মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

কুমিল্লায় বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা স্থাপন করা হোক

রেজাউল করিম শামিম

আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকের ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে আজ দেশজুড়ে অসংখ্য ব্যাংক আর তার শাখার ছড়াছড়ি। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ব্যাংকের মতোই আর্থিক লেনদেন হয়েছে অতিসহজতর। কিন্তু সেই ব্রিটিশ-ভারতের সময় যখন তেমন কোনো ব্যাংকই ছিল না সে সময় কুমিল্লায় বেশ কিছু ব্যাংকের অস্তিত্ব ছিল। কথাটি শুনলে অনেকেরই অবাক হওয়ার কথা। তবে ব্যাংকের ইতিহাস ঘাঁটলে এ সত্যই জ্বলজ্বল করছে। সে কারণেই কুমিল্লা একসময় ব্যাংক, ট্যাংক আর হুক্কা-খড়মের শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। সে ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল খদ্দর আর রসমালাই।

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে, বিশ শতকের প্রথম দিকেই কুমিল্লায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চলে। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ নরেন্দ্রচন্দ্র দত্ত। তাকে এখনো ভারতের ব্যাংকিং ক্ষেত্রে পথিকৃৎ বলা হয়। কলকাতার থিংক-ট্যাংক খ্যাত একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্ট গবেষক ইন্দ্রজিৎ মল্লিকের একটি লেখা রয়েছে নরেন্দ্রচন্দ্র দত্ত সম্পর্কে। ‘ডেভলপমেন্ট ব্যাংকার ফরম ব্যাঙ্গল’ নামের ওই লেখায় শ্রীদত্ত এবং সে সময়কার ব্যাংকব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায। ওই লেখায় দেখা যায়, দত্তবাবু পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবী। বৃহত্তর কুমিল্লার কালীকচ্ছ গ্রামে তার জন্ম হলেও তিনি থাকতেন কুমিল্লা শহরে। তার শিশুকাল ছিল অত্যন্ত কষ্টের। মাত্র নয় মাস বয়সে তিনি তার পিতাকে হারান। কষ্টকর তার সেই প্রথম জীবনেই তিনি লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী হন। কলেজ পেরিয়েই তিনি কলকাতা থেকে ল পাস করেন। এরপর কুমিল্লা ফিরে আসেন। কুমিল্লা সিভিল কোর্টে আইন পেশায় যুক্ত হন। সময়টি ছিল ১৯১৪ সাল। সে সময়েই তিনি ছোট আকারে ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করেন। সাইকেলে চড়ে বিভিন্ন জনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকাপয়সা লেনদেন করতেন, হিসাবপত্র রাখতেন। পরে আদালতের জজ সাহেব তাকে অনুমতি দেন আদালত অঙ্গনে তার ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যেতে। সে অনুযায়ী আদালত ভবনের পাশে একটি স্টিলের সেইড তৈরি করে তিনি সেখানে ব্যাংকের কর্যক্রম শুরু করেন। নরেন্দ্রচন্দ্র দত্ত চার হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে যে ব্যাংকটি চালু করেন, তার মধ্যে তার নিজের বাড়ি বিক্রি করার দেড় হাজার টাকাও রয়েছে। এরপর তার ছেলেও একটি ব্যাংক স্থাপন করেন। সে ব্যাংকটির নাম ‘নিউ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’। এর মধ্যে অনেক ঘটনা ঘটে। সেসব বর্তমান লেখায় প্রাসঙ্গিক নয়। প্রাসঙ্গিক হলো, ১৯৫০ সালে পিতা-পুত্রের ব্যাংক দুটি একীভ‚ত হয়। পরে ‘ইউনিয়ন ব্যাংক’ নামে আরও একটি ব্যাংক কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠা পায়। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা করেন সে সময়ের আইনসভার সদস্য ইন্দ্রভ‚ষণ দত্ত। ১৯১৯ সালে মহাত্মা গান্ধী এ ব্যাংকটি উদ্বোধন করেন। কিন্তু ব্যাংকটি বেশি দিন চলেনি। পরে এ ব্যাংকটিও কিনে নেয় শ্রীদত্ত পরিবার। এভাবে ব্যাংক ব্যবসায় শ্রীদত্ত ও তার ছেলের অনেক প্রসার ঘটে। প্রয়োজনের তাগিদেই তারা কলকাতা, মহারাষ্ট্র, গুজরাটসহ বিভিন্ন স্থানে সম্প্রসারণ করেন তাদের কার্যক্রম। তারা আরও দুটি ব্যাংক একত্রিত করে ইউনিয়ন ব্যাংক অব ইন্ডিয়া স্থাপন করেন। যার কার্যক্রম এখনো অব্যাহত রয়েছে। শুধু তাই নয়, ভারতের টাটা, বিড়লা, টিভিএস বিশেষ করে ওবেরিও চেইন হোটেলেও তাদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। নরেন্দ্রচন্দ্র দত্ত, মর্টগেজ পদ্ধতি থেকে শুরু করে ব্যাংকব্যবস্থার যেসব আধুনিক আইন-কানুন তৈরি করে গেছেন, সেগুলো আজও ব্যাংক কার্যক্রমে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে। এজন্যই শ্রীদত্তকে ব্যাংকের পথিকৃৎ, জনক ও লিজেন্ড হিসেবে সারা ভারতে সম্মান দেওয়া হয়।

তাদের ব্যাংক ব্যবসার পাশাপাশি সে সময় স্বদেশি আন্দোলনের সম্পূরক হিসেবে কুমিল্লায় সমবায় আন্দোলনেরও সূত্রপাত হয়। আর্থিক কর্মকান্ডে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য সদস্য চাঁদা সঞ্চয়ের মাধ্যমে পুঁজি গঠনের ব্যবস্থা হিসেবে সমবায় ব্যাংক নামে কিছু ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়; যার অস্তিত্ব এখনো কুমিল্লায় রয়েছে বিভিন্ন নামে। যেমন কুমিল্লা সমবায় ব্যাংক, পিপলস্ কো-অপারেটিভ ব্যাংক (বর্তমানে যা ভ‚মি উন্নয়ন ব্যাংক নামে চালু রয়েছ), কুমিল্লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো-অপারেটিভ ব্যাংক (বর্তমানে সমবায় মার্কেট) ইত্যাদি। এগুলোর প্রতিষ্ঠাকাল ১৯১৩ থেকে ১৯১৭।

দেশের ইতিহাসে ব্যাংকের আদিস্থান কুমিল্লা বলে চিহ্নিত। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ নামে পরিচিত এর একটি শাখা আজও কুমিল্লায় স্থাপন করা হয়নি। এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারণাও কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। পাকিস্তান আমলের মাঝামাঝি স্থাপিত হয় এ ব্যাংক। ‘ব্যাংক অব ব্যাঙ্গল’ নামে ব্রিটিশ আমলে যে ব্যাংকটির ঢাকায় একটি শাখা স্থাপিত হয়েছিল; যার মাধ্যমে সরকারের পক্ষে সব ধরনের ট্রেজারি ও ব্যাংকিং সুবিধা প্রদান করা হয়। ফলে সেটি সরকারি কোষাগার হিসেবে কাজ শুরু করে। সব জেলা থেকে এ শাখাটিতেই রাজস্ব পাঠানো হতো এবং পরে তা কলকাতা যেত। এ শাখাটিই গোটা বাংলায় ঢাকাকে আর্থিক কেন্দ্রে উন্নীত করে। পরে এটি বাংলাদেশ ব্যাংক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মুদ্রানীতি ঘোষণা, দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব-নিকাশ, ট্রেজারির কর্মকান্ড দেখভাল করা ইত্যাদি কাজ এ ব্যাংকের মাধ্যমে হয়। দেশে ব্যাংক ও তার শাখার ব্যাপ্তি বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ ব্যাংক তার শাখা খুলেছে। বর্তমানে এর শাখার সংখ্যা ১০টি।

তবে এ তালিকায় কুমিল্লা নেই। দীর্ঘদিন থেকেই কুমিল্লায় এ ব্যাংকের একটি শাখা স্থাপন করার দাবি ছিল। যেসব প্রাক-যোগ্যতার ভিত্তিতে শাখা স্থাপন করা হয়, তার সবই কুমিল্লায় বিদ্যমান। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্ব বিবেচনার বিষয় হলো বৈদেশিক মুদ্রা আয় বা রেমিট্যান্স, যাকে প্রবাসী আয়ও বলা হয়। তাকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা স্থাপনের অন্যতম বিবেচনায় আনা হয়। সে ক্ষেত্রে কুমিল্লা অনেক এগিয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকেই দেখা গেছে, প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে কুমিল্লা রয়েছে এক নম্বরে। গোটা দেশের মধ্যে কমিল্লার প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ সর্বোচ্চ। পরপর সাত বছর ধরেই এক নম্বর স্থানটি দখলে রয়েছে কুমিল্লার। তা ছাড়া ঢাকাসহ আশপাশ জেলাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থাও অত্যন্ত উন্নত। তার পরও কুমিল্লায় একটি শাখা স্থাপন হচ্ছে না কেন, তার উত্তর নেই। একটু খতিয়ে দেখলেই দেখা যায়, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী কিছু দিনের জন্য তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। আর সে সুযোগে তিনি তার বাড়ি বগুড়ায় স্টেট ব্যাংকের প্রথম শাখাটি স্থাপন করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাও বহুবছর আগের ঘটনা। অথচ কুমিল্লার অনেকেই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেক প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি, ক্যাবিনেট সচিব, সচিব ছিলেন। দেখতে দেখতে ব্যাংকটির ১০টি শাখা হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে, কিন্তু কুমিল্লায় হচ্ছে না।

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রভাবশালী পরিচালক হচ্ছেন কুমিল্লার আফতাবুল ইসলাম মঞ্জু। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এমপি কুমিল্লারই লোক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণ কর্মকান্ডে তাদের ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার সংসদে জোরালোভাবেই এ দাবিটি তুলে ধরেছিলেন। সাবেক রেলপথ মন্ত্রী মুজিবুল হক মুজিব এমপি এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে অনেকবারই কথা বলেছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক আফতাবুল ইসলাম মঞ্জুর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হয়েছে অনেকবার। তার গুলশানের অফিসে বসে কথা বলার সময় তিনি বলেন, অন্য যেসব স্থানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শাখা রয়েছে, সেসব এলাকার চাইতে কুমিল্লায় শাখা স্থাপন অনেক বেশি যৌক্তিক এবং যথার্থই হবে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি।

সর্বশেষ খবর