শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মমতা বাদে সবাই চান তিস্তা চুক্তি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মমতা বাদে সবাই চান তিস্তা চুক্তি

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অক্টোবরের গোড়ায় দিল্লি সফরের কথা ইতিমধ্যে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর ইতিমধ্যে ঢাকা সফর করে উভয় দেশের দীর্ঘদিন আটকে থাকা বহু বিষয় নিয়ে প্রাথমিকভাবে আলোচনা করে এসেছেন। শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে প্রথম অগ্রাধিকার হলো তিস্তার পানি বণ্টন। গত ১৭-১৮ বছর ধরে এ সমস্যাটি জিইয়ে রেখেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এবারে তিস্তার পানি বণ্টন হবে কি? এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস বাদে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছি। সিপিএম সম্পাদক সূর্যকান্ত মিত্রের বক্তব্য খুব স্পষ্ট। আমরা ক্ষমতা থেকে সরে আসার আগেই ২০০৭ বা ২০০৮ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এ ব্যাপারে সম্মতি জানিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রদেশ বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের বক্তব্য- আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এর বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র স্মরণ করিয়ে দেন কেন্দ্রে কংগ্রেস দল ক্ষমতায় থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকা সফরের সময় তিস্তা নিয়ে চুক্তি করতে কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। আর তাতে বাধা দিয়েছিলেন বঙ্গেশ্বরী মমতা ব্যানার্জি। তিনি তো মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হননি। নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরের সময় মমতা তাঁর সঙ্গী হয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন, তার পরও তো কয়েকটা বছর কেটে গেল। এবার বল বিজেপির কোর্টে, আমরা চাই উভয় দেশের স্বার্থে শেখ হাসিনার আগামী মাসের ভারত সফরের সময় এই চুক্তি সম্পন্ন করা বাঞ্ছনীয়। সোমেন বাবু আরেক ধাপ এগিয়ে বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস দল বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়েছিল, ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে উত্তর-পূর্বের ৭টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঢাকা গিয়েছিলেন। সেই সময় বেশ কিছু চুক্তি হয়েছে। যার ফলে ত্রিপুরা রাজ্য ও আসাম লাভবান হয়েছে। তিস্তা নদীর উৎস যে সিকিমে সেই সিকিমের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিং তার সম্মতির কথা লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন। আমরা মনে করি উভয় দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আরও উন্নয়নের তাগিদে তিস্তা চুক্তি হওয়া জরুরি।

বামফ্রন্টের অন্যতম শরিক আরএসপি নেতা মনোজ ভট্টাচার্য বলেন- তিস্তা নিয়ে মমতার তামাশা করার কোনো অধিকার নেই। ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা রণেন মুখার্জি একই অভিমত প্রকাশ করেন। লোকসভায় বিরোধী দলের নেতা বহরমপুরের সংসদ সদস্য অধীর চৌধুরী বলেন, মমতা প্রতিবেশী বাংলাদেশের বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ়তর করতে চান না বলেই নাটক করে যাচ্ছেন। অধীরের কড়া মন্তব্য- বঙ্গেশ্বরী বিদেশনীতি বোঝেন না বা বোঝার মতো তার বিদ্যাবুদ্ধি নেই। ফলে তার একগুঁয়েমির জন্য বিষয়টি এখনো ঝুলে আছে। অধীর আরও জানান, মনমোহন সিং ঢাকা সফরের আগে লোকসভার বিজেপি এবং রাজ্যসভার বিজেপির সদ্যপ্রয়াত সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি ও এল কে আদবানির সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে গেছেন। ঢাকা থেকে ফিরে এসে তিনি ওই তিন নেতাকে তার সফরের বিস্তারিত জানিয়েও ছিলেন। সীমান্ত চুক্তি নিয়ে বিজেপির আপত্তি রাজ্যসভায় খারিজ হয়ে যায়। তখন তৃণ -মূলের রাজ্যসভার সদস্যরাও বিজেপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলেছিলেন।

ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন তিনবার কলকাতায় এসে মমতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন- পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উভয় দেশের মধ্যে সুসম্পর্কের জন্য যে নীতি নেওয়া প্রয়োজন সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই। সিকিম, ভুটান যেসব নদীর উৎস সে ব্যাপারে মমতার কোনো ভৌগোলিক জ্ঞান নেই। সুতরাং তিস্তা চুক্তি যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে এ বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। আমার মনে আছে, ২০১২ সালে আমার জন্মস্থান বাংলাদেশের ঝালকাঠিতে আমি গিয়েছিলাম। সেখানে বিকালের দিকে ২০-২৫ জন তরতাজা আওয়ামী লীগকর্মী খবর পেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে প্রশ্ন করেছিল- আপনারা কেন আমাদের তিস্তার পানি দিচ্ছেন না? আমি তাদের উত্তরে বলেছিলাম, আমি সরকারি বা কোনো রাজনৈতিক দলের লোক নই, তবে আপনাদের উদ্বেগের কারণটা বুঝি। আমি এই উদ্বেগের কথা দিল্লিতে পৌঁছে দেব। তা দিয়েও ছিলাম। এরপর ২০১৫ সালে আমি ঢাকার বনানীতে একটি রিকশায় চেপে যাচ্ছিলাম, আমার পরিচয় জেনে রিকশাচালক  আমাকে বলল, ‘আপনারা আমাগো দ্যাশ স্বাধীন করার জন্য এত সাহায্য করেছেন। আর এখন তিস্তার পানি দিচ্ছেন না।’ আমি তার কথা শুনে চুপ করে ছিলাম। বস্তুত, ভৌগোলিক কারণেই বাংলাদেশের শুধু উত্তরের নয়, দক্ষিণেরও বহু এলাকায় বহু নদ-নদীর পানি শুকিয়ে গিয়েছে। জ্যোতিবসু ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গণিখান চৌধুরীর উদ্যোগে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর ফারাক্কার পানি চুক্তি হয়েছিল, ওই উভয় নেতার মধ্যে মাত্র ১০ মিনিট আলোচনার মধ্যেই। আমি তার সাক্ষী।

তিস্তার পানি বণ্টন কীভাবে হবে এবং শুকনো মৌসুমে কোন দেশ কতটা পানি পাবে সে ব্যাপারে ‘টেকনিক্যাল’ দিকগুলো খতিয়ে দেখার জন্য বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ ড. কল্যাণ রুদ্রের নেতৃত্বে একটি কমিটি নিয়োগ করা হয়েছিল, সেই কমিটির রিপোর্টেও পানি বণ্টনের চুক্তি করা হলে উভয় দেশের স্বার্থের কোনো ক্ষতি হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের নদী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্ষার সময় তিস্তার নাব্য বাড়ানোর জন্য পানি ধরে রেখে শুকনো মৌসুমে সেই পানি বণ্টন সম্ভব। তিস্তাসহ উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় নাব্য বাড়ানোর জন্য নদীর ড্রেজিং করা দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ড্রেজিং করা হলে অনেকটা পানি ধরে রাখা যায়। যেমন করা হয় গঙ্গায়। বড় বড় জাহাজ আসার সময় ড্রেজিং করে নাব্য বাড়ানোর একটা প্রথা চালু আছে। শেখ হাসিনার আগেকার দিল্লি সফরের সময় বিষয়টি নিয়ে মমতার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ আলোচনা হয়। শেখ হাসিনা ঢাকায় ফিরে যাওয়ার পর যেমন দুষ্টের ছলের অভাব হয় না তেমনিই মমতা তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বাঙালি সাংবাদিককে ডেকে বলেছিলেন, তিস্তা নয়, তোর্সা নদীর পানির ভাগ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আর এই তোর্সা নদীর উৎস ভুটানে। তার এই দুষ্টবুদ্ধির নেপথ্যে কোনো পশ্চিমি বিদেশি দেশ কলকাঠি নেড়েছিল। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের নামজাদা সাহিত্যিক মমতার ঘনিষ্ঠ উত্তরবঙ্গের মানুষ সমরেশ মজুমদার বলেছিলেন, তোর্সা তো ভুটানে। তবে ভুটানকে ডেকে এনে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি কেন করতে চাইছেন, এর কোনো জবাব আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তিস্তার পানি না পেয়ে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশি ইলিশ পশ্চিমবঙ্গে রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু কূটনৈতিক সূত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের একজন প্রথম সারির নেতা বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনের মাধ্যমে মমতাকে নিয়মিত ইলিশ পাঠান। বিষয়টি নিয়ে আমি ঢাকায় এক সাবেক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। যাই হোক, ইলিশ মাছ বড় বিষয় নয়, বড় বিষয় হলো তিস্তার পানি।

মমতার ঘনিষ্ঠ তৃণমূলের এক প্রবীণ মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলাম, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে দিল্লিতে আসছেন, আপনারা কী করবেন? তিনি মুখে আঙ্গুল চেপে বলেন, দিদিকে বলুন, আমরা জানি না। যাই হোক, এপার বাংলার সব রাজনৈতিক দলই একবাক্যে বলেছেন তারা চান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন দিল্লি সফরের সময় তিন দশক থেকে পড়ে থাকা তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করে মোদি তার প্রতিশ্রুতি রাখবেন।

শেখ হাসিনাও হাসিমুখে ঢাকা ফিরে গিয়ে বলতে পারবেন, আমার সফর সফল। ১৯৭২ সালে ঢাকায় এবং ’৭৪ সালে দিল্লিতে ইন্দিরা-মুজিব যে চুক্তি হয়েছিল সেই চুক্তির শর্তই ছিল ঢাকা ও ভারতের মধ্যে যে কোনো সমস্যার দ্বিপক্ষীয় সমাধান করতে হবে। এবারও যদি মমতা আপত্তি তোলেন তবে এবারও কি নরেন্দ্র মোদি চুপ করে বসে থাকবেন? নাকি তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন। ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে এটাই এখন বড় প্রশ্ন।

                লেখক : ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক।

 

সর্বশেষ খবর