রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সংস্কৃতিক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ একেবারে তলানিতে

কামাল লোহানী

সংস্কৃতিক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ একেবারে তলানিতে

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমন নাজুক তেমনি রাজনীতির সম্পূরক সত্যি- সংস্কৃতি নানাভাবে বহুদিন থেকে অবহেলিত। সংস্কৃতির প্রসঙ্গে অন্য কোনো সরকারের তেমন কোনো আগ্রহ থাকার কথা নয়, কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে আওয়ামী লীগই ছিল প্রধান শক্তি। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের লোকজ সংস্কৃতির যে বিপুল ভান্ডার অনাবিষ্কৃত রয়েছে তাকে উদ্ধার করে ব্যাপক চর্চার মাধ্যমে জনগণের সামনে উপস্থাপনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন শিল্পকলা একাডেমি। রাজনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতি যে কতটা দুরন্ত হাতিয়ার তা তিনি পাকিস্তানি জামানায় কিংবা তারও আগে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে লক্ষ্য করেছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল দেশের এ অনউদঘাটিত সম্পদের বিকাশ ও প্রচার করা। বিপুল এ ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রাচুর্যের উত্তরাধিকার আমাদের থাকলেও আমরা যথাযথভাবে তাকে পরিচর্চা ও বিকাশে কাজ করতে পারিনি। অথচ পশ্চিমের ব্যান্ড সংগীতের যে প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, তার বিস্তার ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আমরা তো জানিই চল্লিশের দশক থেকে এ বাংলার মানুষ ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং ওদের সৃষ্ট কালোবাজারি ও চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে অসাধারণ আধুনিক সংগীত- গণ সংগীতের উদ্ভব ঘটিয়েছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের মাধ্যমে। তারও আগে যাত্রাসম্রাট মুকুন্দ দাস ব্রিটিশ সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যেমন মানুষের মধ্যে স্বদেশি গান পরিবেশন করে মানুষকে অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানিয়েছিলেন সে কারণে তাকে গ্রেফতার, জেল-জুলুমসহ নানা গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের কাছে স্বদেশি সংস্কৃতি কেবলই বাধা পেয়েছে এবং নিষেধাজ্ঞার জালে জড়িত ছিল। ওই সময়ে সংস্কৃতির জন্য বাজেট বরাদ্দ পাওয়ার কোনো আশা ছিল না। তা সত্ত্বেও স্ব-উদ্যোগে গ্রামে গ্রামে যাত্রা ও পালাগানের মাধ্যমে এবং পরে চল্লিশের দশক থেকে গণসংগীতের বিপুল চর্চায় ঋদ্ধ হয়ে সংস্কৃতির চরিত্রই পাল্টে গিয়েছিল। যার জন্য ইংরেজ শাসকেরা আমাদের ওপর জুলুম চালিয়েছে নিরন্তর। অবশেষে ব্রিটিশ চক্রান্তে ভারত দ্বিখন্ডিত হওয়ার পর আমরা যখন পাকিস্তান ভূখন্ডে পড়লাম তখন পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকেরা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ চালাল। ফলে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, তৎকালীন শাসক দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ১৯৫৪ সালে শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট লীগশাহীকে সমূলে উৎপাটিত করে যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, তা প্রতিহিংসাপরায়ণ মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় সরকার সহ্য করতে পারেনি। অবশেষে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে দেশের সর্বময় ক্ষমতা দখল করেন। ১০ বছর পর্যন্ত স্বৈরশাসনের পর ওই সেনাবাহিনীরই প্রধান সেনাপতি লে. জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করেন। সুতরাং, সামরিক শাসনকালে তাদের ইচ্ছেমতো সরকারি ব্যবস্থাপনায় মাঝে মধ্যে  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো তাছাড়া সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে তাদের কোনই অবদান ছিল না। কিন্তু এ সময়ে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন লীগশাহী থেকে শুরু করে এ সেনা সর্দারদের শাসনামলেও নানা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক প্রবল স্রোত বাংলায় সৃষ্টি হয়েছিল। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনৈতিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে গান, কবিতা, নাটক, নৃত্যনাট্য এমনকি চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে দেশবাসীকে জুলুমশাহীর বিরুদ্ধে সংগঠিত করতে সহায়তা করেছে। আমরা তাই ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে নানা সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রথমদিকে এককভাবে এবং পরে সম্মিলিতভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছি। ফলে আমাদের উচ্চকিত কণ্ঠস্বর রাজনৈতিক আন্দোলনকেও শক্তিশালী করেছে। আমরা বিজয়ী হয়েছি। আগামী বছর মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী পালনে উদগ্রীব হয়ে আছি। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হলো আমাদের দেশ- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সশস্ত্র লড়াই ও লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে মুক্তিযুদ্ধের গান, পাকিস্তানে অবহেলিত লোকজ ঐতিহ্য এবং ব্রিটিশ আমল থেকে নাটকের ওপর যে নিষেধাজ্ঞার খড়গ ঝুলছিল তার থেকে মুক্তি পেয়েছি। বড়ই পরিতাপের বিষয়, মুক্ত স্বদেশেও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে তেমনভাবে সরকারি সহযোগিতা প্রদান করা হয়নি। কিন্তু সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো টানাপড়েনের মধ্যে যেভাবেই হোক আন্দোলন চালিয়ে গেছেন এবং আজও তাদের কেউ কেউ তৎপর রয়েছেন। সামান্য একটি বাজেট, যা উল্লেখ করবার মতো নয়। তা থেকেই একটি তহবিল সরকার সৃষ্টি করে সংস্কৃতি ক্ষেত্রের বিভিন্ন সংস্থা ও গোষ্ঠীকে যে বরাদ্দ দিয়ে আসছেন তা কেবল ‘কাক তাড়ানো’ বৈ কিছু নয়। সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে যথার্থ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশে বিদেশে জনসমক্ষে উপস্থাপনের জন্য আমাদের যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত ছিল তা কোনো সরকারই গ্রহণ করতে পারেনি। বাজেট বরাদ্দের বাইরে আওয়ামী লীগ আমলেই কেবল একবার একশ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পরে তিনি সংস্কৃতির বাজেট বরাদ্দ সামান্য বাড়ালেও এখনো তা তলানিতেই পড়ে আছে। তারপরও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট-বড় দলগুলো জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে আবেদনপত্র সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেন। এরপর অসংখ্য আবেদনপত্র বাছাই করে অর্থ বরাদ্দের জন্য নির্ধারিত কমিটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারপর কী যে হয় অর্থ বিতরণের ক্ষেত্রে, তা আমরা সংস্কৃতি জগতের সব মানুষ বুঝে উঠতে পারি না। যারা আবেদন করেন তাদের মধ্যে ১০ হাজার থেকে আরম্ভ করে ১০ লাখ পর্যন্ত দেওয়া হয়। কিন্তু অঙ্কের পরিমাণ, কার কী পরিমাণ দেওয়া হবে সেটা নির্ধারণ করে ওই কমিটি। কমিটিতে যারা থাকেন তারা নিজেদের তথ্য অনুসারে বিভিন্ন সংগঠনের নাম তালিকাভুক্ত করেন, তাতে করে দেখা গেছে সক্রিয় সংগঠন যে পরিমাণ অর্থ পান তার চেয়ে বেশি এবং অনেক বেশি পায় যাদের অস্তিত্ব নেই তারা অর্থাৎ সাইনবোর্ড সর্বস্ব সংগঠন। এতে করে গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলো হয় বাদ যাচ্ছে না হয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম টাকা বরাদ্দ পাচ্ছে। অর্থ বরাদ্দের সময় ‘যা খুশি তা’ করার প্রবণতা যেমন এ কমিটিকে ত্যাগ করতে হবে তেমনি জেলা থেকে নাম পাঠানোর সময় জেলা প্রশাসকেরা সততার সঙ্গে যাচাই করে সংগঠনের নাম পাঠাবেন। যেন কেবলমাত্র সরকার সমর্থনকারী সংগঠনই এক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত না হয় সেটাও দেখবে এ কমিটি। এ ধরনের অনিয়মের একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ হলোÑ বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। আমার মনে হয় এটি বাংলাদেশে কেন উপমহাদেশেও সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক সংগঠন। যার তিন শতাধিক শাখা জেলা উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তৃত। অথচ এ সংগঠনকে এবার মাত্র ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এতে আমরা ক্ষুব্ধ কারণ এ পরিমাণ টাকা দিয়ে বিভিন্ন জেলার আবেদনকারীদের মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, ‘কেন্দ্রকেই সব টাকা দেওয়া হয়েছে’। বিভিন্ন জেলা ভিন্ন ভিন্ন আবেদনে যে অর্থ বরাদ্দ পেত তাও এ কথা বলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সচেতন পাঠক, বুঝে দেখুন যে সংগঠনের সংখ্যা তিনশর অধিক, সেইখানে ২ লাখ টাকাই বা কি করে বণ্টন করা যাবে? আমরা বিস্মিত হই এবং ক্ষুব্ধ মনে খবর নিয়ে পর্যন্ত দেখেছি, সেসব অঞ্চলে যারা বেশ ভালো অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে অন্তত দুই লাখ টাকার বেশি তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই, সক্রিয় থাকা তো দূরের কথা। মন্ত্রণালয়কে মৌখিকভাবে এ অনিয়মের কথা বলা হলেও তারা কর্ণপাত করেনি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন সত্যিকার অর্থে দেশের প্রগতিতে যারা নিরন্তর অবদান রেখে চলেছেন, তাদের মধ্যে হয়তো অনেকেই উদীচীর ভাগ্য বরণ করেছে। আমার আবেদন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে এ অর্থ বিতরণের কাজটিকে মানবিক এবং যৌক্তিক পরিণতি দিতে পারে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন এ সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্মকর্তাদের ডেকে অথবা বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বাস্তব অবস্থা যাচাই করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। তাহলে হয়তো এ অনিয়ম কিছুটা দূরীভূত হতে পারে। তবুও শঙ্কা জাগে নিরন্তর যে ‘দুর্নীতি’ চলছে তা কি আদৌ দূর করা যাবে? আমি তো জানি কোনো কোনো সংগঠন বা সংস্থা পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত বরাদ্দ পান, এ ভাগ্যবানদের বিষয়ে সরকার তদন্ত করলে নিশ্চয়ই জানতে পারবেন এরা কতটা সক্রিয় এবং দেশ ও জনগণের জন্য কতটা কাজ করছেন। অনুগ্রহ করে সত্যের ভিত্তিতে বিচার করে সক্রিয় সংগঠনগুলোকে অনুদানের অর্থ বাড়িয়ে দিলে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক ন্যায়বিচারভিত্তিক সোনার বাংলা গড়তে সহায়ক হবে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাংলার লোকজ ঐতিহ্যটিকে তুলে ধরার কাজটিকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে। তাহলেই বাংলার বিপুল লোকশিল্প ভান্ডার বিকশিত হয়ে দেশে বিদেশে আমাদের সুনাম কুড়াতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।

 

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

সর্বশেষ খবর