সময় স্বাভাবিকতাও থাকে না। আপন-পর থাকে না। চারপাশকে ধ্বংস করার মাঝেই যেন এক ধরনের আনন্দ। নিষ্ঠুরতার শোধ-প্রতিশোধের এক খেলা। যা সব সময় তছনছ করে দেয় চারপাশ।

প্রতিশোধের রাজনীতির সর্বশেষ চিত্র দেখলাম এবার ভারতীয় রাজনীতিতে। ভারতের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমকে আটক নিয়ে অনেক নাটক হলো। এই নাটকের স্ক্রিপ্ট অনেক আগে তৈরি। চিদাম্বরম ছিলেন কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকাকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আর ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ছিলেন তখন গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই সময় সন্ত্রাসের অভিযোগে আটক একজনকে ক্রসফায়ারে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগে আটক করা হয় অমিত শাহকে। আটকের আগে অমিত শাহ তখন তিন দিন পালিয়ে ছিলেন। তিন দিন পর নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে তিনি আসেন সংবাদ সম্মেলন করতে। ব্যস, আর যায় কোথায়? পুলিশ সাংবাদিকদের সামনে থেকেই আটক করে অমিত শাহকে। আটকের পর তিন মাস কারান্তরিন ছিলেন অমিত শাহ। তারপর ছাড়া পেয়ে মানুষের সামনে এসে বক্তব্য দেওয়ার সময় অটল বিহারি বাজপেয়ির একটি কবিতা তিনি আবৃত্তি করেন। সেই কবিতাটি সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছিল। কবিতাটি হলো-

‘ম্যারা পানি উতারনা দেখ

কিনারে পর ঘর মাত বানা লনো

ম্যায় সমুন্দর হু

লোটকর জরুর আউঙ্গা’

অর্থাৎ

‘পানি থেকে আমাকে উঠতে দেখো

নদীতীরে ঘর বানিয়ো না,

আমি এক সমুদ্র

অবশ্যই আমি ফিরে আসব।’

অমিত শাহ ফিরে আসেন। ব্যাপক দাপট নিয়েই আসেন। এসেই তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মসনদে বসে অতীতকে নতুন করে টেনে আনেন। তিনি শোধ নেন সেই আটকের। এই রাজনীতি আমাদের দেশেও আছে। প্রতিশোধের খেলা থেকে আমরা বের হতে পারি না। ওয়ান-ইলেভেনের সময় এক রাজনীতিবিদকে একবার বলেছিলাম, আপনারা দুটি দলই বর্তমান থেকে শিখবেন। আগামীকে ধারণ করবেন। নোংরা, নষ্ট রাজনীতি আর দেখতে চাই না। আশা করি কেউই করবেন না। জবাবে সেই রাজনীতিবিদ বলেছিলেন, আমরা মোটেও সংশোধন হব না। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়াই ইতিহাসের শিক্ষা। রাজনীতিতে এখন যা ঘটছে আগামীতেও তাই ঘটবে। কারণ হিংসা-প্রতিহিংসার রাজনীতি সব সময়ই ছিল, এখনো আছে। এ উপমহাদেশের অনেক ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি বার বার রয়েছে। খারাপ লাগে এখনকার বিশ্বের দিকে তাকালেও। ধর্ম, বর্ণ আর প্রতিহিংসার হিসাব-নিকাশের লড়াই চলছে বিশ্বজুড়ে। দুই দিনের দুনিয়ায় আমরা বড়  একটা সময় কাটিয়ে দিই ঝগড়া-বিবাদ আর চাওয়া-পাওয়াতে। সব দেখে মনটা ভেঙে যায়। আজকাল কোনো কিছুতে স্বস্তি পাই না। মানুষের অহংকার, দুর্নীতি, লুটপাট আর শিষ্টাচারবহির্ভূত বাড়াবাড়ি দেখে ভালো লাগে না। কোথাও যেন অশান্তি বাসা বেঁধেছে মনের গোপন আয়নাতেও।

সেদিন অফিসে বসে সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা একটি ভিডিও দেখছিলাম। বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত একজন নারী কর্মকর্তা নিজের চেয়ারে বসে কাজ করছেন। কম্পিউটারে তার নজর। এ সময় একজন নারী আগন্তুক এসে বসলেন তার সামনে। কথা খুব একটা শুরু হয়নি তখনো। আগত ক্লায়েন্টও অপেক্ষা করছেন। হঠাৎ এই কর্মকর্তা একটু পানি খেলেন। তার চোখে-মুখে অস্বস্তি, ক্লান্তি। এরপর মুহূর্তের মধ্যে তিনি ঢলে পড়লেন টেবিলের ওপর। সহকর্মীরা দৌড়ে এলেন। ধরতেই পড়ে গেলেন ফ্লোরে। বোঝা গেল সব শেষ। সহকর্মীরা হাসপাতালে নেওয়ার সুযোগ পেলেন না। ভিডিওটি দেখার পর রাতে আর ঘুমাতে পারিনি। কত সহজ এই মৃত্যু! অথচ আমরা বুঝতে চাই না। সারা দুনিয়া আমাদের কাছে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মুহূর্তেই সব শেষ হয়ে যেতে পারে এই ভাবনাটুকুও কাজ করে না। সমরেশ মজুমদার লিখেছেনÑ ‘মৃত্যু কি সহজ, কি নিঃশব্দে আসে অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়।’ গর্বের কিছু নেই। চলে গেলে পার্থিব দুনিয়ার কিছুই আর থাকে না। মানুষ একাই আসে, একাই চলে যায়। সঙ্গে কেউই যায় না। কিছুই থাকে না। মৃত মানুষের নামাজে জানাজা কিংবা শোকের বাড়িতেও মানুষ ব্যস্ত থাকে নিজেদের আলোচনাতেই। কারণ, যিনি মারা গেছেন তিনি তখন সবার কাছেই লাশ। মানুষ আর নন। লাশকে দ্রুত দাফন করে সবাই ফিরতে চায় আপন আনন্দ ভুবনে। এই ভুবনে বিদায়ী মানুষের আর ঠাঁই থাকে না। কবি নাজিম হিকমত বলেছেন, ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।’ বাস্তবে এ আয়ু এখন মাসও পার হয় না। মানুষ ভুলে যায় সবকিছু। বর্তমান হয়ে যায় অতীত।

 লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর