শিরোনাম
সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

উপকূলীয় জেলেদের কান্না

ফাতিমা পারভীন

উপকূলীয় জেলেদের কান্না

উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী জেলে। জেলেদের ইলিশ শিকারের কারণে ইলিশ মাছ এ দেশের মানুষের খাদ্য-পুষ্টি জোগানোর ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। কর্মসংস্থান, অর্থনীতি, আর্থ-সামাজিক ও সংস্কৃতিতে আমাদের মৎস্যজীবীরা এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন, এ দেশ তথা জাতিকে মাছে-ভাতে বাঙালি গর্বিত পরিচয়ে সংজ্ঞায়িত করে ফেলেছে। বঙ্গোপসাগরের ইলিশের স্বাদ ও রং অন্য এলাকার ইলিশের চেয়ে একেবারে আলাদা। আকৃতি এবং গঠনও ভিন্ন।

বর্ষার প্রারম্ভে প্রজনন মৌসুমে বঙ্গোপসাগরে প্লাবন এলে প্রজননের জন্য নদীর উজানে ডিম ছাড়ার জন্য উপযুক্ত স্থানের খোঁজে যাত্রা শুরু করে ইলিশ। নদীর উপযুক্ত স্থানে ডিম ছাড়া হয়ে গেলে নিষিক্ত ডিম নিঃসৃত পোনা ইলিশগুলো, নদীর দুকূল প্লাবনভূমির স্বল্প গভীরতার জলাভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে। অভয়ারণ্য ভেবে ছুটে বেড়ায়। পূর্ণাঙ্গ ইলিশে পরিণত হলে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশ্যে অভিপ্রায়ন ঘটায়। নিঃসৃত পোনা মাছ (ইলিশ) নদীর দুকূল প্লাবনভূমির স্বল্প গভীরতার জলাভূমিতে ছড়িয়ে যাতে নিরাপদভাবে বেড়ে উঠতে পারে তার জন্য দেওয়া হয় বিভিন্নভাবে অবরোধ। দুঃখের বিষয় হলো, ছোট মাছগুলো বড় হতে কত সময় নেয়- সে উপযুক্ত সময় সম্পর্কে গবেষণা না করেই অবরোধ বাস্তবায়ন হয়। ফলে ভোগান্তি পোহাতে হয় হতভাগ্য ছেলেদের।

দীর্ঘ ৬৫ দিনের অবরোধের পর গভীর সমুদ্রে জেলেরা মাছ ধরতে গেলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে, অভুক্ত জেলেরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেমে গেলে আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্নে ইলিশ শিকারের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দেয় বঙ্গোপসাগরে। জেলেদের জালে আটকা পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে রুপালি ইলিশ। মুখে হাসি ফুটে তাদের। জীবন-জীবিকা যে ইলিশের ওপর নির্ভরশীল সেই ইলিশগুলো যদি ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ে তবে কার না ভালো লাগে! তবে অবাক হওয়ার বিষয় এই যে, ওই ঝাঁকে ঝাঁকে রুপালি ইলিশ চাহিদা অনুযায়ী খুব বেশি বড় নয়।

দেশের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের অন্যতম কেন্দ্র বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা। সেখানে দেখা গেল মৌসুমের ইলিশগুলো প্রয়োজনের তুলনায় এখন অনেক কম, আকারেও অনেক ছোট। ফলে দাম বাড়তি হলেও ওজনে কম হওয়ায় জেলেদের দাদন পরিশোধ করে অর্থনৈতিক চাহিদা মিটাতে পারছে না। বর্তমান ইলিশের সাইজ ৪০০ গ্রাম থেকে ৭০০ গ্রাম পর্যন্ত, অথচ প্রতি বছর অহরহ ১০০০/১৩০০ গ্রামের ইলিশ আহরণ করত জেলেরা। বঙ্গোপসাগরের বিষখালী নদীতীরে ইলিশ দেখে দেখে বড় হয়েছি বলে শৈশবে নিজচোখে দেখা ২০০০/২৫০০ গ্রামের ইলিশ এখন আমার কাছে অনেকটা উপাখ্যান বলে মনে হয়। এখনো চোখ বন্ধ করলে দেখি জেলেদের জালে বন্দী থেকে মুক্ত হয়ে বাঁচতে না পারা অসংখ্য ওই ইলিশকে নদীতে ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে যেতে। তখন মাছের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি অথচ মানুষ টাকার অভাবে মাছ ক্রয় করতে পারেনি। মানুষের অভাব ছিল, সব পরিবার প্রতিদিন মাছ খেতে পারত না। আয়-রোজগার ছিল অনেক কম।

বর্তমান সরকারের সফল রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আজ আর মানুষের সে অভাব নেই। মঙ্গাপীড়িত মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। আগের চেয়ে মাছের সংখ্যা এখন কম, দামটাও অনেক চড়া অথচ এখন নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পরিবারের সবাই কমবেশি প্রতি বেলায় মাছ খেতে পারছে।

৬৫ দিনের অবরোধের সময় আমাদের জেলেরা যখন সরকারের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে অতিকষ্টে দুবেলা পেটপুরে না খেয়ে দিনাতিপাত করেছিলেন ঠিক তখন গত ৭ জুলাই পটুয়াখালীর পায়রাবন্দর সংলগ্ন দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবৈধভাবে বাংলাদেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ ও মাছ শিকারের অভিযোগে ৩২টি ভারতীয় ফিশিং ট্রলারসহ পাঁচ শতাধিক জেলেকে আটক করে কোস্টগার্ড। এসব ট্রলারের কোনোটিতে ২০ জন, ২২ জন, আবার কোনো ট্রলারে ১৮ জন, ১৭ জন করে জেলে ছিল।

আটককৃত ভারতীয় জেলেরা জানিয়েছিল, ঝড়ের কবলে পড়ে তারা পথ ভুলে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করেছে। অপরদিকে এসব ট্রলারে মাছ ছাড়া অন্য কোনো অবৈধ মালামাল রয়েছে কিনা তা খুঁজে দেখা হয়েছিল। কিন্তু রুপালি ইলিশ ছাড়া ওই সময় ভারতীয় জেলেদের কাছে আর কোনো অবৈধ কিছুই পাওয়া যায়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ভারতীয় ট্রলারগুলো সত্যিই পথ ভুলে এসেছে নাকি অবাধে আমাদের মা ইলিশগুলো ধরতে এসেছিল? আর গত বছরের আমাদের সেই বড় আকারের ইলিশগুলো গেল কই? ৬৫ দিনের অবরোধের আগে কখনো কোনো দিন কেন তারা পথ ভুলে আমাদের সমুদ্রসীমায় এসে পৌঁছায়নি?

যেখানে টানা ৬৫ দিন অবরোধ সম্পন্ন করা হলো সেখানে একসঙ্গে ৩২টি ট্রলারে পাঁচ শতাধিক জেলে বন্দী হলো- বিষয়টি কি সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত নয়? তবে প্রবল প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও ভারতীয় জেলেদের আটক করার পদক্ষেপটি কোস্টগার্ড প্রশংসার দাবিদার রাখে, সঙ্গে আতঙ্ক এসে যায় আমাদের কোস্টগার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী অন্য জেলেরা আমাদের মাছগুলো ধরে নিয়ে যায়নি তো?

লেখক : নারী ও শিশু অধিকার কর্মী

[email protected]

 

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর