শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রাণিসম্পদে নতুন সম্ভাবনা গয়াল

শাইখ সিরাজ

প্রাণিসম্পদে নতুন সম্ভাবনা গয়াল

জলবায়ু পরিবর্তন ধীরে ধীরে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আবহাওয়ার কোনো কিছুই আগে থেকে এখন আর অনুমান করা যায় না। অনেকদিন ধরেই চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় যাওয়ার কথা শুটিংয়ের জন্য, গয়াল খামারে। এরশাদ মাহমুদ নামের এক ভদ্রলোক অনেকদিন ধরেই গয়াল পালছেন, ব্রিডিং করছেন- বিষয়টি খুব ইন্টারেস্টিং। গত ২৫ আগস্ট সকালের ফ্লাইটে শুটিং দল নিয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছে সড়কপথে রওনা হলাম রাঙ্গুনিয়ার সুখবিলাস গ্রামে গয়াল খামার দেখতে। সকাল থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। দুপুর গড়াতেই আকাশ কালো করে ঝুমবৃষ্টি নামল। পাহাড়ি সবুজ বনের মাঝে পিচঢালা পথ। রাস্তা থেকে দুর্গম পাহাড়। চারদিকে একেবারে কাছাকাছি কোনো বসতি নেই। এর মাঝেই প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে গবাদি প্রাণীর এক খামার। গরু-ছাগলের পাশাপাশি এখানে প্রতিনিধিত্ব করছে ভিন্ন এক প্রাণী। দূর থেকে বেশ মাংসল ষাঁড় মনে হতে পারে। আবার সামনের দিকটা দেখে মনে হতেও পারে মহিষ প্রজাতির কোনো প্রাণী। আসলে এটি গয়াল। চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনাঞ্চলে এটি দেখা যেত বলে কেউ কেউ বলে থাকেন চিটাগাং বাইসন। একসময় বলা হতো ইন্ডিয়ান বাইসন। ভারতের কোনো কোনো জায়গায় এ গয়ালকে বলা হয় মিথুন। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘বস্ ফ্রন্টেইলস’ (ইড়ং ভৎড়হঃধষরং)।

সন্দেহ নেই, এটি ষাঁড়েরই একটি প্রজাতি। পাহাড়ের ঘন অরণ্যে বিচরণের সময় এর যে হিংস্রতা ছিল তা অনেকটাই দমে এসেছে খামারের নিয়মপ্রণালির মধ্যে এসে। রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া ইউনিয়নের দুর্গম সুখবিলাস গ্রামের এই খামারে ছোটবড় মিলিয়ে এখন বেশ কয়েকটি গয়াল। এর মধ্যেও রয়েছে পৃথক জাতবৈশিষ্ট্য। খামারের উদ্যোক্তা এরশাদ মাহমুদ। কৃষিকে ঘিরেই এই উদ্যোক্তার জীবনযাপন। মেধা ও কঠোর পরিশ্রমে সেই স্বপ্নকে নিয়ে গিয়েছেন বাস্তবায়নের দিকে। এলাকায় ১৯৮৮ সাল থেকে সফল মাছ চাষি হিসেবে খ্যাতি রয়েছে এরশাদের। হালদা ও লক্ষ্মীপুরের রায়পুর থেকে মাছের পোনা এনে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছ চাষ করেন তিনি। শুধু নিজের ব্যবসাতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। মাছের চাষকে আশপাশের কয়েক গ্রামে সম্প্রসারণ করেছেন। তার দেখাদেখি এলাকায় এখন শতাধিক মাছ চাষি। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছ চাষের পাশাপাশি বর্তমানে প্রায়বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণী গয়ালের খামার গড়ে তুলে এলাকার সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এরশাদ। রাঙামাটির গহিন বনের এক উপজাতীয় পরিবার থেকে ২০০৭ সালে মাত্র ৩টি গয়াল কিনে খামার শুরু করে বর্তমানে তার খামারে গয়ালের সংখ্যা ৪৯। কথা হলো তার সঙ্গে। জানালেন আজ থেকে ১২ বছর আগে ২০০৭ সালে এক জোড়া গয়াল ও ১টি বাচ্চা গয়াল দিয়ে শুরু করেন এ খামার। মাদি গয়ালটি এখনো আছে খামারে। এই ১টি গয়াল থেকেই তিনি পেয়েছেন ৮টি বাচ্চা। খামারে এখন রয়েছে ৩ প্রজাতির গয়াল। এই ৩ প্রজাতির মধ্যে বৈশিষ্ট্য ও স্বভাবগত তারতম্য রয়েছে। ১ প্রজাতি দেহের সম্পূর্ণটাই কালো রঙের। আর ১ প্রজাতি রয়েছে কালো-সাদা মিশেল। এরশাদ মাহমুদ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন প্রতিটি গয়ালের বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব। বলা চলে, গয়াল নিয়ে তিনি রীতিমতো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

পাঠক! আপনারা হয়তো শুনে থাকবেন, গয়াল বন্যপ্রাণী। ধারণা করা হয়, চট্টগ্রামের আদিবাসীদের পোষা গরু ও গৌরের কোনো সংমিশ্রণের সংকর হচ্ছে গয়াল। বনে বনে উন্মুক্ত বিচরণই স্বভাব তার। বন্যপ্রাণী গয়ালকে বশে আনতে নানান গবেষণা চালানো হয়েছে অনেক বছর ধরেই। কিন্তু সেই অর্থে তেমন সফলতা আসেনি। সফল হয়েছেন এরশাদ মাহমুদ। এই কয়েক বছরে বিক্রি করেছেন আরও প্রায় ৪০টি গয়াল।

বৃষ্টি থেমে মেঘের আড়াল থেকে সূর্য উঁকি দিল। পাহাড়ের সবুজ গাছের ওপর চিকচিক করে উঠল রোদের ঝিলিক। মুহূর্তে পাল্টে গেল চারপাশের চিত্র। চারদিকে পাহাড়ের মাঝে এরশাদ মাহমুদের খামারটি অন্যরকম এক কৃষিক্ষেত্র। রোদ দেখে খামারের ছাউনি থেকে বের হয়ে এলো গয়াল শাবকগুলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, চেহারা-আকৃতিতে বেশ হিংস্র মনে হলেও গয়াল কিন্তু এখানে মোটেও তার হিংস্রতা দেখাচ্ছে না। বোঝা যায়, ভালোবাসার কাছে সব প্রাণীই লুকিয়ে ফেলে তার হিংস্রতা। যাই হোক, ২০০৭ সালে বন থেকে নেমে এই প্রকৃতিতে মানুষের সঙ্গে মিশেছিল গয়াল। তারও বেশ আগে অবশ্য গয়াল পালনের নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। কিন্তু এর সম্ভাবনা সেভাবে বুঝে উঠতে পারেনি কেউ। এরশাদ মাহমুদ তার কৃষি আর প্রাণিকুলের প্রতি ভালোবাসা থেকে বেশ ভালোভাবেই বুঝেছিলেন এই প্রাণীর সম্ভাবনা। এরশাদ মাহমুদ তার অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, গয়াল নানা বিবেচনায় আমাদের জন্য অনেক বেশি সম্ভাবনাময়। দেশের বিভিন্ন গরুর গড় ওজন ২০০-৪০০ কেজি। কিন্তু প্রতিটি গয়ালের গড় ওজন ৫০০-৮০০ কেজি। ভালোমানের কম চর্বিযুক্ত মাংসের কারণে দেশীয় গরুর চেয়ে দ্বিগুণ ওজনের প্রতিটি গয়াল সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি হয়। বাজারে বিক্রি হওয়া গরু-মহিষের তুলনায় গয়ালের দাম একটু বেশি। একেকটি গয়াল ওজনভেদে ৮০ হাজার থেকে দেড়-দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। গরু-মহিষের চেয়ে বেশি মাংস পাওয়া যাওয়ায় গয়ালের চাহিদা বাড়ছে। গয়াল লালন-পালনে খরচ তুলনামূলক কম। গহিন বনের যেখানে ছোট ছোট ঝোপের কচিপাতা ও ডালপালা আছে তেমন জায়গা গয়ালের বেশ পছন্দ। সাধারণত ১০-১১ মাস গর্ভধারণের পর মাদি গয়াল একটি বাচ্চার জন্ম দেয়। গাভীর মতো এদের ওলান নেই, স্তনবৃন্ত ছোট হওয়ায় এদের থেকে কখনো দুধ দোয়ানো যায় না। তাই গয়াল মূলত মাংসের চাহিদা পূরণ করে। গয়ালের মাংসে কলেস্টেরল কম হওয়ায় এটি মানবদেহের জন্য সবসময় কম ঝুঁকিপূর্ণ।

তৃণভোজী গয়ালের খাবারও মোটা দাগে গরুর মতোই। মজার ব্যাপার, এরশাদ মাহমুদ নিজে খামার গড়লেও গয়ালকে পাহাড়ি বনভূমির বুক থেকে পুরোপুরি ছিনিয়ে আনেননি, বরং খামারের গয়ালকে পাহাড়ে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন; গয়াল যাতে প্রাকৃতিকভাবেই তার রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। তবে তিনি বলছেন, প্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ে চরে বেড়ানো গয়াল এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় না।

গয়াল উচ্চতায় হয় ২-৩ মিটার। গায়ের রং কালো কিংবা সাদা। অপ্রাপ্তবয়স্ক গয়ালের রং সামান্য বাদামি। পূর্ণবয়স্ক ও মাদি গয়ালের রং কালোটির ক্ষেত্রে সামান্য লালচে হয়ে থাকে, আর সাদার ক্ষেত্রে কিছুটা সাদাটে বাদামি বা হলুদাভ হয়। এদের হাঁটুর নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত সাদা লোমে আবৃত। মনে হয় সাদা মোজা পরানো। গয়ালের মাথার ওপরের কিছু অংশ এবং কপালেও রয়েছে সাদা লোম। এদের কপালের দুই পাশে ২টি বিশাল শিং। গরুর কাঁধের উঁচু মাংসপি- কুঁজ গয়ালের ক্ষেত্রে কাঁধ থেকে পিঠের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বুনো গয়াল দলবদ্ধভাবে বাস করে। দলের নেতৃত্বে থাকে ১টি বড় ও শক্তিশালী ষাঁড়। সাধারণত গয়াল বাঁচে ১৫-১৬ বছর। এরশাদ মাহমুদ জানালেন, গয়ালের বর্ধনহার গরুর চেয়ে বেশি। সে হিসাবে বাণিজ্যিকভাবে এটি অনেক বেশি লাভজনক। এ খামারে এরশাদ মাহমুদ ইতিমধ্যে দেশি গরু ও গয়ালের সংকরায়ণ করেছেন। এ গয়াল পরিবারে এরশাদ মাহমুদের বেশ মজার সময় কাটে। গয়ালের রকমসকম মিলিয়ে তিনি নানান নামও দিয়েছেন।

একসময় সব প্রাণীই ছিল বন্য। মানুষই নিজের প্রয়োজনে বশ মানিয়ে গৃহপালিত হিসেবে লালন-পালন করে আসছে নানা প্রাণীকে। গয়ালও সে রকম। সেই ১৯৬৪ সালে গয়াল পায় গৃহপালিত প্রাণীর তকমা। এরপর ১৯৯০ সালে পার্বত্য বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়িতে সরকারি উদ্যোগে গয়াল প্রজনন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। কিন্তু সেখানে কার্যত তেমন কোনো সফলতার কথা শোনা যায় না। এদিকে সম্প্রতি সরকার কর্তৃক গয়াল পালন, প্রজনন ও গবেষণার জন্য ১২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা যায়। বিষয়টি নিয়ে কথা বলি প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. নাথুরাম সরকারের সঙ্গে। তিনি জানান, গয়াল নিয়ে তাদের প্রকল্পটি আগামী মাস দুয়েকের মাঝেই বাস্তবায়ন শুরু হবে। পাহাড়ি আদিবাসী থেকে শুরু করে সমতলেও গয়াল লালন-পালনে দেশের মাংসের চাহিদা যেমন পূরণ সম্ভব হবে, তেমনি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গয়ালের উন্নত জাত তৈরিতেও তারা গবেষণা চালিয়ে যাবেন।

আবার আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। কাজ আর এগোনো গেল না। সোনালি বিকাল পরিণত হলো ঘন সন্ধ্যায়। ফলে আলোকস্বল্পতায় ক্যামেরা গুটিয়ে ফেরার পালা। ফিরতে ফিরতে গাড়িতে বসে কথা হলো এরশাদ মাহমুদের সঙ্গে। তিনি জানলেন, এর বাইরেও দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী পৃথক এক কায়দায় বন্যগয়াল পালন করে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে বেশ তৎপরতা চলছে। দেশে বেশি মাংসের গরুর জাত ব্রাহমা লালন-পালন শুরু হয়েছে। দেশে বেড়েছে প্রাণিসম্পদের মৌসুমি ও স্থায়ী খামার। বাইরে থেকে প্রাণিসম্পদ বৈধ ও অবৈধ পথে আমদানি কমে যাওয়া এবং এই খাতের বাণিজ্যিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্যোক্তারা গড়ে তুলছেন নতুন নতুন খামার। এরই মধ্যে এক যুগ ধরে গয়াল পালন ও এর সম্ভাব্যতা সম্পর্কে শুভবার্তা জানাচ্ছেন এরশাদ মাহমুদের মতো আত্মবিশ্বাসী ও উদ্যোগী খামারি। তিনি বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশে মানসম্পন্ন প্রাণিজ আমিষের জোগানদার হিসেবে গয়াল রাখতে পারবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ ক্ষেত্রে তার বাস্তবমুখী অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে গয়াল নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণাসহ সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে- এই প্রত্যাশা।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর