শিরোনাম
সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রবীণদের প্রতি অবহেলা নয়

তপন কুমার ঘোষ

প্রবীণদের প্রতি অবহেলা নয়

বিশ্বব্যাপী প্রবীণ নারী ও পুরুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা, ২০১৩ অনুযায়ী আমাদের দেশে ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিরা প্রবীণ হিসেবে স্বীকৃত।

প্রবীণরা সমাজে অবহেলার শিকার। অভাবী পরিবারের বৃদ্ধ-বৃদ্ধার অনেকেরই নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। ভাগ্য ভালো হলে ঠাঁই হয় বাড়ির বারান্দায় বা গোয়ালঘরে। অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী। আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়। অসুস্থতায় মেলে না চিকিৎসা। সেই সঙ্গে আছে স্বজনদের দুর্ব্যবহার। বার্ধক্য প্রকৃতিরই নিয়ম। সবার জীবনেই বার্ধক্য আসে। বার্ধক্যে শারীরিক সমতা হ্রাস পায়। পরনির্ভরতা বেড়ে যায়। এই বয়সে উচ্চ রক্তচাপ আর ডায়াবেটিস তো কমন রোগ। একাকিত্বের শূন্যতায় ভোগেন প্রবীণরা। ছেলেমেয়েরা হয়তো ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকরিসূত্রে অন্য শহরে বা দূর দেশে। বৃদ্ধ বাবা-মা একাকী বাড়িতে। প্রবীণরা কথা বলতে চান। কিন্তু শোনার কেউ নেই। সময় কোথায়! নিঃসঙ্গ দম্পতিরা পরস্পরের প্রতি এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন যে, একজনের কিছু হলে অন্যজনের কী হবে- এই দুশ্চিন্তায় কাটে সময়। মুক্তি পাওয়ার আকুলতায় একসঙ্গে আত্মহননের ঘটনাও বিরল নয়। সম্পত্তি বা টাকা-পয়সার লোভে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার খুন হওয়ার ঘটনা প্রায়শই ঘটে।

বয়সীদের মধ্যে যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে তাদের কেউ কেউ পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে ও মুক্তি দিতে বৃদ্ধাশ্রম বা প্রবীণনিবাস বেছে নিয়েছেন। সেখানে দেখভাল করার লোক আছে। সবচেয়ে বড় কথা, সমবয়সীদের সাহচর্য পাওয়া যায়। বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। শরীরচর্চার সুযোগ আছে। মন্দ কী! কিন্তু দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে! ওপার বাংলার প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তীর গাওয়া গান ‘বৃদ্ধাশ্রম’ দুই বাংলায় খুবই জনপ্রিয়। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেওয়া একজন মায়ের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা গোপন দুঃখ-বেদনা বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে ওই গানে। ছেলে মস্ত বড় অফিসার। মস্ত বড় ফ্যাটে থাকে। দেখা যায় না এপার-ওপার। কিন্তু গুণধর পুত্রের ফ্যাটে থাকার জায়গা হয় না গর্ভধারিণী মায়ের। মায়ের ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম। এটা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি মা। একদিন খোকারও ঠিকানা হবে বৃদ্ধাশ্রম। জীবদ্দশায় সেটা দেখে যেতে চান মা। মায়ের কি প্রচ- অভিমান! একসময় একান্নবর্তী পরিবার ছিল। পরিবারে স্নেহ-ভালোবাসা-সহমর্মিতা ছিল। কালক্রমে সমাজ বদলে গেছে। একান্নবর্তী পরিবারে সেই কবে ভাঙন ধরেছে। আজ জীবনটা বড্ড বেশি যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। স্নেহ, মায়া-মমতার বড়ই আকাল। তাই প্রবীণদের মনের অন্দরমহলের খবর আর কে রাখে! প্রবীণদের কল্যাণে বর্তমান সরকার একগুচ্ছ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে বয়স্কভাতা কর্মসূচি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রবীণদের অধিকার সুরায় পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। সম ও সামর্থ্যবান পুত্র বা কন্যা আইনের বিধান অনুযায়ী পিতা-মাতার ভরণপোষণ না করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ অপরাধের জন্য ১ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদ-, অনাদায়ে সর্বোচ্চ তিন মাস কারাদন্ডের বিধান আছে আইনে।

সন্তানকে মানুষ করার জন্য মা-বাবা কত কষ্টই না করেন! অথচ কর্মব্যস্ততার অজুহাতে বৃদ্ধ বাবা-মার খোঁজখবর রাখেন না অনেকে। অসহায় বাবা-মার দায়িত্ব না নিয়ে উল্টো বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এত নিষ্ঠুর হতে পারে ঔরসজাত সন্তান! যাকে কিনা দীর্ঘ ১০ মাস জঠরে ধারণ করেছিলেন জন্মদাত্রী মা। এটাকে নিষ্ঠুরতা বললেও কম বলা হয়। ধিক! জগতের কারও বাবা-মা চিরকাল বেঁচে থাকেন না। বৃদ্ধ বাবা-মার দেখভাল সন্তানরা করবে, এজন্য আইন করার প্রয়োজন হয় কেন? এটা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। বিষয়টা নৈতিকতা ও মূল্যবোধের। এ নৈতিক বোধটা মনের ভিতর থেকে উৎসারিত হতে হবে। ছোটবেলা থেকেই এ ব্যাপারে সচেতন হতে শেখাতে হবে নতুন প্রজন্মকে। তাদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।

সম্প্রতি ‘প্রবীণদের অধিকার’ নিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি গোলটেবিল আলোচনায় ‘প্রবীণ ফাউন্ডেশন’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রবীণদের থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা, চিকিৎসা, সমবয়সীদের সাহচর্য, বিনোদন, উপযুক্ত কর্মসংস্থান এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর জোর দিয়েছেন আলোচকরা।

প্রবীণরা সম্মান ও স্বীকৃতি চান। একসময়ের সংসারের কর্তা বা কর্ত্রী এখন বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন। সেই কর্তৃত্ব আর নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহণেও কোনো ভূমিকা নেই। বাতিল কাগজের মতো গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছেন সংসারে। বয়সীরা তাই একটু অভিমানী হন। ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে যে সম্মান ও বিশেষ সুবিধা তাঁদের প্রাপ্য তা দিতে আমরা যেন হেলাফেলা না করি। রাস্তা পারাপার বা যানবাহনে ওঠানামায় সহায়তা করা, যানবাহনে তাঁদের জন্য আসন ছেড়ে দেওয়া, হাসপাতাল-অফিস-আদালতে প্রবীণদের অগ্রাধিকার দেওয়া, যানবাহনের ভাড়া ও কেনাকাটায় বিশেষ ডিসকাউন্ট দেওয়া- এভাবেই প্রবীণদের প্রতি আমরা সম্মান দেখাতে পারি। গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এজন্য এখনই পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রবীণদের কল্যাণে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি চাই সামাজিক উদ্যোগ। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওল্ড হোম বা প্রবীণনিবাস গড়ে তুলতে হবে। প্রবীণদের জন্য ‘হেল্পলাইন’ নম্বর খোলা দরকার।

প্রবীণদের প্রতি অবহেলা নয়। আজকের নবীন, আগামীর প্রবীণ। আজ যদি আমরা প্রবীণদের অবহেলা করি, তাহলে একদিন আমাদেরও একই রকম অবহেলার শিকার হতে হবে- এই সহজ সত্যটি আমরা যেন ভুলে না যাই।

লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা বাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর