শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

গণমানুষের নেতা শংকর গোবিন্দ চৌধুরী

সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্ত্তী (সৌরেন)

গণমানুষের নেতা শংকর গোবিন্দ চৌধুরী

গতকাল ১৩ সেপ্টেম্বর ছিল শংকর গোবিন্দ চৌধুরীর ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। মানুষ হিসেবে তিনি মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্বের যে নিদর্শন রেখে গেছেন তা কখনোই ভোলার নয়। তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। নাটোরবাসীর আশা ও ভরসার জায়গা ছিলেন শংকর গোবিন্দ চৌধুরী। প্রায় সবারই ‘শংকর কাকা’। বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট বাবা জ্ঞানদা গোবিন্দ চৌধুরী ছিলেন নাটোরের ভবানীর প্রজাহিতৈষী জমিদার। শিক্ষিত পরিবারে শংকর গোবিন্দ চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ সালের ৪ মার্চ। তিনি নাটোর, বগুড়ায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলকাতায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ার সময়ই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু।

তিনি ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ’৬৬ সালের ছয় দফা, ’৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং ’৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে সব ধরনের আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন সক্রিয়। রাজপথ থেকে সংসদ, সবখানে তাঁর উপস্থিতি ছিল সরব। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, আবার নিজে একজন সাধারণ কর্মীর মতো কাজ করেছেন।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে শাহাদাতবরণের পরবর্তী শাসনামলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কোনো প্রলোভন বা হুমকি তাঁকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ’৮১ সালে দুর্বৃত্তরা তাঁকে চলন্ত ‘সীমান্ত এক্সপ্রেস’ ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছিল হত্যার উদ্দেশ্যে। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন, তবে প্রচ- আঘাত পেয়েছিলেন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে নাটোরে ফেরেন। ’৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য এক বছর কারাবরণ করতে হয়। এ ছাড়া তিনি রাজনৈতিক কারণে অনেকবার কারাবরণ করেন। ’৬৯ থেকে ’৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি একাধিকবার ঐতিহ্যবাহী নাটোর পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হন।

বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষদের একজন তিনি। ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি নাটোর সদর আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ’৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ৭ নম্বর সেক্টরের জোনাল কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। ’৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্যও ছিলেন। ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে নাটোরের গভর্নর নিযুক্ত করেন। উল্লেখ্য, গভর্নর নিয়োগ আদেশের সময় তিনি জার্মানিতে একটি প্রশিক্ষণে ছিলেন; বঙ্গবন্ধুই পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে বার্তা পেয়ে তাঁকে তৎক্ষণাৎ রওনা দিয়ে নির্ধারিত তারিখে ঢাকায় এসে শপথ গ্রহণ করতে হয়। ’৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নাটোর সদর আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মনুষ্যত্ব, নীতি ও আদর্শের পথিক শংকর গোবিন্দ চৌধুরীকে কখনো কোনো ধরনের হুমকি বা প্রলোভন ছুঁতে পারেনি। তিনি আমৃত্যু লড়েছেন গণতন্ত্রের অগ্রসৈনিক হিসেবে এবং মানবসেবাকে জীবনের পরমব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি নাটোর রানী ভবানী মহিলা কলেজের (বর্তমানে সরকারি মহিলা কলেজ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এ ছাড়া নাটোর বনলতা হাইস্কুল, বড়গাছা হাইস্কুল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী উচ্চবিদ্যালয়, দিঘাপতিয়া বালিকা শিশুসদন (এতিমখানা)সহ নাটোরের ডায়াবেটিক হাসপাতাল, আধুনিক বাস টার্মিনাল, নাটোর সুগার মিল তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে। কর্মবহুল রাজনৈতিক জীবনে নাটোরের উন্নয়নকল্পে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে গেছেন। দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীকে ‘উত্তরা গণভবন’ ঘোষণার সময়ই তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ঐতিহ্যবাহী নাটোর হবে উত্তরবঙ্গের রাজধানী। বঙ্গবন্ধু তাঁকে আশ্বস্তও করেছিলেন। সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল নাটোর। কিন্তু ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবরণের পর সবকিছুই থমকে যায়। দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে তিনি কতটা নিষ্ঠাবান তা একটি ঘটনাতেই বোঝা যায়। এরশাদবিরোধী তুমুল গণআন্দোলনের সময় ১৯৯০ সালের ২৯ নভেম্বর রাতে তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা রক্তিমা (শেলী)-এর সঙ্গে আমার বিবাহ অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর কন্যাকে সম্প্রদান করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে বড়ই সংশয় ছিল। তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন কেননা সে সময় সান্ধ্য আইন জারি ছিল, নেতা-কর্মীদের ব্যাপকহারে ধরপাকড় করা হচ্ছিল। আমি কর্মস্থল মাগুরা থেকে চুয়াডাঙ্গা হয়ে রেলপথে সান্তাহার হয়ে অনেক কষ্টে পুরো হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে নওগাঁয় বাড়ি পৌঁছি। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সহায়তায় বরযাত্রীসহ নওগাঁ থেকে নাটোর পৌঁছি এবং রাতে থমথমে অবস্থার মধ্যেই লগ্ন অনুযায়ী আমাদের বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় এবং তিনি একদম সময়মতো উপস্থিত হয়ে কন্যা সম্প্রদানের আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন করেন। তিনি আইনের প্রতি কীরূপ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন দুটি উদাহরণেই তা বোঝা যায়। ’৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক জমির সিলিং নির্ধারণের পরপরই তিনি ১০০ বিঘা জমি নিজে রেখে অনেক জমিজমা তাঁর এলাকার সাধারণ গরিবদের মধ্যে রেজিস্ট্রি করে দেন; যাতে তারা চাষবাস করে খেতে পারে। অবশিষ্ট জমি সরকার বরাবর সারেন্ডার করেন। দ্বিতীয়, ১৯৯০ সালের ২৯ নভেম্বর কনিষ্ঠা কন্যার বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য (নির্ধারিত জনের অতিরিক্ত) সরকারি ফি জমা দিয়ে জেলা প্রশাসকের অনুমতি গ্রহণ করেছিলেন।

১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পোস্টারে ছেয়ে যায় দেয়ালের পর দেয়াল। তার পরও তিনি পোস্টার লাগাবেন না। তাঁর কঠোর হুঁশিয়ারি- ‘ছবি দিয়ে চেনাতে হবে শংকর গোবিন্দ চৌধুরীকে!’ ছবি দিয়ে তাঁকে চেনানোর প্রয়োজন হয়নি। সাধারণত তৎকালীন সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারের সদস্যরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব করতেন না। কিন্তু তিনি কখনো জাতি-ধর্ম-বর্ণকে মনুষ্যত্বের ঊর্ধ্বে স্থান দেননি। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ তিনি এ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। কোনো গোঁড়ামি বা সংকীর্ণতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার কাছে ছিলেন সমান জনপ্রিয়। আজও তিনি নাটোরবাসীর কাছে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। সমাজে আজও তাঁর মতো মানুষ বড়ই প্রয়োজন। দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে নিষ্ঠাবান এবং প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী শংকর গোবিন্দ চৌধুরী ছিলেন একজন সদালাপী ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন ব্যক্তি। আমৃত্যু তিনি নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দেখে যেতে চেয়েছিলেন। বার বার তা বলতেন। তিনি দেখে যেতে পারেননি তবে সেই নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচার হয়েছে; তাঁর আত্মা নিশ্চয়ই শান্তি পেয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন থেকে জটিল রোগে ভুগছিলেন। ’৯৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে পরলোকগমন করেন শংকর গোবিন্দ চৌধুরী। তাঁর মৃত্যুতে মুহূর্তের মধ্যে কর্মচঞ্চল নাটোরসহ এতদাঞ্চল হয়ে পড়ল নিস্তব্ধ। প্রয়াত নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, যানবাহন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রয়াত নেতার মরদেহ ঢাকা থেকে আসবে বলে তাঁকে একনজর দেখার জন্য রাজপথে মানুষের ঢল নামে। নগরবাড়ী থেকে (তখনো বঙ্গবন্ধু ব্রিজ হয়নি) নাটোর আসার পথে নগরবাড়ী, পাবনা, দাশুরিয়া, বনপাড়া, আহমেদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে প্রয়াত নেতাকে একনজর দেখার জন্য জনতা রাস্তায় ভিড় জমায়। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় প্রয়াত নেতাকে। নাটোর শহর প্রদক্ষিণ শেষে শহর থেকে নিজ গ্রাম ভাবনীতে, নিজ পিতৃভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রায় ৩০ হাজার লোকের উপস্থিতিতে পৈতৃক শ্মশানে এই নেতার লৌকিকক্রিয়া সম্পন্ন হয়। দেখেছি সেই রাতে সমগ্র নাটোরের মানুষ রাস্তাঘাটে শুয়ে গড়াগড়ি করে কান্নাকাটি ও বিলাপ করছিল। সেই শোকের দৃশ্য ভোলার নয়।

বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর মধ্যে বিরাজমান ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থার সম্পর্ক। তাঁর মৃত্যুর পর জননেত্রী শেখ হাসিনা নাটোর গিয়ে তাঁর স্ত্রী অনিমা চৌধুরী (আমৃত্যু জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন)সহ শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানান এবং নাটোরের কানাইখালী মাঠে বিশাল স্মরণ সভায় উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালের ১২ জানুয়ারি নাটোরে তাঁর স্মরণে ‘শংকর গোবিন্দ চৌধুরী’ আধুনিক স্টেডিয়াম নির্মাণ শেষে উদ্বোধন করেন। এখানেই শেষ নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৮ সালে তাঁকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর)’ প্রদান করেন। যা তাঁর পে কনিষ্ঠা কন্যা রক্তিমা চক্রবর্ত্তী (শেলী) গ্রহণ করেন। রাজধানী ঢাকাসহ একাধিক বিভাগ ও জেলার সংযোগস্থল নাটোর বাইপাসে তাঁর স্মরণে নির্মিত ‘শংকর গোবিন্দ চৌধুরী চত্বর’-এ অবস্থিত তাঁর ম্যুরালটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিনম্র শ্রদ্ধা জাতির পিতার প্রতি, আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি- নাটোরের এই অবিসংবাদিত নেতাকে যথাযথ মূল্যায়ন করার জন্য।

 

 লেখক : সচিব, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।

 

সর্বশেষ খবর