শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

শেখ হাসিনা কি ভুল করছেন?

সৈয়দ বোরহান কবীর

শেখ হাসিনা কি ভুল করছেন?

টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারকে ঘিরে ঘরে-বাইরে অস্বস্তি। সরকারের কাজকর্ম নিয়ে নানা হতাশা আর তীর্যক মন্তব্য কান পাতলেই শোনা যায়। এই অস্বস্তির সূচনা অবশ্য ভোটের দিন থেকেই। যেভাবে আওয়ামী লীগ ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জিতেছে তা নিয়ে অস্বস্তি খোদ আওয়ামী লীগেই। কান পাতলেই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় ‘এভাবে না জিতলেও হতো’ ‘আওয়ামী লীগ এমনেই জিতত।’ এরপর এলো মন্ত্রিসভা। বিপুল বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা যেন এক ‘বিপুল বিস্ময়’। দলের সিনিয়র নেতাদের বাদ দেওয়া হলো। তা অবশ্য আওয়ামী লীগের জন্য নতুন কিছু নয়। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েও শেখ হাসিনা এমনটিই করেছিলেন। সে সময় তার ওই সিদ্ধান্তকে যারা ‘সাহসী’ ‘বিপ্লবী’ বলেছিলেন, এবার তারাই হতাশ। সিনিয়র কিংবা হেভিওয়েটদের বাদ দেওয়ার জন্য নয়। মন্ত্রিসভায় ‘অদ্ভুত’ কিছু ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তির জন্য। অনেকেই বলেন, ‘এরা মন্ত্রিত্ব তো দূরের কথা এদের অনেকে এমপি হওয়ারও যোগ্য নন।’ এসব সমালোচনা গায়ে না মেখে যারা অপেক্ষা করলেন নতুন মন্ত্রীরা কী করেন তা দেখার, শিগগির তারা আশাহত হলেন। এফআর টাওয়ার, ডেঙ্গু, প্রিয়া সাহা, বন্যা ইত্যাদি নানা ইস্যুতে সরকার শুরুতেই লবেজান। সংসদ, রাজপথে কোথাও বিরোধী দল নেই। সরকারের প্রতিপক্ষ নেই। তবুও ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সরকার যেন ক্লান্ত। টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার যেন পুরোপুরি শেখ হাসিনার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তার সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকেন মন্ত্রী-আমলারা। অনেক মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীদের চেয়ে আমলারা ক্ষমতাবান। কোনো কোনো আমলা মন্ত্রীদের ‘শিক্ষকে’ পরিণত হয়েছেন। অনেক মন্ত্রী, দলের নেতাদেরই চেনেন না, গণমাধ্যমকর্মী তো কোনো ছাড়। এর মধ্যেই একশ্রেণির আমলা তোষামোদীর উৎকট প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ থেকে, জলাভূমি ভরাটের বিরুদ্ধে প্রচারণা সবক্ষেত্রেই শেখ হাসিনার নাম জপার এক কি¤ভূত রীতি সম্প্রতি চালু হয়েছে। এমনকি জনপ্রশাসন দিবস উপলক্ষে রাস্তায় যেসব ব্যানার ও ফেস্টুন লাগানো হয়েছিল তা দেখে আওয়ামী লীগের কর্মীরাও লজ্জা পেয়েছেন। সব কিছুতেই প্রধানমন্ত্রী, সব কিছুতেই শেখ হাসিনা যুক্ত করে তারা কি শেখ হাসিনার অসম্ভব জনপ্রিয়তা এবং ইমেজকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টায় নেমেছেন? এ রকম প্রশ্ন আজ উঠতেই পারে। এ প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, শেখ হাসিনা কি ভুল করছেন? তিনি কি চাটুকার, তোষামোদকারী, সুবিধাবাদী চক্রের জালে বন্দী হয়ে গেছেন? আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষী অনেকেই টকশোতে ইদানীং প্রকাশ্যেই বলছেন, আরেকটা ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের মতো পরিস্থিতি হলে কি এই সুবিধাবাদীদের খুঁজে পাওয়া যাবে? যে শেখ হাসিনা এখনো দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, এখনো দেশের সিংহভাগ মানুষ যার ওপর আস্থাশীল- তাকেই কি টার্গেট করা হয়েছে? তার জনপ্রিয়তা নষ্টের নীলনকশার বাস্তবায়ন চলছে? এসব প্রশ্ন আজ অনেকের মনেই উঁকি দেয়।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিশ্লেষক এবং সমালোচক কম নয়। এরা শুধু আওয়ামী লীগের বাইরের সুশীল সমাজ নন, আওয়ামী লীগের মধ্যেও ছিল এবং আছে। ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে তিনি যখন ভঙ্গুর, বিভক্ত, অস্তিত্বের সংকটে থাকা আওয়ামী লীগের হাল ধরেন তখন থেকেই এই প্রশ্ন বার বার ঘুরে-ফিরে এসেছে- ‘শেখ হাসিনা কি ভুল করছেন?

শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জিয়ার মৃত্যুর কারণে ওই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয় ড. কামাল হোসেনকে। সে সময় আওয়ামী লীগে বাম ঘেঁষারা আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে হৈ হৈ করে ওঠেন। প্রকাশ্যে বলে ওঠেন ‘সাম্রাজ্যবাদের দালালকে’ মনোনয়ন দেওয়া হলো। শেখ হাসিনা ভুল করলেন। কিন্তু আজ পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, তার ওই সিদ্ধান্ত কতটা বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী ছিল। এর মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলো আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তাদের নেতিবাচক ধারণা পাল্টাতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ যে তাদের সমাজতান্ত্রিক নীতি ও আদর্শ থেকে সরে এসেছে-  সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট বার্তা দেয়। ওই নির্বাচনের পরই আওয়ামী লীগ তার গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ব্যক্তিমালিকানা এবং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে। সেদিন যদি শেখ হাসিনা ওই ভুল না করতেন, তাহলে আওয়ামী লীগ আজ এই মধুর সময় পেত কিনা, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দল এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ যেন ছিল শেখ হাসিনার এক ‘মহাভুল’। অনেকেই কদিন আগেও মন্তব্য করেছিলেন, ওই নির্বাচনে যাওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ পিছিয়ে পড়েছিল। অবশ্য সমালোচকরা এখন আর এ নিয়ে কথা বলেন না। ৮৬’র নির্বাচনে অংশ নেওয়ার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন এমন একজন বুদ্ধিজীবী সম্প্রতি লিখেছেন, ওই নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা প্রথম স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিলেন যে, জাতীয় পার্টি নয় বিএনপিই আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ।’ ওই নির্বাচন না হলে সেনাশাসন দীর্ঘায়িত হতো। স্বৈরাচারের শাসনকালের মেয়াদ বাড়ত। বাংলাদেশ যে মিয়ানমারের মতো সামরিক জান্তার দেশ হয়নি তা মূলত ১৯৮৬র নির্বাচনে শেখ হাসিনার অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের জন্যই। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব  গ্রহণের পর থেকেই স্পষ্টবাদী এবং ঠোঁট কাটা হিসেবে পরিচিত। দলের প্রবীণ নেতারা এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশে কার্পণ্য করেননি। যেমন ধরা যাক, শেখ হাসিনাই প্রথম যিনি প্রকাশ্য জনসভায় বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার হাত আছে।’ সে সময় এটা বলা যেন এক বোমা বিস্ফোরণ। আওয়ামী লীগের এক প্রয়াত প্রবীণ নেতা বলেছিলেন, ‘এসব কথা বলা ঠিক নয়। জিয়ার জনপ্রিয়তা পর্বত প্রমাণ। শেখ হাসিনা এটা বলে ভুল করেছেন। অথচ দেখুন, আজ শেখ হাসিনার এই বক্তব্য মহা সত্য। আদালতের রায়ে পর্যন্ত জিয়ার সংশ্লিষ্টতার উল্লেখ আছে। কিন্তু তখন তো সাহস করে সত্য বলা ছিল মহাপাপ। শেখ হাসিনা সেই সময়কে বদলে দিয়েছেন।

শেখ হাসিনা যখন প্রথম বিএনপিকে ‘অগণতান্ত্রিক দল’ বলেছিলেন, তখন দেশজুড়ে বুদ্ধিজীবীদের যেন ‘মাতম’ উঠেছিল। প্রকাশ্যে বলা হয়েছিল, এসব বলে তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে ব্যাহত করছেন। অথচ দেখুন আজ শেখ হাসিনার ‘ভুল’ উচ্চারণই সবাই করছেন। এখন কি এরকম একজন বুদ্ধিজীবী (বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীসহ) পাওয়া যাবে, যিনি বলবেন, ‘বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল’? নব্বইয়ের দশকে শেখ হাসিনা যখন শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে সঙ্গে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই।’ তখন তার এই বক্তব্য বিশ্বাস করার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে সময় এখন ‘কঠিন’ আওয়ামী লীগ সমর্থক এক বুদ্ধিজীবী কলাম লিখে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা এসব মন্তব্য করে, ক্ষমতায় যাওয়ার দরজা নিজেই বন্ধ করে দিচ্ছেন। এ ধরনের মন্তব্য সমীচীন নয়।’ কিন্তু শেখ হাসিনার সেই ভুলই আজ সত্যি। এখন শেখ হাসিনার কট্টর সমালোচকরাও বলেন ‘শেখ হাসিনা যা বলেন, তাই করেন। স্পষ্টবাদিতাই তার সবচেয়ে বড় শক্তি।’ এবার আসা যাক, তার সাম্প্রতিক ভুলগুলো প্রসঙ্গে। আনকোরা নতুনদের মন্ত্রিসভায় নিয়ে শেখ হাসিনা কি ভুল করেছেন? লক্ষ করবেন, এরকম মন্ত্রিসভা এবারই প্রথম নয়। ২০০৯ সালের মন্ত্রিসভায় শেখ হাসিনা নবীনদের ঠাঁই দিয়েছিলেন। সে সময়ও এরকম সমালোচনা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রয়াত এক নেতা ওই মন্ত্রিসভাকে ‘কচিকাঁচার আসর’ বলেছিলেন। ২০০৯-এর মন্ত্রিসভার কয়েকজন এবারের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছেন। ২০০৯ সালে বিদেশ ভ্রমণের জন্য সমালোচিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, এবার অনেক পরিণত। ইতিমধ্যে তিনি মন্ত্রী হিসেবে নিজেকে যোগ্য এবং দক্ষ প্রমাণ করেছেন। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁসের কলঙ্ক থেকে জাতিকে মুক্ত করেছেন। ধরা যাক, ২০০৯ সালে ডা. দীপু মনিকে ‘নবীন’ বিবেচনায় মন্ত্রী করা হলো না, তাহলে কি আজ এই দীপু মনিকে পাওয়া যেত? নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করেই তিনি ভবিষ্যতের একজন ‘আস্থাভাজন’ হয়েছেন। একই কথা ড. হাছান মাহমুদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমি কারও সমালোচনা করছি না, একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ পাঁচ বছরের বেশি সময় তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন, ভারতে বাংলাদেশের টেলিভিশনের সম্প্রচার কিছুই করতে পারেননি। ড. হাছান মাহমুদ এক বছরের কম সময়ে এসব করেছেন। অর্থাৎ ২০০৯ সালের ‘নাবালক’দের মধ্যে অন্তত দুজন তো সাবালক হয়েছেন। যারা আগামী দিনে নেতৃত্বে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। ঠিক তেমনি এবার আনকোরা, অযোগ্যদের মধ্য থেকেও তো কেউ বেরিয়ে আসতে পারেন যোগ্য হিসেবে। সেই সুযোগ দেওয়াটা কি ভুল? শেখ হাসিনা কেবল একজন রাজনীতিক নন, একজন দার্শনিকও বটে। তিনি আগামীর শূন্যতা অনুভব করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রজ্ঞাবান সিনিয়র নেতারা এখন বার্ধক্য ক্লাবে। তিনি বুঝতে পেরেছেন, এখনই যদি নতুন নেতৃত্ব তৈরি না করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগে ভয়াবহ শূন্যতা তৈরি হবে। সেজন্য তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাজনকে সুযোগ দিচ্ছেন। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার যদি কেউ না করতে পারেন সেটা তার ব্যর্থতা, শেখ হাসিনার নয়। একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, গত তিন মেয়াদে মন্ত্রিসভার মাধ্যমে শেখ হাসিনা একটি নতুন জেনারেশনকে সামনে আনছেন। এরা যে সবাই সফল হবেন এমন নয়। কিন্তু যারা সফল হবেন তারা আগামী দিনে আওয়ামী লীগের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা যায়, মন্ত্রিসভায় এলাকাভিত্তিক বিষয়টির একটি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ পাওয়া যায় শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায়। যেমন মেহেরপুর, একটি জেলা। এখান থেকে কোনোদিন কেউ মন্ত্রী হননি। এবার শেখ হাসিনা ওই এলাকার একজনকে মন্ত্রী করেছেন। এতে যিনি মন্ত্রী (প্রতিমন্ত্রী) হয়েছেন তিনি না, এলাকার মানুষ সম্মানিত হয়েছেন। এভাবে, নানারকম নিরীক্ষা করে মন্ত্রিসভা করা হয়েছে। যার লক্ষ্য একটাই, দলকে শক্তিশালী করা, নতুন নেতৃত্ব খুঁজে বের করা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন ‘ভুল’ অতীতে বঙ্গবন্ধু ছাড়া কি কেউ করেছে? আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠিত নেতারা ছিলেন তাদের এলাকার ‘জমিদার’। তারা শুধু তার এলাকা বা আসনে দ্বিতীয় নেতার উত্থান প্রতিহত করতেন না, ওই এলাকাকে মুঠোবন্দী করতেন। ‘এক নেতার এক অঞ্চল নীতিতে’ আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্বের বিকাশ মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ওই নেতার সিদ্ধান্তেই স্থানীয় কমিটি হতো, ওই নেতার নির্দেশেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ চলত।

শেখ হাসিনা যখন ওই একক নেতার একক কর্তৃত্ব খর্ব করে, সেখানে অন্য একজন আনকোরা কাউকে মন্ত্রী করেছেন, তখন কর্মীরা উৎসাহিত হয়েছেন। তাদের কাছে একটি বার্তা স্পষ্ট হয়েছে যে, কাজ করলে আওয়ামী লীগে নেতাও হওয়া যাবে। ধরা যাক, শেখ হাসিনা ৯৬ সালের মতোই ২০০৯ থেকে টানা তিনবার একই মন্ত্রিসভা রাখতেন। তাহলে কি কি হতো একবার কল্পনা করা যাক। একেকজন মন্ত্রী একেকজন ‘দানবে’ পরিণত হতেন। তাদের দাপটে অস্থির থাকত জনগণ। তাদের কোটারি গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি হতো মন্ত্রণালয়গুলো। ওই মন্ত্রীদের এলাকাগুলোতে মন্ত্রীদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা হতো। দলের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যেত। সাধারণ মানুষের মধ্যে একঘেয়েমি তৈরি হতো। ক্ষোভ বাড়ত। শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার অদল-বদল করে একটা পরিবর্তনের আমেজ রেখেছেন। যে দেশে একজন মানুষ টানা পাঁচ মিনিট এক টেলিভিশন চ্যানেল দেখেন না, রিমোট দিয়ে চ্যানেল ঘুরিয়ে দেন, সে দেশে এক মন্ত্রীকে দীর্ঘদিন দেখলে সাধারণ মানুষের কি প্রতিক্রিয়া হতো তা অনুমান করার মতো প্রজ্ঞা আমাদের কজনার আছে? এই প্রজ্ঞা শেখ হাসিনার আছে। কয়েকজন নেতার আধিপত্য নষ্ট করে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে সাধারণ কর্মীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। এটা তো শেখ হাসিনার ভুলই।

‘শেখ হাসিনা বন্দনা’ নিয়ে কিছু বলা দরকার। যদিও এক্ষেত্রে তার করণীয় কিছুই নেই। কিন্তু যারা বন্দনা করছেন, তাদের কি শেখ হাসিনা প্রশ্রয় দিচ্ছেন? শেখ হাসিনার একক কারিশমায় বাংলাদেশে যা হয়েছে তাতে এই বন্দনা তো কম। ভারতে মোদি মাত্র এক মেয়াদ শেষ করে দ্বিতীয় মেয়াদে গেছেন। ভারতজুড়ে মোদি সমর্থকরা এতেই তো অস্থির। মোদিকে যেভাবে প্রশংসার সাগরে ভাসানো হচ্ছে, তার তুলনায় শেখ হাসিনা বন্দনা কি অনেক মার্জিত আর কম নয়? একটি দেশকে যিনি এভাবে নতুন পরিচয় দিয়েছেন তার এটুক প্রশংসায় আমাদের বুকে কষ্ট হয় কেন?

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর আমলাদের বাড়াবাড়ি রকমের চাটুকারিতা দৃষ্টিকটু পর্যায়ে পৌঁছেছে। অভিযোগ উঠেছে, আমলারাই এখন সরকার চালাচ্ছেন। এদের অনেকেই আওয়ামী লীগ নেতার মতোই আচরণ করছেন। আমলাদের এই বাড়াবাড়ি কি শেখ হাসিনার প্রশ্রয়ে হচ্ছে? এটাও কি তার ভুল? একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, এক সময় আমলারা ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকার আসে, সরকার যায় কিন্তু আমলারা থাকেন। আওয়ামী লীগ আমলের অর্থসচিব বিএনপির সময়ে এসে ক্যাবিনেট সচিব হয়ে যান। ব্যর্থতা কিংবা দুর্নীতির অভিযোগের আঁচড়ও তাকে স্পর্শ করে না। রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে পাহাড়ের মতো বাধার নাম আমলাতন্ত্র। শেখ হাসিনা আমলাতন্ত্রের এই পাহাড় গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে আমলাদের সম্পৃক্ত করেছেন। তাদের আদর্শহীন লোভী চেহারা উন্মোচন করেছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলারা কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা নন। বরং একটি রাজনৈতিক সরকারের অঙ্গীকার পূরণের বাহন। শেখ হাসিনা এটা করেছেন, এটা তো তার ভুল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন তো এরকমই ভুলে ভরা। ভুল করতে করতেই তিনি ’৭৫-এর পরবর্তী ভঙ্গুর আওয়ামী লীগকে চারবার ক্ষমতায় এনেছেন। ভুল করতে করতেই তিনি দারিদ্র্যের হার ২১ ভাগে নামিয়ে এনেছেন। ভুল করেছেন বলেই তিনি নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করার সাহস দেখিয়েছেন। ভুল করেই তিনি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় নিয়ে গেছেন। দুর্নীতি, ব্যর্থতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ গত ১০ বছরে যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা গর্ব করার মতোই। সাধারণভাবে প্রথমে তার সিদ্ধান্ত ‘ভুল’ হিসেবে বিবেচিত হয়, তারপর ‘বন্দনা’ হয়। এ বিষয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শেখ হাসিনার অদ্ভুত মিল। বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন, তখন বলা হয়েছিল ‘ভুল’। জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণকে অনেকে ভুল বলেছিল। ভুল পথে, ভুল করেই তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন। শেখ হাসিনাও ভুল করেই বাংলাদেশকে বদলে দিচ্ছেন। শেষে একটি কথা পন্ডিতদের জন্য বিনীতভাবে বলতে চাই-  আমাদের সৌভাগ্য হলো আমরা এই দেশে শেখ হাসিনার মতো কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর, দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক পেয়েছি। যিনি স্বপ্ন শুধু দেখেন না, স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিরলস কাজ করেন। আর আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, শেখ হাসিনার অনন্য উচ্চতা আমরা মূল্যায়ন করতে পারি না। তার দূরদর্শী সিদ্ধান্তকে সাদা চোখে ভুল মনে হয়।

নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

ই-মেইল :[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর