রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

তাদের ভোলেনি কেউ

মোশাররফ হোসেন মুসা

তাদের ভোলেনি কেউ

কথিত আছে- দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার চেয়ে খুন হয়ে মরা ভালো। কারণ, দুর্ঘটনার খবর মানুষ দ্রুত ভুলে যায়। কিন্তু খুনের ঘটনাটি দীর্ঘদিন আলোচনায় থাকে। গত বছর ৩১ আগস্ট চলনবিলে বেড়াতে গিয়ে এক অপ্রত্যাশিত নৌকাডুবিতে পাঁচজনের অকালমৃত্যু ঘটে। দুর্ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়েছে, সে হিসেবে মানুষ তাদের ভুলে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঈশ্বরদীবাসী এক দিনের জন্যও ঘটনাটি ভোলেনি। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানের পরিচিত-অপরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হলে নৌকাডুবির প্রসঙ্গটি আসে। এতে প্রমাণিত হয়, সব ঘটনা মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায় না, ট্র্যাজেডি সৃষ্টি করে না। গত বছর ৩১ আগস্ট, আমরা কয়েকজন কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, গায়কসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে চলনবিলে নৌভ্রমণে যাই। আমরা বিল অতিক্রম করে তাড়াশ উপজেলায় গিয়ে যাত্রা শেষ করি। কিন্তু কয়েকজনের খামখেয়ালিপনায় আবারও ভাঙ্গুড়ার দিকে যাত্রা করি। হান্ডিয়াল কাটাখাল অতিক্রমকালে স্র্রোতের পাঁকে পড়ে নৌকাটি নিমেষেই তলিয়ে যায় এবং নৌকাডুবিতে পাঁচজনের মৃত্যু ঘটে। তারা হলেন বিল্লাল গনি ও তার স্ত্রী শিউলি বেগম, স্বপন বিশ্বাস ও তার কন্যা সওদা মণি এবং আমার স্ত্রী শাহনাজ পারভীন পারু। আমরা যারা স্বজন হারিয়েছি তাদের দুঃখ কারোর চেয়ে কারোর কম নয়। এ দুর্ঘটনায় আমি আমার একান্ত প্রিয়জন স্ত্রীকে হারিয়েছি। প্রথম প্রথম ভাবতাম আমার দুঃখই হয়তো সবচেয়ে বেশি। পরে ভেবে দেখেছি আমার সন্তানরা তার মাকে হারালেও তাদের বাবা তো বেঁচে আছে। স্বপন বিশ্বাসের একমাত্র মেয়ে ছিল সওদা মণি। স্বপন ও সওদা মণিকে হারিয়ে স্বপনের স্ত্রী মুসলিমার বেঁচে থাকার অবলম্বন কী? বিল্লাল গনি ও তার স্ত্রী শিউলি বেগম নৌকাডুবিতে প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের একমাত্র কন্যা শর্মী কীভাবে বেঁচে আছে! আমার ভিতরেও হাহাকার যে রকম, তাদের মনে দুঃখবোধ নিশ্চয় তার চেয়েও বেশি। আমরা যারা সেদিন নৌকা ভ্রমণে গিয়েছিলাম তারা সবাই স্ব-স্ব অবস্থানে দায়িত্বশীল ব্যক্তি। পরিবারের প্রতি যতœবান। চেতনাগত দিক থেকে প্রগতিমনা। বলা যায়, সমাজের অগ্রসরমান অংশের লোক। সেজন্য আমাদের নিয়ে সমালোচনা হয়েছে বেশি। যারা সমালোচনা করেছেন তারা আমাদের ভালোবেসেই করেছেন। তবে সেদিন জীবনের চরম মুহূর্তে আমাদের সাহস, সততা, মানবিকতা, উদারতাসহ চরিত্রের সবকিছু ফুটে উঠেছে। হয়তো সে কারণেই বলা হয়, বুদ্ধিজীবীরা কর্মী হওয়ার চেয়ে বুদ্ধিচর্চাকে বেশি পছন্দ করেন। তা ছাড়া অসংগঠিত ব্যক্তিরা যে কোনো কাজের নয়, সেটাও প্রমাণিত হয়েছে। আমি নৌকায় ছৈয়ের ওপর বসে ফেসবুকিং করছিলাম। হঠাৎ দেখি নৌকাটি তলিয়ে যাচ্ছে। সামনের দিকে তাকাতেই দেখি আমার মেয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। কেউ তাকে ধরছে না। যে-যার মতো ভেসে থাকার চেষ্টা করছে। সাঁতার জানা সহযাত্রীদের কেউ কেউ সাঁতরে কিনারায় চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ আর্তচিৎকার করে কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের বলছে, আমাদের বাঁচান! আমাদের বাঁচান!! ক্ষণিককালের জন্য ঘটনাটি বর্ণিত কিয়ামতের মতো মনে হলো। এখানে উল্লেখ করতে হয়, নৌকাডুবির আশঙ্কা থেকে আমি খালি বোতলগুলো একটি সাইড ব্যাগে ভরে হাতের মুঠোর মধ্যে রেখেছিলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় তার সব ফেলে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মেয়েকে ধরি। তার কাছে যেতেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে। ডুবে যেতে থাকি দুজন। নাক-মুখ দিয়ে পানি প্রবেশ করতে তাকে। নাসারন্ধ্রে ঝাঁজালো অনুভূতি। দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। মনে হলো এটাই মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত। আজরাইল যেন জান কবজ করতে প্রস্তুত। হঠাৎ নিজেকে মেয়ের হাত থেকে মুক্ত করে ভেসে উঠে দম নিই। দেখি মেয়েও ভেসে উঠেছে। আবারও মেয়ের প্রতি মমতা সৃষ্টি হয়। তাকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করি। এখন চিন্তা করি, ওই সময় তো আমার স্ত্রীর কথা মনে পড়েনি, মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলাম কেন! আবার মেয়েকে দূরেও সরিয়ে দিয়েছি। তাহলে কি চূড়ান্ত মুহূর্তে মানুষ নিজেকেই বেশি ভালোবাসে! এটা হয়তো আমার বেলায় ঘটেছে। বিল্লাল গনি সাঁতার জানতেন। তার সাঁতার না জানা মেয়েকে নৌকায় তুলে দিয়ে নিজে তলিয়ে যান। পরে শুনেছি, যারা আগে নৌকায় উঠে বসেছিল, তাদের কেউ যদি গনি ভাইয়ের হাতটি ধরতেন তাহলে গনি ভাই বেঁচে যেতেন। একই ঘটনা স্বপনের বেলায়ও ঘটেছে। রফিকুলের মুখ থেকে শোনা, তিনি নাকি সওদা মণির এক হাত আগে ধরেন এবং আরেক হাত স্বপনকে ধরতে অনুরোধ করেন। স্বপন নাকি মেয়ের হাত ধরে নিজেই তলিয়ে যেতে থাকে, তখন রফিকুল নিজেকে বাঁচাতে সওদা মণির হাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তিনি ভেবেছিলেন, উদ্ধারকারী নৌকাটি আগে ধরি, তারপর তাদের উদ্ধার করা যাবে। আরেকজনের মুখে শুনেছি, স্বপন তার মেয়েকে নিয়ে সাঁতরে আসতে আসতে তলিয়ে যান। উদ্ধারকারী নৌকায় উঠে যাওয়া লোকগুলো মরণপণ দশা দেখেও তাদের ওঠানোর চেষ্টা করেনি, কেউ কেউ নাকি মোবাইল ফোন নষ্ট হয়ে গেছে, ব্যাগ ভিজে গেছে এসব নিয়ে দুঃখ করতে থাকে। আমার স্ত্রী শাহানাজ পারভীন পারু ও বিল্লাল গনির স্ত্রী শিউলি বেগম নৌকার ছৈয়ের নিচে আটকে যান। তারাও প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন ছৈ থেকে বের হওয়ার। তারা নিশ্চয় দম বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত সন্তানদের মঙ্গল কামনাই করেছেন। সহযাত্রী যারা বেঁচে আছেন তাদের মধ্যে গায়ক, কবি, গবেষক ও এনজিওকর্মী রয়েছেন। তারা সবাই মানবতাবাদী। তারা প্রকাশ্যে নিজেদের ত্রুটি স্বীকার করেছেন (যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শফি খান বাদে) এমন কথা শোনা যায়নি। তারা এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। একজন তো বাড়ির কাছে নিজ খরচে মসজিদ নির্মাণ করে নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করেছেন। নিশ্চয় তিনি তার কৃত ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। আমার প্রতি মুহূর্তের মর্মপীড়ার প্রধান কারণ নৌকাডুবির ঘটনাটি। এ যেন আরেকটি টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ঘটনা। স্বপন বিশ্বাসের মতো বন্ধুবৎসল ও প্রগতিমনা যুবক হাজারে কজন থাকে? তার কন্যা সওদা মণি ছিল একজন সম্ভাবনাময় মেধাবী ছাত্রী। বিল্লাল গনি ছিলেন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি (তার বাবা পীর ছিলেন)। তার মুখে হাদিসের ব্যাখ্যা শুনে যে কেউ বিমোহিত হতেন। আমার স্ত্রী শাহানাজ পারভীন পারু আমার মতো ছন্নছাড়ার সঙ্গে কীভাবে ২৬ বছর কাটালেন সেটাই এখন ভাবছি। গতকাল ৩১ আগস্ট ছিল তাদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তাদের পারলৌকিক জীবন যেন সুখের হয় এবং তাদের রেখে যাওয়া আদর্শ যেন আমাদের সন্তানরা ধারণ করতে পারে, সেই কামনাই করছি।

লেখক : নৌকাডুবিতে বেঁচে যাওয়া যাত্রী ও কলাম লেখক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর