শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

হিজরি সনের গুরুত্ব এবং আশুরার তাৎপর্য ও করণীয়

মাওলানা মুফতি মিজানুর রহমান : সিনিয়র পেশ ইমাম : বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

হিজরি সনের রয়েছে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে তার কাছে একটি চুক্তিপত্র আনা হয়। সেখানে শাবান মাসের কথা উল্লেখ ছিল। তখন ওমর (রা.) বললেন, এটা কি গত শাবান না আগামী শাবান মাস? অতঃপর তিনি তারিখ গণনার নির্দেশ দিলেন এবং রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদিনায় হিজরতকে কেন্দ্র করে হিজরি সন গণনার সূচনা করেন। এ সময় মহররমকে প্রথম মাস হিসেবে গণ্য করা হয়। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিজরত করেন ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই। সেই দিনকে মহররম মাসের শুক্রবার হিসেবে ধরে হিজরি সাল গণনা শুরু হয়। উক্ত হিজরি হিসাবের প্রথম প্রয়োগ ঘটে ওমর (রা.)-এর শাসনামলের ৩০ জমাদিউল উখরা/ ১৭ হিজরি অর্থাৎ ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় আজো হিজরি সন চলে আসছে। হিজরি সন গণনার আগে আরবরা আরবি মাসগুলো ব্যবহার করতেন। অন্য সব সনের মতো হিজরি সনেও ১২টি মাস রয়েছে। কেননা, আল্লাহর কাছেও ১২ মাসে এক বছর। যেমন, তিনি ঘোষণা করেন, নিশ্চয়ই আকাশম-লী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাস গণনার বারোটি মাস, তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। (সূরা তাওবাহ-৩৬)।

এ দ্বারা আরও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর দৃষ্টিতে শরিয়তের আহকামের ক্ষেত্রে চন্দ্র মাসই গ্রহণযোগ্য। চন্দ্র মাসের হিসাব মতেই রোজা, হজ ও জাকাত প্রভৃতি আদায় করতে হয়। তবে কোরআন মজিদ চন্দ্রকে যেমন, তেমনি সূর্যকেও সাল তারিখ ঠিক করার মানদ-রূপে অভিহিত করেছেন। সুতরাং চন্দ্র ও সূর্য উভয়টির মাধ্যমেই সাল-তারিখ নির্দিষ্ট করা জায়েজ। তবে চন্দ্রের হিসাব আল্লাহর কাছে অধিকতর পছন্দনীয়। তাই শরিয়তের বিধি-বিধানকে চন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রেখেছেন। এজন্য চান্দ্র বছরের হিসাব সংরক্ষণ করা ফরজে কেফায়া। সব উম্মত এ ভুলে গেলে সবাই গুনাহগার হবে।

মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনার মাস বারোটি, আসমানসমূহও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। কাজেই এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার কর না (সূরা তাওবা-৩৬)।

এ আয়াতের চারটি সম্মানিত মাসকে চিহ্নিত করতে গিয়ে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের সময় মিনা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বলেন, তিনটি মাস হলো জিলকদ, জিলহজ ও মহররম এবং অপরটি হলো রজব (তাফসির ইবনে কাসির)। হিজরি সন অনেক কারণেই গুরুত্ব বহন করে। হিজরি সন হলো চন্দ্র মাস। আর আল্লাহতায়ালা চন্দ্রকে সময় নির্ধারণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এজন্য তাঁর সৃষ্টির উদ্দেশের প্রতি সম্মানার্থে হিজরি সন গণনা করা অপরিহার্য কর্তব্য। মহান আল্লাহতায়ালার বাণী- লোকেরা আপনাকে নবচন্দ্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আপনি বলুন, তাহলে মানুষের এবং হজের জন্য সময় নির্ধারণকারী (সূরা বাকারা-১৮৯)। এ আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, আল্লাহতায়ালা বান্দাদের হিসাব-নিকাশের সুবিধার্থে পঞ্জিকাস্বরূপ চন্দ্রকে সৃষ্টি করেছেন। এ জন্য, চন্দ্র মাস তথা হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম।

মহান আল্লাহ চন্দ্র মাস সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলেন- আমি রাত ও দিনকে করেছি দৃষ্টি নিদর্শন, রাত্রির নিদর্শনকে অপসারিত করেছি এবং দিনের নিদর্শনকে আলোকোজ্জ্বল করেছি যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করতে সক্ষম হও এবং রাতে তোমরা বর্ষ-সংখ্যাও হিসাব করতে পার এবং আমি সবকিছু বিশদভাবে বর্ণনা করছি। এ আয়াত থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, আল্লাহতায়ালা অনুগ্রহ স্বরূপ তাঁর বান্দাদের সাল গণনা ও অন্যান্য হিসাব-নিকাশের জন্য দিন-রাতকে সৃষ্টি করেছেন। হিজরি সাল গণনা করা হয় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ফলে হিজরি সন ব্যবহার ও গণনার ফলে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আবু বকর (রা.) সেই হিজরতের ঘটনা মুসলিম হৃদয়ে বার বার দোলা দেয়। ইসলামের অধিকাংশ ইবাদত-বন্দেগি যেমন : রোজা, হজ, কোরবানি, শবেকদর, শবেবরাত, আশুরা ইত্যাদি ইবাদত হিজরি সনের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। ফলে হিজরি সনের ব্যবহারের মাধ্যমে সঠিক সময়ে ইবাদত বন্দেগি পালন করে; মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন লাভ করা সম্ভব হয়। এ জন্য তাফসিরে মাআরেফুল কোরআনে, হিজরি সন তথা চন্দ্র মাস গণনাকে ফরজে কেফায়া হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যদি উম্মতের একজনও এর ব্যবহার না করে তাহলে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ গুনাহগার হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

হিজরি সন গণনা ইসলামী সংস্কৃতির অনুসরণ। এ জন্য চন্দ্র মাস হিসেবে হিজরি সন গণনা করা মুসলমানদের জন্য কর্তব্য। হিজরি সন ইসলামী ঐতিহ্যের বাস্তব নমুনা। যা নিজ ঐতিহ্যকে অনুসরণ, অনুকরণ করতে শেখায়। আশুরা মহররম মাসের ১০ তারিখকে বলা হয়। ইসলাম ধর্মে এই দিবসটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ এই দিনে ইসলামের অনেক ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলি সংঘটিত হয়েছে।

যেমন : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, (একদা) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহুদিদের কতিপয় এমন লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন, যারা আশুরার দিনে রোজা রেখেছিল। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কিসের রোজা?’ উত্তরে তারা বলল, ‘এই দিনে আল্লাহতায়ালা হজরত মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ডুবে যাওয়া থেকে উদ্ধার করেছিলেন। (অন্য বর্ণনায় আছে ফিরাউনের নির্যাতন থেকে মুক্ত করেছিলেন)

সর্বশেষ খবর