শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

‘শগঋপ’ হতে পারত কৃষকের শক্তি

শাইখ সিরাজ

‘শগঋপ’ হতে পারত কৃষকের শক্তি

অর্থনীতি শাস্ত্রমতে বাজারে একটি পণ্যের দাম নির্ভর করে পণ্যের চাহিদা ও জোগানের ওপর। জোগান বেশি হলে চাহিদা কম থাকে। চাহিদা কম থাকলে পণ্যের দামও পড়ে যায়। এটি খুব সাধারণ একটি বিষয়। কৃষি বাজারের ক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য হচ্ছে মৌসুমে পণ্যের দাম থাকে কম। তাই যারা অমৌসুমের ফল-ফসল চাষ করেন তারা অল্পতেই বেশি লাভ করতে পারেন। কিন্তু সব ফসল তো আর অমৌসুমে চাষ করা সম্ভব নয়। আবার বেশি লাভের আশায় সবাই যদি অমৌসুমে চাষ শুরু করেন, তাও একটা মৌসুম হয়ে দাঁড়াবে। চাহিদা ও জোগানের সূত্রটিকে কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেদের প্রয়োজনে কখনো জোগান বাড়িয়ে আবার কখনো জোগান কমিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণ একজন কৃষক বাজারের কূট প্যাঁচগুলো অনুধাবন করতে পারে না। কৃষক জানে কীভাবে উৎপাদন করতে হয়, ফসলের মাঠে নিমগ্ন শিল্পীর মতো মাটি থেকে ফলিয়ে আনে সোনার ফসল। মা যেমন সদ্যোজাত সন্তানের মুখ দেখে ভুলে যান প্রসব যন্ত্রণা, কৃষকও তার মাঠে উৎপাদিত ফসল দেখে ভুলে যায় সব বঞ্চনা। সেই ফসলেরও যখন ন্যায্যমূল্যটি কৃষক পায় না তখন কষ্টে বুক ভেঙে যায় তার। এই সময়ে এসে বলা যায় কৃষকের উৎপাদিত ফল-ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়াটাই বড় একটি সংকট আমাদের কৃষি অর্থনীতিতে।

মৌসুমে কৃষক উৎপাদিত ফল-ফসলের দাম পায় কম- সারা পৃথিবীতেই এমন। তবে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে কিছু কিছু কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, যাতে কৃষক পণ্য বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আর আমাদের মতো দেশের কৃষক যাদের গুদামজাত করার সুযোগ রয়েছে তাদের কেউ কেউ মৌসুমের পরে বাজারে যখন পণ্যের দাম ভালো থাকে তখন বিক্রি করার সুযোগ থাকলেও অধিকাংশ কৃষককে মৌসুমের শুরুতেই উৎপাদিত ফল-ফসল বিক্রি করে দিতে হয়। কারণ আমাদের দেশে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা সাধারণত মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ফসল উৎপাদনের খরচটুকু মেটায়। তাই ফসল উৎপাদনের পর দ্রুত সেই ফসল বিক্রি করে মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে হয়। আর না হলে পরের মৌসুমে সে ফসল চাষের জন্য ঋণ পাবে না। ঋণ মেটাতে কম মূল্যেই তাকে ফসল বিক্রি করে দিতে হয়। শ্রমে-ঘামে ফলানো ফসলের ন্যায্যমূল্যটুকু সে আর পায় না। মনে পড়ছে কৃষকদের উৎপাদিত শস্যের অভাবতাড়িত বিক্রয় রোধ করে কৃষককে ন্যায্যমূল্য পাওয়ার জন্য সহযোগিতা করতে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের যৌথ উদ্যোগে BASWAP (Bangladesh Switzerland Agricultural Project)   প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। প্রজেক্টের মডেল অনুযায়ী কৃষক তার উৎপাদিত ফসল গুদামে মজুদ রেখে, সেই মজুদকৃত ফসলের ওপর ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারত। ঋণের টাকায় পরবর্তী চাষ কার্যক্রম পরিচালনা ও জীবন নির্বাহ করার সুযোগ পেত কৃষক। শস্যের বাজার দাম বেশি হলে গুদাম থেকে শস্য ছাড়িয়ে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করত। সেই আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে মাটি ও মানুষে এ কার্যক্রম নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম। এই প্রজেক্টটি বেশ কার্যকর ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যতটুকু মনে পড়ছে, প্রারম্ভিক অবস্থায় ৫-৬টি স্থানে পাইলট আকারে শুরু হলেও এর সফলতার ফলে খুব দ্রুতই প্রজেক্টের আকার বড় হতে থাকে। সুইজারল্যান্ড সরকারের সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে ১৯৯২ সালে সম্পূর্ণ জিওবির অর্থায়নে BASWAP- কে ‘শস্য গুদাম ঋণ প্রকল্প (শগঋপ)’ নামে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদফতরের মাধ্যমে নতুন প্রকল্পে যুক্ত করা হয়। নব্বইয়ের দশকেও এ প্রকল্পটি নিয়ে আমি বেশ কিছু প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম। শগঋপ ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রকল্প হিসেবে কার্যকর ছিল। ২০০৪ সাল থেকে এটিকে যুক্ত করা হয় সরকারের রাজস্ব বাজেটের আওতায় কর্মসূচি আকারে। ৩৩টি জেলার ৮২টি উপজেলায় ১১৯টি গুদামে শস্য গুদাম ঋণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কার্যক্রমটি ২০১০ সাল পর্যন্ত কর্মসূচি আকারে আলাদাভাবে পরিচালিত হলেও পরবর্তীতে এটিকে কৃষি বিপণন অধিদফতরে অন্তর্ভুক্তি করা হয়। সফল এই কার্যক্রমটি হঠাৎ করেই যেন মুখ থুবড়ে পড়ে। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম গুদামের সংখ্যা কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে ৮১টিতে।

‘শগঋপ’ শুধু ফসল মজুদের সুবিধাদিই দিত না। এটি ছিল কৃষি বাণিজ্যের একটি চমৎকার মডেল। কৃষককে প্রতি কুইন্টাল ফসল মজুদ রাখার জন্য ১০ টাকা হারে গুদাম ভাড়া দিতে হয়। খাদ্যশস্য ছয় মাস, আর বীজ হিসেবে নয় মাস রাখার সুযোগ রয়েছে। যতদূর জানি গুদামের আয় ব্যাংকে জমা হতো। সঠিকভাবে এই কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে কৃষকই শুধু লাভবান হতো না, সরকারও লাভবান হতো। 

সফল ‘শগঋপ’ ২০১০-এর পর থেকে ব্যর্থতায় পর্যবশিত হওয়ার কারণ কি সেটা অনুসন্ধানের দাবি রাখে। তবে আমি যতদূর জেনেছি এবং আমার যা মনে হয়েছে ‘শগঋপ’কে কৃষি বিপণন অধিদফতরে অন্তর্ভুক্তি করার কারণে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ জটিলতা এই সংকটের জন্য দায়ী। প্রথমত কৃষি বিপণন অধিদফতরের ইউনিয়ন তো দূরে থাক, উপজেলা পর্যায়ে কাজ করার মতো সুগঠিত অর্গানোগ্রাম নেই। তাদের সেরকম কার্যক্রমও নেই। দ্বিতীয়ত ‘শগঋপ’ এর কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়েও তারা সুচিন্তিত কোনো পরিকল্পনা নেয়নি। ‘শগঋপ’ ব্যর্থতার আর একটি কারণ তারা নিজস্ব ১২টি গুদাম ছাড়াও এলজিইডির অব্যবহৃত ১০৭টি গুদাম ব্যবহার করে। সেই গুদামগুলো সময়ের সঙ্গে সংস্কার করা হয়নি। নানা সময়ে পত্র-পত্রিকায় শস্যগুদাম থেকে শস্য উধাও হওয়ার সংবাদও পাওয়া গেছে। অসাধু ব্যাংককর্মী ও গুদামকর্মীদের কারণে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমনটিও ঘটেছে। বলা চলে সুষ্ঠু মনিটরিং ব্যবস্থা ছিল না।

কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেটের এক আসরে নাটোরে কৃষক রফিকুল ইসলাম ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন, “কখনো কোনো রাজনীতিবিদকে তো দেখি নাই রাজনীতি করে নিঃস্ব হয়ে যেতে, সেটা সরকারি দলের হোক আর বেসরকারি দলেরই হোক, কৃষক কেন কৃষি ক্ষেতি করে নিঃস্ব হয় তার খোঁজখবর তো কেউ নেয় না। আপনারা তিল থেকে তাল হইছেন, শিল্পপতি হইছেন। আর আমাদের পুঁজি নাই, আমাদের বাজার নিয়ে কেউ ভাবে না, আমাদের কথা কেউ বলে না।” এই ক্ষোভ শুধু রফিকুল ইসলামের নয়, প্রতিটি কৃষকের। কৃষকের জন্য সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থার পাশাপাশি উৎপাদিত ফল-ফসল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। মহাজন কিংবা মহাজনদের মতো যারা কৃষকের দুরবস্থাকে পুঁজি করে নিজেদের ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করেছে তারা চায় না মহাজনী দুষ্টুচক্র থেকে কৃষক বের হয়ে যাক। খুব সম্ভবত এ কারণেই ‘শগঋপ’-এর মতো কর্মসূচিগুলোও মুখ থুবড়ে পড়ে।

‘শগঋপ’কে নিয়ে সরকার নতুনভাবে চিন্তা করতে পারে। এটিকে আবার সত্যিকার অর্থে কার্যকর করে তোলা প্রয়োজন। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন করে সাজানো গেলে এটি কৃষকের জন্য যেমন উপকারী তেমনি সরকারের একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। এটিকে কৃষি বিপণন অধিদফতরের একটি সেকশনে বন্দী না রেখে, আলাদা উইংয়ের মাধ্যমে কার্যকর করা যেতে পারে। দক্ষ জনবলের মাধ্যমে পরিচালিত করার জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত অর্গানোগ্রাম। এলজিইডির পুরনো সেকালের গুদামে নয়, বরং সময়োপযোগী আধুনিক গুদাম তৈরি করতে হবে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে যখন

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা-খরা প্রতিনিয়তই আমাদের তাড়িত করছে তখন স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্যশস্য মজুত বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। কারণ কোথাও দুর্যোগ হলে অন্য স্থান থেকে খাদ্য সরবরাহ করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রেও ‘শগঋপ’-এর মতো খাদ্যশস্য বা ফল-ফসল মজুত কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

কৃষককে ভয়ানক মহাজনী ঋণের হাত থেকে রক্ষা করতে এর ফল-ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ‘শগঋপ’-এর মতো কার্যক্রমকে আধুনিকায়ন করে পুনঃজীবিত করার কথা সরকার ভেবে দেখতে পারে।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর