মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আসামের রাষ্ট্রহীন মানুষ কোথায় যাবে

হাসান তারিক চৌধুরী

আসামের রাষ্ট্রহীন মানুষ কোথায় যাবে

এক কলমের খোঁচায় ভারতের আসামের প্রায় ২০ লাখ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে গেল! তাদের কোনো দেশ নেই, নাগরিক অধিকার নেই। কার্যত নেই কোনো নিরাপত্তা অথবা সুবিচার পাওয়ার অধিকার। ভারতের এসব মানুষ আর বাংলাদেশের রোহিঙ্গারা আজ এক মিছিলের সাথী। কিন্তু কেন এমন হলো? কারগিল যুদ্ধে ভারতের অখ-তা রক্ষায় জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে যে ভারতীয় সেনা লড়াই করেছেন, সেরকম সেনাসদস্যও আজ ভারত সরকারের কাছে একজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। তাহলে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, উল্লেখিত ভারতীয় সেনাটি কোন নাগরিক পরিচয়ে সেদিন চাকরি পেয়েছিল? এরকম বহু ঘটনা আছে। যুগের পর যুগ ধরে যারা আসামের অধিবাসী ছিলেন, যাদের শ্রমে-ঘামে আসামের চা এবং রেশম শিল্প গড়ে উঠেছে, তারাই আজ এই বিতর্কিত নাগরিক নিবন্ধন তালিকার কারণে অজানা অথবা পরিচয়হীন মানুষে পরিণত হয়েছেন। চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতজুড়ে এক ভয়ানক অনিশ্চয়তা এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে স্মরণ করছেন, সেই নির্মম ‘নেলী গণহত্যার’ কথা। ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এই আসামেই এরকমই এক নাগরিকত্ব বিতর্কে ছয় ঘণ্টাব্যাপী এক ভয়াবহ হত্যাকান্ডে প্রায় ১০ হাজার নিরীহ মানুষকে খুন করা হয়েছিল। আসামের এই নতুন নাগরিকত্ব নিবন্ধন প্রক্রিয়া কি আবারও আরেকটি ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে? এ প্রশ্ন অনেকেরই। কাশ্মীর সংকট নিয়ে ভারত যখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, তখন তার সঙ্গে আসামের এই নাগরিক নিবন্ধন ইস্যু যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিকে কোন দিকে নিয়ে যাবে? এই রাষ্ট্রহীন মানুষগুলো বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বড় কোনো বিপদ ডেকে আনবে কিনা? এরকম নানা প্রসঙ্গ আজ মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।   

গত কয়েকদিন ধরে ভারতের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল এবং সংবাদপত্রে আসামের নাগরিকপঞ্জি নিয়ে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা চলছে। কিন্তু এই আলোচনার শেষ কোথায়? কেউ বলতে পারছেন না। অথচ, ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার এবং তাদের আসাম রাজ্যের ক্ষমতাসীন নেতারা একের পর এক বিবৃতির মধ্য দিয়ে একথা প্রমাণ করে চলেছেন যে, বাংলাদেশের জন্য আসামের এই রাষ্ট্রহীন নাগরিকেরা বিরাট এক বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। বিশেষ করে, আসাম রাজ্যের অর্থমন্ত্রী, বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়া ১৯.৬ লাখ মানুষের মধ্যে ১৪ থেকে ১৫ লাখ মানুষকে তারা বাংলাদেশে ফেরত নিতে বলবেন। আসামের চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পরদিন অর্থাৎ ১ সেপ্টেম্বর ভারতের গণমাধ্যম নিউজ১৮-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানান বিজেপি নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোটের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সমন্বয়ক শর্মা। বিজেপির এই নেতা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর অন্তত ২০ শতাংশ এবং বাকি আসামের ১০ শতাংশ নাগরিকদের পুনঃযাচাইয়ের অনুমতি দিতে সুপ্রিম কোর্টের কাছে দাবি জানান। তিনি বলেছেন, ‘আমরা কিছু অবৈধ অভিবাসী পেয়েছি এবং আমরা এ অনুসন্ধান চালাতে থাকব। আসামের প্রত্যেকটি আদিবাসী তাদের জায়গা খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলবে। আমরা ১৪ থেকে ১৫ লাখ বিদেশি শনাক্ত করেছি। এটা প্রমাণিত হয়েছে। মমতা ব্যানার্জি যাই বলুক না কেন তা আমরা আমলে নিচ্ছি না। কারণ অবৈধ বিদেশিরা তার ভোটব্যাংক’। এভাবেই আসামের অধিবাসীদের মধ্যে বিভেদ উসকে দিচ্ছেন ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতারা। যার ফলে প্রায় অর্ধশতাব্দী পার হয়ে যাওয়ার পর আসামে এখন আদিবাসী বনাম অভিবাসী বিতর্ক জন্ম দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু, এত বছর পরে কেন এই বিতর্ক? আসাম রাজ্যের অর্থমন্ত্রী, বিজেপি নেতা হিমন্ত শর্মার বক্তব্য থেকে আসল সত্যটি বেরিয়ে এসেছে। তিনি মনে করেন, বাদপড়া নাগরিকরা তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটব্যাংক। সেখানেই তাদের অসুবিধা। যদি এসব নাগরিক বিজেপির ভোটব্যাংক হতো, তাহলে কি মি. শর্মা এ মন্তব্য করতেন? আসলে বিজেপি নামক উগ্র সাম্প্রদায়িক এই দলটি তাদের দীর্ঘ  পর্যবেক্ষণ থেকে নিশ্চিত হয়েছে যে, আসামের সংখ্যালঘু মুসলিম এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ সাধারণত বিজেপির রাজনীতি সমর্থন করে না। উপরন্তু, নানাভাবে বিরোধিতা করে থাকে। তাই এ নিরীহ এবং অধিকাংশ গরিব অধিবাসীকে তারা টার্গেট করেছেন। যার ফলে, বিজেপি সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন পাঁচ বছর সময় ধরে ভারত সরকারের তহবিল থেকে এক হাজার দুইশ বিশ কোটি রুপি খরচ করে এই সংশোধিত নাগরিক তালিকা বানানো হয়েছে।

আসামের এই সংশোধিত নাগরিক তালিকা বাস্তবায়ন করতে পারলে বিজেপির লাভ বহুবিধ। প্রথমত. এর মধ্য দিয়ে তারা আসামে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল শক্তিকে দুর্বল ও কোণঠাসা করে দিতে পারবে। দ্বিতীয়ত. একই ফর্মুলা ব্যবহার করে বিজেপির সরকার ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও তাদের সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারবে এবং ভারতের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিক অধিকার ও রাজনীতিকে কার্যত ধ্বংস করে দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করতে পারবে। আসামের নাগরিকপঞ্জির এসব বিতর্ক মোকাবিলা করতে গিয়ে কোনো কোনো বিজেপি নেতা বলেছেন, বাদপড়া নাগরিকরা একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, যা বিদেশি ট্রাইব্যুনাল নামে পরিচিত। সেই ট্রাইব্যুনালের কাছে নাগরিকত্ব পুনর্বহাল চেয়ে নাকি আপিল করতে পারবেন। আপিল প্রত্যাখাত হলে এসব নাগরিকের ভাগ্যে অনিশ্চয়তা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

তাই এখন আমি আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন করতে চাই, তাহলে ভারতের আসাম অঞ্চলের এই বাদপড়া নাগরিকদের ‘আইনগত মর্যাদা বা অবস্থান’ কি হবে? আপিল প্রত্যাখ্যাত হলে কিংবা এসব গরিব মানুষ যদি সময়মতো আপিল না করতে পারে, তাহলে তাদের আইনের আশ্রয় কে দেবে? তাদের অধিকার নিয়ে আইনি লড়াই কোথায় হবে? এসব প্রশ্নের কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর ভারতের বিজেপি সরকার দিতে পারেনি। কারণ, তাদের মনোযোগ আসাম রাজ্যের ক্ষমতার মসনদের দিকে। অধিকার-বঞ্চিত জনগণের দিকে কিংবা মানবতার দিকে নয়। আমি আরও প্রশ্ন করতে চাই যে বিদেশি ট্রাইব্যুনালে বাদপড়া নাগরিকরা আপিল দায়ের করবেন। তা সেভাবে কোনো বিচারিক আদালত নয়। বরং বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে অনেকটা নির্বাহী সংস্থার মতো। ফলে এ ধরনের ট্রাইব্যুনাল কতটা সরকারি দলের প্রভাবমুক্ত হয়ে এ প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে? যদি কোনো নাগরিকের আপিল আবেদন সেই ট্রাইব্যুনাল খারিজ করে দেয়, তাহলে কি এসব গরিব আবেদনকারী আসাম থেকে দিল্লিতে উচ্চ আদালতে যাওয়ার বাধাহীন সুযোগ পাবেন? আবেদনকারীকে কি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সাব্যস্ত করে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হবে?

এসব আইনগত প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত এবং আন্তর্জাতিক আইনসম্মত জবাব ভারত সরকারকে দিতে হবে। কারণ, এভাবে কোনো রাষ্ট্রের অধিবাসীকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যা জাতিসংঘের কোনো সদস্য রাষ্ট্র করতে পারে না। যে আসামকে নিয়ে আজ বিজেপি সরকারের এত মাথাব্যথা। যদি প্রশ্ন করা হয় আসামের উন্নয়নে তারা এ পর্যন্ত কি অবদান রেখেছে? ভারতের এই উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য এখনো চরম অবহেলিত। বেকারত্ব এই রাজ্যের এক বিরাট সমস্যা। যুগ যুগ ধরে আসামের শিল্পের বিকাশ আটকে রাখা হয়েছে। কৃষিরও তেমন আধুনিকায়ন হয়নি। অথচ, এই আসাম রাজ্য প্রতিবছর ভারতের মোট তেল সম্পদের ২৫ শতাংশ জোগান দিয়ে যাচ্ছে। ভারতের জাতীয় অর্থনীতিতে আসামের চা, রেশম, কুটির শিল্প এবং পর্যটন খাত উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এই অর্থনৈতিক অবদানের মূল চালিকাশক্তি আসামের দরিদ্র মানুষেরা। যাদের একটা বড় অংশ আজ এই নাগরিক তালিকা নামক আমলাতন্ত্র ও রাজনীতির শিকার। তাই ভারতের দেশপ্রেমিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল শক্তি এখন এই নাগরিকপঞ্জি নিয়ে বিক্ষুব্ধ। তারা তাদের সরকারের কাছে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। কারণ, ভারতের এই গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তি ভালো করেই বুঝতে পারছে, এই নাগরিক তালিকা ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক কর্মসূচিরই অংশবিশেষ। এর মধ্য দিয়ে বিগত শতকে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত মতাদর্শ ‘উগ্র জাতীয়তাবাদ’ কিংবা ‘ফ্যাসিবাদকে’ বিজেপি নতুন মোড়কে ভারতের রাজনীতিতে পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আবারও যদি সেই চেষ্টা করা হয় তাহলে নিশ্চিতভাবেই ভারতসহ এ অঞ্চলে জাতিগত সহিংসতা ভয়ানক আকারে ছড়িয়ে পড়বে, অস্ত্র প্রতিযোগিতা চরমভাবে বাড়বে এবং রাজনীতির সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছুবে। একই সঙ্গে কৃষক, শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হবে। বিজেপি সরকারের এই নীতি ভারতের জাতিগত ও সম্প্রদায়গত বৈচিত্র্য এবং ভারতের অখ-তাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এর ফলে লাভবান হবে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা, উগ্রবাদ এবং কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে যারা নীরব বসে আছেন কিংবা বিষয়টিকে নিছক ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে অভিহিত করে দায়িত্ব এড়াতে চাইছেন। তারা বিরাট ভুল করছেন। বাংলাদেশের সরকারকে মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গাদের মতো নাগরিক তালিকা থেকে বাদপড়া আসামের এই ১৯ লাখেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট হুমকি। এই ‘জনসংখ্যা বোমা’ বাংলাদেশের মাটির দিকে ধেয়ে আসতে পারে। যদি এটি বিস্ফোরিত হয়, তাহলে ক্ষতির কোনো অন্ত থাকবে না। তাই সময় থাকতেই সরকারি, বেসরকারি এবং নানা ধরনের কূটনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন। দক্ষিণ ও পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে বরাক ও ব্রহ্মপুত্র নদীর কোলে বেড়ে ওঠা যে আসামের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বাংলাদেশের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। সে আসামকেই আজ বাংলাদেশের সামনে এক বিপদ হিসেবে হাজির করেছে ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। উপমহাদেশের বরেণ্য সংগীত শিল্পী, আসামের অধিবাসী ভুপেন হাজারিকার ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানটি যে মানুষের কথা বলেছে, আজকের পরিস্থিতিতে সে মানুষের আজ বেশি প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

                লেখক : রাজনীতিবিদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। 

সর্বশেষ খবর