শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাড়ির উঠানে মাছের ফ্যাক্টরি

শাইখ সিরাজ

বাড়ির উঠানে মাছের ফ্যাক্টরি

প্রিয় পাঠক! হাকিম আলীর কথা মনে আছে? হাকিম আলীর কথা আমি প্রায়ই বলি। কারণ আমাদের দেশে মাছ উৎপাদনের যে সাফল্য তাতে হাকিম আলীর ভূমিকা রয়েছে। সেই আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত তথ্যচিত্র ‘হাকিম আলীর মৎস্য খামার’ সে সময়কার বেকার তরুণদের মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এখনো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কোনো কোনো মাছচাষি বলে যে হাকিম আলীই ছিল তাদের মাছ চাষের অনুপ্রেরণা, আশি-নব্বইয়ের দশকে যারা ছিল টগবগে তরুণ। তারা বলে, কড়াই ডোবা তেলে ভাজা মাছের মাথা যেন সমৃদ্ধির হাতছানি দিয়ে তাদের ডেকেছিল। তাতে সাড়া দিয়েই পুকুরের পর পুকুর ভরে তুলেছে রুপালি মাছে। জীবনে মিলেছে সচ্ছলতা, সাফল্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুতেই লেগেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া। আধুনিক হাকিম আলীরা এখন আর পুকুরে নয়, বাড়ির উঠানেই গড়ে তুলছেন মাছ উৎপাদনের কারখানা। আরএএস (রিসার্কুলেটিং অ্যাকুয়া কালচার) বা বায়োফক প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছ চাষের বিভিন্ন প্রতিবেদন চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেছি। চ্যানেল আইয়ের কার্যালয়ে অসংখ্য ফোন, চিঠি এসেছে বায়োফক বা আরএএস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে। আমার সহকর্মীরা তাদের যথাসাধ্য পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করার চেষ্ট করেছেন। বিশেষ করে তুলনামূলক কম বিনিয়োগে বেশি উৎপাদন সম্ভব বলে তরুণরা বায়োফকের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। কুমিল্লার সাজ্জাদ, রাজশাহীর ইমদাদুল, গাজীপুরের শহীদ ইতিমধ্যে বায়োফক পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেছেন।

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে দুই তরুণের বায়োফক পদ্ধতিতে মাছ চাষ দেখতে গিয়েছিলাম। জহিরুল হক ও মুস্তাফিজুর রহমান। সম্পর্কে তারা শালা-দুলাভাই। দুজনে মিলে শুরু করেছেন স্বপ্নের কারখানা। আড়াইহাজারের এ অঞ্চলটা গ্রাম আর শহরের মিশ্রণ যেন। আমাদের আর্থিক উন্নয়নের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছে গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আঙিনায়, বাইরে থেকে দেখলেই পরিবর্তন বোঝা যায়, সচ্ছলতার একটা স্নিগ্ধ প্রভা যেন বাড়িগুলোয় প্রলেপ দিয়েছে। যাই হোক, সকালের রোদ সবে উঁকি দিয়েছে। আমরা গিয়ে পৌঁছাই জহিরুল হকের বাড়ির আঙিনায়। বাড়ির উঠানে রীতিমতো শিল্পকারখানার আবহ। বিশাল চৌবাচ্চায় পানির বুদবুদ উঠছে। যেন টগবগ করে পানি ফুটছে। আসলে এভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে পানিতে। টানা ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় এই চৌবাচ্চাগুলো। পর্যাপ্ত অক্সিজেন আর বিশেষ খাদ্য পেয়ে এর ভিতরেই বেড়ে উঠছে অসংখ্য মাছ। চৌবাচ্চার মধ্যে মাছ গিজগিজ করছে। এই বাড়ির উঠানের পুরোটাই দখল করেছে চৌবাচ্চার সারি। জহিরুল হক ও মুস্তাফিজুর রহমান শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনের মাঝামাঝিতে এসে যুক্ত হয়েছেন উৎপাদন খাতের সঙ্গে।

কথা হয় দুই তরুণের সঙ্গে। জহিরুল হক এমবিএ করেছেন। আর মুস্তাফিজুর রহমান উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন পদার্থবিদ্যায়। কর্মরত ছিলেন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। কিন্তু মাছ চাষের নতুন প্রযুক্তি আর সম্ভাবনা তাদের চোখে বুনে দেয় অন্যরকম স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে ধরতেই চাকরি ছেড়ে মাঠে নেমেছেন তারা, বলা যায় উঠানে নেমেছেন। উঠান ভরে তুলেছেন মাছভর্তি চৌবাচ্চায়। তারা হিসাব করে দেখেছেন এর চেয়ে লাভজনক আর কিছু নেই। বায়োফক পদ্ধতির মাছ চাষ দিয়ে কৃষক বা খামারি হিসেবে তাদের যাত্রা। আর এই পথে আসতে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান আর তথ্য মাথায় নিতে হয়েছে। কাজ করতে এসে দিনে দিনে যথেষ্টই অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন করেছেন তারা। বায়োফক পদ্ধতির মাছ চাষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ‘ফক’ যেটি এক ধরনের জৈবকণা। এ চাষ পদ্ধতিতে অত্যন্ত কার্যকরভাবে মাছের খাদ্য হিসেবে জৈব উপাদান উৎপাদন হতে থাকে। সেটি উৎপাদন হয় মাছের বিষ্ঠা থেকে। এসব বিষয়ে এখন বিস্তর জানাশোনা জহিরুল হকের। পানির রংই বলে দিচ্ছে, এখানে মাছের জৈব খাদ্যের হার কেমন। তার পরও প্যারামিটারে জৈবকণা ও খাদ্যের পরিমাণ মেপে নিয়ে প্রয়োজনে দানাদার খাদ্য প্রয়োগ করেন তারা।

কেন বায়োফক পদ্ধতির মাছ চাষ এত বেশি আকর্ষণীয়? প্রধান কারণ দুটি। এক. অধিক ঘনত্বে মাছ উৎপাদন, দুই. স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে মাছের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া। বেশি বর্ধনশীল মাছ চাষের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিতে পাওয়া যায় সবচেয়ে ভালো ফল। জেনে অবাক হবেন, এই একেকটি সাড়ে ১৭ হাজার লিটার পানির ট্যাংকে কী পরিমাণ মাছ রয়েছে। বলতে পারেন, এগুলো মাছ উৎপাদনের হিসাবে একেকটি বড় পুকুরের সমান। মুস্তাফিজুর রহমান হিসাব কষে বুঝিয়ে দেন সম্ভাব্য লাভের। পুকুর থেকে এই চৌবাচ্চা কেন লাভজনক তাও ভেঙে বলেন। এখানকার একেকটি ট্যাংকে যে পরিমাণ পানি আছে, তা পুকুর হলে আধা শতাংশ জমির পুকুর হতো। এ আয়তনের পুকুরে মাছের পোনা ছাড়া যেত ১০০টি। আর সম আয়তনের এই ট্যাংকের একেকটিতে চাষ হচ্ছে প্রায় ৩০০০ পোনার। ৩০ গুণ বেশি চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। ৮টি ট্যাংক বসাতে অ্যারেটর, ব্লোয়ার ইত্যাদিসহ তাদের মোট খরচ হয়েছে সাড়ে ৪ লাখ টাকা। সে হিসেবে প্রতি ট্যাংকে খরচ ৪৫ হাজার টাকা। প্রতিটি ট্যাংক টিকবে কমপক্ষে পাঁচ বছর। বছরে চারবার মাছ তুলতে পারবে সে হিসেবে প্রতি ট্যাংক থেকে পাঁচ বছরে ২০ বার মাছ তুলবে। প্রতিবার ১টি ট্যাংক থেকে মিলবে ৯০ হাজার টাকার মাছ। হিসাবের এই অঙ্কে তেমন হেরফের হবে না, সাফল্য ধরা দেবেই- এই আত্মপ্রত্যয় ধরা পড়ছে তাদের চোখে-মুখে।

বায়োফক পদ্ধতির অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এখানে মাছের জন্য যে খাবার দেওয়া হয় তা খুব বেশি প্রোটিন-সমৃদ্ধ না হলেও চলে। কারণ, এখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যে খাবারটি তৈরি হয়, তাতে প্রোটিনের মান অনেক বেশি থাকে। একই সঙ্গে খাদ্যের অপচয়ও হয় না। পানিতে সার্বক্ষণিক সঞ্চালন ব্যবস্থা চালু থাকায় অক্সিজেনের পরিমাণও থাকে যথেষ্ট অনুকূল। তরুণ উদ্যোক্তা জহিরুল ও মুস্তাফিজ জানা-বোঝার সঙ্গে এই প্রকল্পে যোগ করে চলেছেন নিজেদের কৌতূহল। তাই তারা দু-একটি হাউসে মিশ্র মাছের চাষ শুরু করেছেন। এ পর্যন্ত ফল ভালো। চৌবাচ্চা থেকে মাছ তুলে দেখলাম। মাছের আকার, রং ও অন্য গুণাবলি দেখে বেশ ভালো মনে হচ্ছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের কারণেই এখানে উৎপাদিত মাছের মান বেশি উন্নত।

আশির দশকে বিটিভির ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একজন আদর্শ মাছ চাষির প্রতীক হিসেবে সামনে এনেছিলাম হাকিম আলীকে। দেশের বেকার তরুণরা হাকিম আলী হওয়ার জন্য দারুণ উজ্জীবিত হয়েছিলেন। সত্যিকার অর্থে তখন থেকে সারা দেশে জন্ম নেওয়া হাজার হাজার হাকিম আলীই দেশে মাছ উৎপাদনে বিশাল সাফল্যের পেছনে রেখে চলেছেন অসামান্য ভূমিকা। দেশে প্রাণিজ আমিষ ও কৃষি অর্থনীতিতে মাছ উৎপাদন খাত বয়ে এনেছে বিশাল সাফল্য। ঠিক এরই ধারাবাহিকতা আজকের জহিরুল ও মুস্তাফিজের মতো তরুণ। তারা জেনে-বুঝে চুলচেরা হিসাব করে মাছ চাষে নেমেছেন এবং চোখে দেখছেন বিশাল সম্ভাবনা। আর এরাই হচ্ছেন এই প্রজন্মের ডিজিটাল হাকিম আলী।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর