শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মাটিতে হৃদয় প্রোথিত তার

আতাউর রহমান

সভ্যতার সংজ্ঞা যুগে যুগে পাল্টে যায় এবং আমরা যে যার মতো করে সভ্যতার সংজ্ঞা দিয়ে থাকি। মানুষ আসলে সভ্য হতে শুরু করল যখন সে তার ভূমিষ্ঠ হওয়ার স্থান এবং পরবর্তীতে বাসস্থানের প্রতি হৃদয়ের টান অনুভব করতে শুরু করল। যাকে বলা যায় মাটির মায়া। শিল্প-সভ্যতা, কারিগরি সভ্যতা, মহাকাশ সভ্যতা পাড়ি দিয়েও আমরা আদি ও অকৃত্রিম কৃষি সভ্যতার কাছে ফিরে যাই। রবীন্দ্রনাথের চন্ডালিকা গীতিনাট্যে মেয়ে-পুরুষদের কণ্ঠে ফসল কাটার যে আহ্বান-গান শুনি তা আমাদের সবার হৃদয়ের গান হয়ে যায়।

“মাটি তোদের ডাক দিয়েছে-  আয়রে চলে

আয় আয় আয়

ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে-

মরি হায় হায় হায়।

হওয়ার নেশায় উঠল মেতে

দিগ্বধূরা ফসল-ক্ষেতে,

রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে ধরার আঁচলে-

মরি হায় হায় হায়।”

একটি দেশের সমৃদ্ধি লুকিয়ে আছে তার মাটিতে, আজ এই কট্টর বাজার অর্থনীতির যুগেও এই সত্য-উপলব্ধি হারিয়ে যায়নি। একটি দেশ যদি তার প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়, তাহলে মৌল চাহিদা মিটে যায়। আমাদের দেশ কৃষিনির্ভর। আমরা দেশে শিল্পায়ন ঘটাব, এটা যুগের চাহিদা, আমাদেরও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, দেশকে আধুনিকীকরণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তিকে আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে কিন্তু কৃষিকে অবহেলা করে নয়। আদি অকৃত্রিম কৃষিকাজের মধ্যে নিহিত আছে দেশের সব মানুষের ভাগ্য। যদি আমরা খাদ্যশস্য উৎপাদনে সার্বিক স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারি তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা অনেকাংশে লাঘব হবে। বাংলাদেশের ভূমি উর্বরা, নদীমাতৃক এই দেশ। যতই বন্যা বা খরা হোক না কেন, সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি স্বীকৃত। বাংলার মহান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ সত্যটি বহুকাল আগে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি তার পুত্র ও জামাতাকে কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার জন্য আজ থেকে বহুকাল আগে সুদূর আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন। কৃষিকাজে যে, আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশের মোক্ষ নিহিত এই সত্যটি আমাদের দেশের অনেক নেতৃবর্গই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কিন্তু তা কাজে প্রতিফলিত করতে পারেননি যথাযথ উদ্যোগের অভাবে।

আমাদের দেশের মানুষকে কৃষিমুখী করতে সত্যিকার উদ্যোগ নিয়েছেন শাইখ সিরাজ। তরুণ শাইখ সিরাজ বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৮২ সালে ‘মাটি ও মানুষ’ নামে কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন। এ অনুষ্ঠান নির্মাণ করার পেছনে তার আন্তরিকতা, শ্রম ও মেধা দেখে তখনই মনে হয়েছে তার হৃদয় সত্যিকার অর্থে দেশের মাটিতে প্রোথিত। শুধু কৃষিকাজ বা শস্য ফলানো বা গাছপালা লাগানো নয়, শাইখ সিরাজ দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি নির্মাণেরও অগ্রপথিক। তিনি মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালনের প্রতিও গ্রাম বাংলার জনসাধারণকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামগঞ্জে ধূলি-কণার সঙ্গে তিনি বন্ধুত্ব পাতিয়েছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলকে নিকট করেছেন, আত্মীয়তা করেছেন দেশের অসংখ্য নিরন্ন ও অসহায় মানুষের সঙ্গে। তার এক সময়ের মাটি ও মানুষ ও পরবর্তীতে চ্যানেল আই-এর হৃদয়ে মাটি ও মানুষ, বিটিভির কৃষি দিবানিশি কিংবা চ্যানেল আই-এর ছাদকৃষি অনুষ্ঠান শহর গ্রাম সবখানের মানুষকে বেঁধেছে কৃষির প্রতি ভালোবাসার এক সূত্রে। এ ধরনের ব্যাপক ও গভীর কাজের জন্য প্রত্যয় ও আদর্শের প্রয়োজন হয়, যাকে আমরা missionary zeal বলি; শাইখ সিরাজের বিশ্বাসে ও ভাবনায় তা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

শাইখ সিরাজ অক্লান্তভাবে দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তার এই উদ্যোগী পথচলার বিরতি নেই। একজন বেসরকারি ব্যক্তি-মানুষের উদ্যোগ যে ব্যাপক ও বিরাট হতে পারে, শাইখ সিরাজ তার বড় প্রমাণ। মাদার তেরেসা তার মানবদরদি প্রতিষ্ঠান ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজ উদ্যোগে। আজ ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’ এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ‘আমরাই আমাদের দেশ গড়ব’ এ স্লোগান বৃথা যেতে পারে না, কারণ শাইখ সিরাজের মতো অগ্রপথিকেরা আছেন এ স্লোগানকে বাস্তবায়ন করার জন্য।

শাইখ সিরাজ যে বড় কাজটি করেছেন তা হলো তিনি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির প্রতি দেশের আপামর জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছেন এবং তাদের অনুপ্রাণিত করছেন, যা কালে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করবে। জার্মানির মতো উন্নত দেশের গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ আমার হয়েছে এবং দেখেছি সেখানকার কৃষকরা নগরবাসী মানুষের তুলনায় বেশি সুখী ও বিত্তবান। অনেক কৃষকের গ্রামের বাড়ির সামনে একাধিক  মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তাদের বাড়ি ও বাড়ির আঙ্গিনা দৃষ্টিনন্দন।

শাইখ সিরাজ ভূতে পাওয়া মানুষের মতো একটি বড় কাজের পেছনে নিরলস লেগে আছেন। তার বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে তিনি বাস্তবে মূর্ত করতে চান। আমাদের সমাজে এমন ভূতে পাওয়া এবং সাহসী মানুষের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। রবীন্দ্রনাথের একটি ইংরেজি বাক্য দিয়ে শেষ করি- The personal man is not dead, only dominated by the organized man। শাইখ সিরাজদের মতো মানুষ (personal man) আছেন বলেই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ আছে।

শাইখ সিরাজের জন্মদিনে আমার প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর