মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মামুন : নাড়া দিয়ে যাওয়া এক মৃত্যুর নাম

প্রথম বর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ক্লাসরুমে বাংলাদেশের ইতিহাস বিষয়ে ক্লাস নিচ্ছেন প্রয়াত সিতারা পারভীন ম্যাডাম। হঠাৎ ম্যাডাম খেয়াল করলেন কে যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। একটু খেয়াল করে দেখলেন মামুন। তারপর

সিতারা পারভীন ম্যাডাম :  মামুন, বল তো বদরুদ্দীন উমর কে?

মামুন :  ম্যাডাম, উনি বদরবাহিনীর প্রধান ছিলেন।

বদরুদ্দীন উমর সম্পর্কে মামুন কিন্তু খুব ভালো করেই জানত।

সিতারা পারভীন ম্যাডাম :  মামুন, তুমি আগামী ক্লাসে বদরুদ্দীন উমরের ওপর তিন পাতা লিখে নিয়ে আসবে। এটা তোমার অ্যাসাইনমেন্ট।

কোনো এক বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা হচ্ছে। পরীক্ষার হলে সামনের দিকে মামুনের সিট। ডেস্কের ওপর মোবাইল ফোন সেট রাখার সময় ফাহমিদুল হক স্যারের চোখ গেল মামুনের মোবাইলের দিকে।

ফাহমিদুল হক স্যার :  মামুন, তুমি আইফোন কিনেছ?

মামুন : জি স্যার।

মামুনের বন্ধু রাজীব (পেছন থেকে) : স্যার, ওটা চীনা আইফোন। ৩ হাজার টাকা দিয়ে কিনছে।

মামুন :  স্যার, ও আমার শত্রু। আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়।

মোবাইল ফোনটা আসলেই চাইনিজ ছিল।

পরিসংখ্যান পরীক্ষার তিন মাস আগে মামুন মনোযোগী ছাত্র। পরিসংখ্যান বিভাগের এক বড় ভাইয়ের কাছে প্রাইভেট পড়ছে মামুন। মামুনের কাছের বন্ধুরা মোটামুটি সবাই পরিসংখ্যান ইমপ্রæভমেন্ট রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু পরীক্ষার তিন দিন আগে মামুনের বাগড়া। সে সব শিখিয়ে দেবে, কোনো ব্যাপার না। কী মনে করে পাঁচ-ছয় জন মামুনের কাছে পড়া শুরু করল। মামুন শিক্ষক, তারা মনোযোগী ছাত্র। যারা মামুনকে চেনেন তারা বুঝবেন বিষয়টার মর্ম । যাই হোক, পরীক্ষায় মামুনের বন্ধুরা সবাই ভালোভাবে উতরে গেল। শুধু মামুন ইমপ্রæভমেন্ট রাখল।

কোনো একদিন মামুনসহ বন্ধুরা সাংবাদিকতা বিভাগের করিডোরে। হঠাৎ রাজীবের নজর মামুনের জুতার দিকে। নতুন জুতা।

রাজীব : কীরে মামুইন্যা, জুতা কত নেছে?

মামুন : সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।

রাজীব : চাপা মারস।

মামুন : পাঁচ হাজার টাকা নিছে।

রাজীব : কানারে হাই কোর্ট দেখাও।

মামুন : সাড়ে চাইর হাজার টাকা নিছে।

রাজীব : এই জুতার দাম এক হাজার টাকাও না।

মামুন : সাড়ে তিন হাজার টাকা নিছে। আর কমাইতে পারমু না। কসম।

কোনো এক বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার আগের রাত। রাত ৮টার মতো বাজে। মামুন হলে থাকে না, বাসায় থাকে আগারগাঁও তালতলায়। হঠাৎ কোনো নোটিস ছাড়াই ব্যাগ নিয়ে হলে উপস্থিত মামুন। এসেই ব্যাগ দেখিয়ে দাবি, পৃথিবীর সেরা নোট তার কাছে। একবার চোখ বোলালেই ফাস্ট ক্লাস নিশ্চিত। কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল সেগুলো আসলে যুগ যুগ ধরে বিভাগের সবার হাত ঘুরে বেড়ানো নিম্নমানের কিছু নোট। তা দেখেই...

রিয়াদ :  এই, তুই রুম থেইকা বাইর হ। তোরে হলে আইতে কইছে কে?

মামুন ব্যাগ নিয়ে এতক্ষণ কয়েকজনের সঙ্গে ফ্লোরে বসে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ল। আমার ঠান্ডা। আমি নিচে শুইতে পারুম না। তোরা নিচে শো। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা এলেই আমরা কোনো না কোনো দলকে সমর্থন করি। মামুনও করত। টিএসসিতে খেলা নিয়ে আড্ডা দিতে দিতে সবাই ব্যস্ত থাকত নিজের দলকে সেরা প্রমাণ করতে। এ নিয়ে একপর্যায়ে ঝগড়াও লেগে যেত। মামুন ঝগড়া  থামানোর জন্য কখনো ব্রাজিলের সমর্থন করত, কখনো আর্জেন্টিনা, কখনো জার্মানি, কখনো বা ইতালির। তার এমন কার্যক্রম যখন সবার নজরে আসত, আমরা ঝগড়া থামিয়ে হতবাক হয়ে যেতাম।

এমন অসংখ্য গল্প আছে মামুনকে নিয়ে। শুধু তার বন্ধুদের কাছেই নয়। মামুনের সেই গল্প আছে তার পরিচিত সবার কাছে। একবারই হয়তো দেখা হয়েছে, এমন অনেকেরও মামুনকে মনে রাখতে হয়েছে এমন কোনো গল্পের কারণে। যত গুমোট পরিবেশই হোক না কেন, মামুন চুপচাপ আছে বা হাসছে না এমন খুব কম হয়েছে। হয়তো কিছুক্ষণ তার পরই সেই চিরচেনা মামুন। চরম সিরিয়াস বিষয়গুলোও মামুন হালকা করে নিতে পারত, ওইসব মুহ‚র্তে নিশ্চিন্তে হাসতে পারত। সেজন্য অনেক সময় সিনিয়র কারও কাছ থেকে হয়তো বকাও খেয়েছে। কিন্তু তারা কেউই মামুনকে দূরে ঠেলে দিতে পারেননি। কারণ, তার সরলতা এবং একজন ভালো মনের মানুষ। যে কারও উৎসব কিংবা বিপদে মামুন ছিল সামনের সারিতে। কথায় কথায় যেই ছেলেটা হাসতে পারে তার মতো সহজ সরল আর কে বা হতে পারে। মামুন শুধু হাসতে নয়, হাসাতেও পারত। মানুষ কারও কথায় প্রাণ খুলে হাসছে, সেও তো তার জীবনের বড় পাওয়া। মানুষকে হাসানো সহজ কাজ নয়। কিন্তু মামুনের মধ্যে সেই ক্ষমতা ছিল অদ্ভুত রকমের বেশি। অনায়াসে হাসাতে পারত। যে কাউকে অনায়াসে কাছে টেনে নেওয়ার, আপন করে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার।

যে ছেলেটা সারা দিন হাসত, মানুষকে হাসাত সে-ই কিনা মারা গেল হার্ট অ্যাটাকে! কিন্তু হাসিখুশি থাকা মানুষের নাকি এমন কম হয়। আঃ সেই কম মানুষের দলেই যে মামুন ছিল তা কে জানত। এই জীবন সংসারে নিত্যদিন সবার কত কিছু নিয়েই না ব্যস্ততা। কিন্তু মামুনের কখনোই তেমন ব্যস্ততা ছিল না কোনো কিছু নিয়ে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে জীবন যে মামুনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল, তা তো কারও বোঝার সাধ্য ছিল না। ঠিক এক বছর আগে, আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে মামুন। দিয়ে গেছে নতুন গল্প। সময়ের সঙ্গে যে গল্পেরও বয়স বাড়ে, ধরন বদলায়। তবে যে গল্পটা এত দিন ততটা ওঠেনি আড্ডায়, গল্পে, আলোচনায়, মামুনের মৃত্যুর পর তাও শুরু হয়েছে। এখন কত অবলীলায় সবাই মৃত্যুর গল্প করি, মামুনের মৃত্যুর। ভিতরে ভিতরে হয়তো অনেকে বুকচাপা কষ্ট লুকিয়ে রাখে, কারও চোখ গড়িয়ে পড়ে দুই ফোঁটা জল। আবার কারও হয়তো তেমন কিছু মনেই পড়ে না। জীবনের বাস্তবতায় দৃশ্যমান অনেক কিছুই যখন দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, তখন অদৃশ্য কিছু তো মনে নাও পড়তে পারে। তবে এও সত্য, মামুনকে ভুলে যাওয়া কঠিন। মামুনের মতো কাউকে ভোলা সহজ নয়। তাই তো পরিচিত সবার কাছে ভীষণ রকমের নাড়া দিয়ে যাওয়া এক মৃত্যুর নাম মামুন। আরও পরিণত হলে কতটুকু বদল হতো মামুনের কে জানে। তবে এখন সবার মনে চিরতরে আটকে যাওয়া মামুনের ছবিটা রয়ে যাবে হাসিমুখের। যেখানেই থাকুক, হাসিমুখেই থাকুক আমাদের মামুন।

লেখক : আশরাফুল আলম খোকন, নাসিম রুপক, জয়দেব নন্দী, আশিক রনো রোকন উদ্দিন, রাজীব আহমেদ, নাজমুল আলম, নাজমুল হোসেন।

সর্বশেষ খবর