সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

জিন্নাহর দাবি মেনে নিয়েছে বিজেপি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

জিন্নাহর দাবি মেনে নিয়েছে বিজেপি

অবশেষে ৭৫ বছর পর মহম্মদ আলি জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত¡ মেনে নিল ভারতের বর্তমান শাসক দল বিজেপি এবং আরএসএস। কাশ্মীর শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকে উত্তালের মধ্য দিয়ে, দীর্ঘ সাড়ে চার দশকে ছবির মতো সুন্দর ডাল লেকের শীতল জল বারবার গরম রক্তের স্রোতে লাল হয়ে গেছে। ঝিলমের স্রোতে ভেসে গেছে অজস্র মৃতদেহ। আজ আর ভ‚-স্বর্গ নয়, কাশ্মীরকে সবাই জানে তার বাতাসের বারুদের গন্ধের জন্য, তার অবিরাম রক্তক্ষয়ের জন্য, দম বন্ধ করা আতঙ্কের পরিবেশের জন্য।  ২০১৪ সাল এবং ২০১৯ সালে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে, (১. অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, ২. ভারতের সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার, ৩. অযোধ্যায় রামমন্দির) এই তিনটির মধ্যে দুই মাসের ভিতরেই তারা দুটিতে সফল। রামমন্দির নিয়ে ৫ আগস্ট থেকে একটানা শুনানি চলছে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে। চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। পাকিস্তানের সাবেক সামরিক রাষ্ট্রনায়ক জেনারেল আইয়ুব খান, জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জিয়াউল হক এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো- বারবার যুদ্ধ করেও যা পারেনি তা পেরেছে গেরুয়া বাহিনীর সরকার। বিজেপি শাসনের গত ছয় বছরে সন্ত্রাসবাদ বনাম গেরুয়াবাদের দাপটে কাশ্মীর রক্তে লাল হয়েছে। ৫ আগস্ট ভারতের পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষে এবং নিম্নকক্ষ লোকসভায় কাশ্মীরকে আলাদা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল বলে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সোমবার হলো ভারতের  পক্ষে ‘কালো সোমবার’। সংসদে বিল আসার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুজরাট দাঙ্গার নায়ক বলে পরিচিত অমিত শাহ মন্ত্রীদের ডেকে তাদের মোবাইল ফোন জমা রাখেন, বিষয়টি এতই গোপন ছিল যে- মোদি ও অমিত শাহ তাদের মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের বিশ্বাস করতে পারেননি আর     তৃতীয় ব্যক্তি যিনি জানতেন তিনি হলেন- আরএসএস প্রধান মোহন ভগবত। দিল্লি ও নাগপুরের মধ্যে প্রায় ৮০০ মাইলের ব্যবধান, টেলিভিশনের পর্দায় যারা সরাসরি দেখেছেন রাজ্যসভায় যখন ‘হ্যাঁ’, ‘না’, ধ্বনি ভোট হচ্ছিল তখন ফ্ল্যাশ নিউজ এলো মোহন ভগবত নাগপুর থেকে মোদি ও অমিত শাহকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, আর হ্যাঁ ‘না’ ধ্বনি ভোট শেষ হওয়ার পর ৪০ সেকেন্ডের মধ্যে খবর এলো রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৩৭০ ধারা সংশোধনের বিলটি সই করেছেন। এত তাড়া কেন, মন্ত্রীরা কেউই জানতেন না কী হতে যাচ্ছে। সপ্তাহ খানিক আগে থেকেই কাশ্মীরে লক্ষাধিক অতিরিক্ত সৈন্য ও আধাসৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল। দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যেহেতু দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে তাই সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য এত তাড়াহুড়ো করেছেন মোদি, অমিত শাহরা। কাশ্মীরের সাবেক রাজা হরিসিং ১৯৪৭ সালে জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখের ভারতভুক্তি চেয়ে প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরুকে চিঠি লেখেন। আর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি নাগাদ পাকিস্তান হানাদার পাঠিয়ে কাশ্মীর আক্রমণ করে। তাদের সঙ্গে ছিল ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর অফিসার ও জওয়ানরা। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্রিটিশ সৈন্যরা দলে দলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। বার দেখা যাক, ভারতের অর্থনীতির হাল কী? কাশ্মীরের নেত্রী যিনি ক্ষমতার লোভে মমতার কায়দায় বিজেপিকে জম্মু-কাশ্মীরে ডেকে নিয়ে তাদের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিলেন, মমতা ১৯৯৮ সালে বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে ডেকে এনে যেমন পশ্চিমবঙ্গের সর্বনাশ করেছেন ঠিক ওই একই কায়দায় জম্মু-কাশ্মীরের সর্বনাশ করল মেহেবুবা মুফতি। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন অর্থনীতি যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে, আগেই মেহেবুবা মুফতি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন- অর্থনীতির মুখ থুবড়ে পড়ার বাস্তব সমস্যা থেকে নজর ঘোরানোর জন্য ফের না কাশ্মীরকে কাজে লাগানো হয়, সংসদে ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করার প্রস্তাব আসার পর বিরোধীরা বলছেন মুফতির আশঙ্কাই ঠিক হলো। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন ভারতের ৫৪২টি ছোট ছোট রাজ্য ভারতের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, এসবের সব কৃতিত্ব জওহরলাল নেহেরুর। আর তা অনেকাংশে বাস্তবায়িত করেছিল তার উপপ্রধানমন্ত্রী গুজরাটের সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল। রাজা হরিসিং-এর সঙ্গে চুক্তি করে সংবিধানের ৩৭০ ধারায় কাশ্মীরকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে নেহেরু মন্ত্রিসভার সদস্য শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস ছেড়ে তিনি ১৯৫২ সালে জনসংঘ নামে একটি নতুন দল প্রতিষ্ঠা করেন। জনসংঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শ্যামাপ্রসাদ এই ৩৭০ ধারার বিরোধিতা করে এসেছিলেন। সেই থেকেই তার উত্তরসূরিরা ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার এবং কাশ্মীরের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট গেরুয়া বাহিনী সফল হলো। ভারতের প্রথম সারির ৩ জন আইনজ্ঞ হরিশ সালডে, প্রশান্ত হুসেন প্রমুখ সরাসরি বলেছেন, সংবিধানের নির্দেশাবলি না মেনে কাশ্মীরকে ভেঙে তিনটি কেন্দ্রশাসিত রাজ্য করেছে বিজেপি। ভারতের সংবিধানে আছে কোনো রাজ্য ভাঙতে হলে সেই রাজ্যের বিধানসভা এবং বিধান পরিষদে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে আইন করে তা কেন্দ্রের কাছে পাঠাতে হয়। কেন্দ্র সেই সুপারিশ মেনে পার্লামেন্টে বিল এনে নতুন আইন করে পৃথক রাজ্যের অনুমতি দেয়। যেমন উত্তর প্রদেশ ভেঙে উত্তরাখন্ড, অন্ধ্র ভেঙে তেলেঙ্গা, মধ্যপ্রদেশ ভেঙে ছত্তিশগড় আর বিহার ভেঙে ঝাড়খন্ড। তবে বিহার ভেঙে ঝাড়খন্ড করা হয় অটল বিহারি বাজপেয়ির সময়। বাকিগুলো করা হয় কংগ্রেস আমলে। কিন্তু মোদি অমিত শাহ কী করল, এক মাস আগে কাশ্মীরে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করে বিধান সভা ও বিধান পরিষদ ভেঙে দেয়। এটাই ছিল তাদের গেরুয়া কৌশল। শুধু এখানেই শেষ নয়। কয়েক বছর আগে বিজেপির আর এক সভাপতি মুরলি মনোহর যোশী কলকাতায় সাংবাদিক বৈঠকে, পশ্চিমবঙ্গকে তিন ভাগে ভাগ করার দাবি করেছিলেন। গত ৪৮ ঘণ্টায় সেই দাবি আবার নতুন করে দেখা দিয়েছে। যেমন- দার্জিলিং ও কোচবিহার নিয়ে পৃথক রাজ্য (কেন্দ্রশাসিত)। উত্তরবঙ্গের চারটি জেলা নিয়ে একটি রাজ্য এবং দক্ষিণবঙ্গের বাকি জেলাগুলো নিয়ে একটি রাজ্য, সেক্ষেত্রে বঙ্গেশ্বরী কী করবেন? জিন্নাহ সাহেবের দ্বি-জাতি তত্তে¡র যারা সেদিন বিরোধিতা করেছিলেন, এখন তারাই এর প্রবক্তা। মোদি-অমিত শাহ কর্মসূচি নিয়েছে ভারত হবে হিন্দু রাষ্ট্র। তবে বাকি প্রায় ৩২ কোটি সংখ্যালঘু কোথায় যাবে? এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে?

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর