সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভিআইপি সমাচার

আফরোজা পারভীন

ভিআইপি সমাচার

ভিআইপি মানে ‘ভেরি ইমপর্ট্যান্ট পারসন’। অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এই গুরুত্ব ওই ব্যক্তির পদের, তার চেয়ারের। তাই তিনি গুরুত্বপূর্ণ। আর তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ তা একদন্ডের জন্যও ভোলেন না। আর তাতেই হয় বিপত্তি!

বেশ কয়েক দিন আগে একজন যুগ্ম সচিবের কারণে ফেরি ছাড়তে তিন ঘণ্টা দেরি করেছিল। আর এই দেরির কারণে রক্তক্ষরণ হতে হতে মারা গেছে তমাল নামের এক কিশোর। তার বাবা-মা ফেরি কর্তৃপক্ষের পায়ে পড়ে কেঁদেছে, ছেলের প্রাণভিক্ষা চেয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। মন গলেনি ফেরি কর্র্তৃপক্ষের। একজন যুগ্ম সচিবের আগমন তাদের কাছে একটি কিশোরের জীবনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

বিষয়টা কতটা সত্য জানি না। আদৌ সত্য কিনা তা-ও জানি না। হয়তো অনেকটাই অতিরঞ্জিত। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপিতই বা হবে কেন? শুনেছি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত করলে হয়তো কে দোষী চিহ্নিত হবে। কিন্তু যে জীবন গেছে সে জীবন তো আর ফিরে আসবে না!

মহামান্য হাই কোর্ট রায় দিয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছাড়া কেউ ভিআইপি নয়, সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কিন্তু এই রায় কতটা কার্যকর হবে সেটা সময়ই বলবে! রাস্তায় চলতে আজকাল ভিআইপিদের দাপটে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। অ্যাম্বুলেন্স আটকে যায় তথাকথিত ভিআইপির নিরাপত্তাকর্মীদের হুইসেলের দাপটে। তাদের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে আটকে যায় হাজারো মানুষ। তাদের মধ্যে রোগী থাকে, প্রসূতি থাকে, বিয়ের বরযাত্রী থাকে, পরীক্ষার্থী থাকে, চাকরিপ্রার্থী থাকে। ভিআইপিদের জন্য ওরা সময়মতো পরীক্ষার হলে পৌঁছাতে পারে না, ইন্টারভিউতে পৌঁছাতে দেরি হয়, রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটে, বিয়ের লগ্ন পেরিয়ে যায়। এর প্রতিটি ঘটনা মানুষের জীবনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো গৌণ হয়ে যায় ওই নির্লজ্জ ভিআইপিদের পাঁচ-দশ মিনিট আগে পৌঁছানোর তাগিদে।

একজন ইউএনওর মোবাইল ফোন পানিতে পড়ে যাওয়ায় ডুবুরি এনে মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে। ওই মোবাইলে নাকি নানান অফিশিয়াল জিনিস ছিল? প্রশাসনে চাকরি আমিও বহু বছর করেছি। মোবাইলে টেলিফোন নম্বর ছাড়া আর কী থাকে! আজকাল অবশ্য ফেসবুক হোয়াটসআপ ব্লটুথসহ নানান জিনিসাদি থাকে। সেগুলোর সঙ্গে অফিসের কী সম্পর্ক? টেলিফোন নম্বরগুলো কি এতটাই দুষ্প্রাপ্য ছিল যেজন্য ডুবুরি নামাতে হলো? মানুষ পানিতে পড়ে গেলে বা নৌকাডুবি হলে ডুবুরি কতক্ষণে নামে, সবসময় কি নামে?

ক্ষমতার অপব্যবহার করা আজকাল ক্রেডিট হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি গাড়ি, সরকারি বাড়ি, কম্পিউটার, টেলিফোন, ফটোকপিয়ার, ফ্যাক্স, কাগজপত্র সবই যেন নিজের এজমালি সম্পত্তি। ভিআইপি সাহেব নিজে যান প্লেনে। অফিসের গাড়িতে আসীন হন ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনি চৌদ্দগুষ্টি। সে গাড়ি হাঁকিয়ে পেছনে পুলিশ হুইসেল মেরে রাস্তা ক্লিয়ার করতে করতে যায় বান্দরবান বা কক্সবাজার। তাদের সাইট দিতে গিয়ে কতজনকে যে আচমকা গাড়ি ঢালে নামাতে হয়, কত স্কুলগামী বাচ্চার ভ্যান উল্টে যায়, কত বাচ্চা ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে সেই হিসাব কে রাখে! ভিআইপির পরিবার কি ভিআইপি? তাদের পেছনে কেন পুলিশ থাকবে, কেন হুইসেল মারবে? ভিআইপি পরিবার নিয়ে ওঠেন সার্কিট হাউসে। অনেকগুলো রুম চলে যায় তার দখলে। লোকাল অফিস বিনা পয়সায় তাদের চব্য চষ্য লেহ্য পেয় খাওয়ায়, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সাগর, পাহাড়, নীলাচল, নীলগিরি দেখায়। মেয়েদের সালোয়ার কামিজ, ছেলেকে প্যান্ট শার্ট, বউকে দামি শাড়ি, স্যারকে ফুরফুরে পাঞ্জাবি আর অঢেল ফুল উপহার দেয়। ফেরার সময় গাড়ির পেছনটা ভরে দেয় কখনো আম কখনো মিষ্টান্নে। এটাই আজকালের চল। সার্কিট হাউসের সামান্য ভাড়াটাও তারা পকেট হাতড়ে মেটাবেন না। যদি কোনো ভিআইপির লোকাল অফিসের সুযোগ না থাকে, খাওয়ার পয়সা, ঘরের ভাড়া তারা দেন না। অতবড় অফিসার, ভয়ে কর্মচারীরা বেশিরভাগ সময় চায়ও না। কত জায়গায় যে কত কর্মকর্তার এমন টাকা বাকি আছে তার হিসাব পাওয়া যায় সার্কিট হাউসগুলোর পেমেন্টের খাতায়। ভাড়ার খবরটা পাওয়া যায়, খাওয়ার খরচটা অজ্ঞাত থাকে। পরিবার নিয়ে বেড়ানোর দরকার হলেই এরা একটা অফিশিয়াল ট্যুর প্রোগ্রাম করে ফেলে। ট্যুরের টাকাটাও পকেটে ঢোকে, সঙ্গে বিনা পয়সায় খাওয়া-দাওয়া, ঘোরা, উপহার।

এরা অফিসের একাধিক গাড়ি যথেচ্ছ ব্যবহার করছেন। কম্পিউটার ফটোকপিয়ার ব্যস্ত থাকে তাদের বাড়ির প্রয়োজন মেটানোতে। কাগজ কলম কালি অফিসেরই যায় এটা বলাই বাহুল্য। আর যে ভিআইপিরা চিকিৎসার সুযোগ পান তাদের তো পোয়াবারো। যা লাগবে সে চিকিৎসাও করছে, যেটা লাগবে না সেটাও করছে। যে চিকিৎসা দেশে হয় সেটা সিঙ্গাপুর চেন্নাই আমেরিকায় করছে। পুরো পরিবারসহ করছে। আর ভাউচার যেগুলো দিয়ে টাকা তুলছে তার যে পুরোটাই সঠিক সেটা না ভাবাই বুদ্ধিমানের কাজ। যাদের অন্যায্য সরকারি সুযোগ নিতে লজ্জা হয় না তাদের ভুয়া ভাউচার দিতেও লজ্জা হয় না।

ভাবলে অন্যায় হবে, এরা সবাই প্রশাসনের লোক। এই কিছিমের প্রশাসনের বাইরের অন্যান্য সার্ভিসেরও অনেক ভিআইপি আছেন। আর হ্যাঁ, এ দলে সবাই নয়। একটা বড় সংখ্যক অফিসার আছেন যারা ভিআইপিত্বে বিশ্বাস করেন না। নিজেদের প্রজাতন্ত্রের সেবক মনে করেন। যাদের সেধে কিছু খাওয়ানো যায় না, দেওয়া তো দূরের কথা। মনজুর মোরশেদ শাহরিয়ারের মতো কর্মকর্তা আছেন, যিনি বদলির তোয়াক্কা করেন না। ড. আতিউর রহমানের মতো মানুষ আছে। যারা অক্লেশে বিনা দ্বিধায় অতবড় একটি পদ ছেড়ে দিতে পারেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাছ থেকে এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এটা আমরা পাই না বলে, যে দুই-একজনের কাছ থেকে পাই তারা হয় অনুসরণীয়, তারা নমস্য!

আগে এমন ছিল না। দিন দিন অবক্ষয়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যাচ্ছি আমরা। এই অবক্ষয়ের সবচেয়ে বড় কারণ অযোগ্য মানুষ চেয়ারে বসানো। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা কর্মকর্তাদের ক্ষমতার জায়গায় বসানো।

আত্মীয়করণ, দলীয়করণ, আঞ্চলিকতা। জীবনে কোনোদিন একটা মামলা লড়েনি, অমুক মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানে অ্যাসোসিয়েটস ছিল দাও তাকে একটা বড় চেয়ারে বসিয়ে। পদবির সঙ্গে জুড়ে দাও ডেপুটি। কোনোদিন কপালগুণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছাকাছি ছিল, ভালো তোষামোদি আর তেলবাজি করতে জানে, প্রশাসনের লোক নয়, আইন-কানুন জানে না, দাও বসিয়ে বড়সড় কোনো সাংবিধানিক চেয়ারে। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছে বানিয়ে দাও সচিব। অথচ তার সামনে রয়ে গেছে আরও ২০০ জন। এই মানুষগুলোর ওই চেয়ারগুলোতে বসার যোগ্যতা নেই। এই অযোগ্য লোকদের চেয়ারে বসালে ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করবে এটা তো স্বাভাবিক। এরা এত নিকৃষ্ট মানসিকতার যে বসার আসন নিয়ে মামলা করে, গরিব মানুষের চাকরি খায়। যার চাকরি খায় তার হাহাকারের কথা এরা ভাবে না। কারণ এরা ধরেই নিয়েছে এদের এই চেয়ার কোনোদিন নড়বে না। এরা এখানেই থাকবে জীবনে-মরণে। এদের অতীত ঘাঁটলে খুঁজে পাওয়া যাবে কলঙ্কিত অধ্যায়। চারিত্রিক, বৈষয়িক অসততা ছাড়াও এদের মামলাবাজির অনেক প্রমাণ মিলবে। দেখা যাবে কেউ আম গাছ নিয়ে মামলা করেছে, কেউ গাড়ি রাখা নিয়ে। কেউ একাধিক বিয়ে করেছে, কেউ কোনো নারীর জীবন নষ্ট করেছে!

আমরা এমন কেন? পাশের দেশ ভারতের তৃণমূলনেত্রী মমতা ব্যানার্জি টিনের বাড়িতে থাকেন একটা ঘরের মধ্যে। ওই ঘরই তার বেডরুম, ড্রইংরুম, গেস্টরুম। ক্লিনটন ওবামা হিলারি থেকে শুরু করে বিশ্বের বড় বড় নেতা ওই ঘরে এসে তার সঙ্গে দেখা করেন। এতে তার বিন্দুমাত্র সম্মানহানি হয় না। যারা আসেন তাদেরও কোনো অস্বস্তি হয় না। কারণ মানুষটাই বিবেচ্য। তিনি কোথায় থাকেন, কী খান, কী পরেন তা বিবেচ্য নয়। আমাদের দেশে সরকারি পয়সার যে অপচয় হয়, সরকারি সম্পদকে নিজের সম্পদ হিসেবে যেভাবে আত্তীকরণ করা হয় তা বোধহয় পৃথিবীর আর কোথাও নেই।

অথচ এদেশের অর্থনীতির চাকা যারা ঘোরায় সেই শ্রমজীবী মানুষ খেয়ে না খেয়ে কত কষ্টে থাকে। এবার বাজেটে তাদের কষ্ট আরও বেড়েছে। তাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে হাত পড়েছে। শ্রমজীবী মানুষ একটি দুটি করে সঞ্চয়পত্র কেনে। ওটাই তাদের একমাত্র সম্বল। পেনশনভোগীদের এক বড় অংশ সঞ্চয়পত্রের টাকায় বাঁচে। সেই সঞ্চয়পত্রের উৎসে কর ৫ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ১০ ভাগ করা হয়েছে। অথচ তথাকথিত ভিআইপিদের গাড়ির তেলের খরচ, মোবাইল খরচ, চিকিৎসা খরচের কোনো হিসাব নেই। সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় তারা ঘুরে বেড়ায়, বিদেশে চিকিৎসা নেয়, আর সাধারণ মানুষ বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরে।

এই যে ফেরিটা আটকে থাকল এই দায় তো শুধু ওই কর্মকর্তার নয়। এই দায়ের ভাগ তাদেরও যারা ওই কর্মকর্তাকে তুষ্ট করার জন্য ফেরি আটকে রেখেছিল। যে অফিসাররা ভিআইপিদের সার্কিট হাউসের ভাড়া দিয়ে দেয়, খাবার পয়সা দেয়, গাড়ির পেছন ভরে উপঢৌকন দেয় তাদেরও দায় কিছু কম নয়। তাদের কারও আছে প্রমোশনের চিন্তা, কারও পোস্টিং, কারও ইনক্রিমেন্ট। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন তোষামোদি দুর্নীতি আর আত্তীকরণের সংস্কৃতি চালু হয় তখন তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।

মহামান্য হাই কোর্ট রায় দিয়েছে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউ ভিআইপি নয়। খুব খুশির খবর। তবে তথাকথিত ভিআইপিদের ক্রিয়াকলাপ তদারকির জন্য সরকারের তরফ থেকে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা দরকার। হাত পেতে পয়সা নিলেই শুধু দুর্নীতি বা ঘুষ খাওয়া হয় না।

সরকারের গাড়ি নিয়ে পরিবারসহ বান্দরবান বা কক্সবাজারে গেলে সেটাও দুর্নীতি হয়। ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনির নোটস অফিসের কাগজ কালিতে ফটোকপি করলে সেটাও দুর্নীতি হয়। ছোটখাটো ব্যাপার মনে করে আমরা এগুলো এড়িয়ে যাই। কিন্তু যখন অনেকে একই কাজ করতে থাকে তখন একটা বিরাট আর্থিক ইনভলভমেন্ট হয়, সেটা কম নয়। জীবনের এই পর্যায়ে এসে তো এসব তথাকথিত ভিআইপি শুধরাবেন না, তাই সরকারেরই উচিত এদের ওপর নজরদারি করা।

 লেখক : কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর