বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

ইসলাম চায় ‘আত্মনির্ভরশীল’ প্রজন্ম

হুমায়ুন আইয়ুব

ইসলাম চায় ‘আত্মনির্ভরশীল’ প্রজন্ম

ইতিহাস খ্যাত হজরত শাকিক বলখি (রহ.)। ব্যবসা করেন দেশ-বিদেশে। একবার ব্যবসা সফরের আগে বন্ধু হজরত ইবরাহিম ইবনে আদহামের কাছ থেকে বিদায় নেন। ইবরাহিম ইবনে আদহাম বন্ধুকে পরামর্শ দিয়ে ও বহুদিন কাছে না পাওয়ার বেদনার কথা বলে বিদায় জানান। অল্প কদিন পরের কথা। মসজিদে বসে আছেন শাকিক বলখি! আরে! আপনি সফরে যাননি? কবে ফিরলেন? এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন যে? আসলে ইবরাহিম ইবনে আদহাম বন্ধুকে সফর থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসা দেখে অনেকটা থমকে গেছেন। নানা প্রশ্নের জালে আটকে গেছেন।

- সফরে একটা আজব বিষয় দেখলাম। তাই সব ছেড়ে দিয়ে ফিরে এলাম, বললেন শাকিক বলখি।

- কী এমন দেখলেন?

- পথে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বিশ্রামে চলে যাই একটি বিরানঘরে। সেখানে দেখা মেলে একটি পাখির। অন্ধ পাখি। পাখিটির হাত-পাও নেই। অচল। চোখেও দেখে না। চলতেও পারে না। তবে কিছু সময় পরপর একটি পাখি উড়ে এসে এ পাখিটিকে খাবার দিয়ে যাচ্ছে! দিনে কয়েকবার। অন্ধ অচল এ পাখির খাবার ব্যবস্থা দেখে মনে আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ভরসা পেলাম। বিশ্বাসের রঙে আরও গাঢ় আলপনা এঁকে বসল। নীরব ও নির্জন ঘরে যিনি এ পাখির খাবারের ব্যবস্থা করেন আমাকেও তিনিই খাওয়াবেন। তবে কেন ব্যবসার জন্য ছোটাছুটি? এত হৈচৈ? এত বন-বাদাড় আর পাহাড় ঘোরা! আমার জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা তো আল্লাহরই হাতে!

সব ছেড়ে ওখান থেকেই বাড়ি চলে আসি। ব্যবসায়িক কাফেলার সফর বন্ধ করে দিই! দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলছিলেন শাকিক বলখি!

এবার মুখ খোলেন ইবরাহিম ইবনে আদহাম!

- আশ্চর্য! শাকিক, আপনার ওপর বড়ই আফসোস হচ্ছে আমার। আপনি কি সামান্য অন্ধ পাখির মতোই ভাবেন নিজেকে? অন্যের সাহায্যে বেড়ে ওঠা একটি অচল পাখির জীবনের মতোই কেন বেছে নিলেন আপনার জীবন-সংসার? আপনি কেন আত্মমর্যাদাহীন পরনির্ভর জীবনের কথা ভাবছেন? আপনার কি মনে নেই রসুলুল্লাহ সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘আত্মমর্যাদাশীল’ বাণীর কথা- ‘দাতা হাত গ্রহীতা হাত থেকে শ্রেষ্ঠ!’ এ কথা শুনে আবারও উজ্জীবিত হলেন শাকিক বলখি। উঠে গিয়ে ইবরাহিম বলখির হাতে চুমু খেলেন! বললেন, আপনি আমাদের শিক্ষক। আমি আবারও ‘আত্মনির্ভরশীল’ পেশা ব্যবসায় ফিরে যাচ্ছি। দেখুন ড. ইউসুফ আল কারজাভির মুশকিলাতুল ফাকর।

গল্পটা আমাদের ঘরের। নিজেকে মর্যাদাশীল করে গড়ে তোলার প্রেরণার। আল্লাহর এ জগতে রিজিকদানের বিচিত্র ব্যবস্থা আছে। তবে মানুষের প্রশ্নে আল্লাহর স্পষ্ট বক্তব্য, ‘আমি তো আদমসন্তানকে মর্যাদা দান করেছি।’ সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৭০।

রুচি-আভিজাত্য আর সভ্যতায় মানুষই শ্রেষ্ঠ জাতি! মানুষের আয়-উপার্জন আর রিজিকদানের বিষয়েও বহুরৈখিক ব্যবস্থা আছে। আছে আত্মনির্ভরশীল মর্যাদার ব্যবস্থা কিংবা পরনির্ভর সাহায্য-সুবিধাগত ব্যবস্থা। তবে ইসলাম সম্মান-মর্যাদা আত্মনির্ভরশীল জীবিকার পক্ষেই জয়গান গেয়েছে।

সকালের শুভ্রতা ছড়ানো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য হলো-  হজরত সাহল ইবনে সাদ থেকে বর্ণিত। হজরত জিবরাইল (আ.) রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছেন, ‘মুমিনের মর্যাদা তাহাজ্জুদের রাত জাগরণে আর তার সম্মান মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষিতার মধ্যে নিহিত।’ মুসতাদরাকে হাকেম।

কারও সামনে নিজেকে ভিখারি বানাতে পছন্দ করে না ইসলাম। কারও কাছে হাত পাতাও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুব অপছন্দ। হজরত আবদুর রহমান আওফ ইবনে মালেক বলেন, ‘আমরা রসুল সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে তখন নয়জন, আটজন কিংবা সাতজন ছিলাম। রসুলুল্লাহ বললেন, তোমরা কি আল্লাহর রসুলের হাতে বায়াত গ্রহণ করবে না? অথচ আমরা মাত্রই আকাবার বায়াত গ্রহণ করেছি। তাই বললাম, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমরা তো আপনার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছি। তিনি আবারও বললেন, তোমরা কি আল্লাহর রসুলের হাতে বায়াত গ্রহণ করবে না? আমরা তখন হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ইয়া রসুলাল্লাহ! আমরা তো আপনার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছি। এখন আবার কীসের বায়াত গ্রহণ করব? নবীজি বললেন, এ মর্মে শপথ নাও-  কেবল আল্লাহর ইবাদত করবে, তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, আমিরের কথা মেনে চলবে। তারপর নবীজি নিচু স্বরে একটি গোপন কথা বললেন, আর মানুষের কাছে কিছুই চাইবে না। (সাহাবি বলেন,) আমি তাঁদের কাউকে কাউকে দেখেছি হাতের ছড়িটি পড়ে গেলেও অন্যকে তুলে দেওয়ার জন্য বলতেন না।’ রিয়াজুস সালেহিন, মুসলিম।

সম্মানজনক জীবন শিক্ষার আরও গভীর পাঠ আছে প্রিয়নবীর কথায়! তাঁর সাহাবিদের কাছ থেকে প্রত্যয় নিয়েছেন ‘কারও কাছে কিছু চাইবে না’। হজরত সাওবান (রা.) বলেন, ‘একবার রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কে আমার জন্য এই মর্মে দায়িত্ব নেবে যে, মানুষের কাছে চাইবে না আর আমি তার জন্য বেহেশতের দায়িত্ব নেব। বললাম আমি। (তার পর থেকে হজরত সাওবান কারও কাছে কিছু চাইতেন না)।’ রিয়াজুস সালেহিন।

লেখক : সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম।

সর্বশেষ খবর