রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ছাদবাগান ও ডেঙ্গু আতঙ্ক

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

ছাদবাগান ও ডেঙ্গু আতঙ্ক

কিছুদিন আগে সংবাদপত্রের একটি লেখা দেখে বেশ অবাক হয়েছি। একজন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর বাড়ির ছাদবাগান ধ্বংস করা হয়েছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের নামে। কারণ ছাদবাগানে ফুলের টব, ড্রাম বা অন্য পাত্রের জমা পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। এর থেকে মশার বংশবিস্তার ঘটে, আর ওই মশাগুলোর কামড়ে মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়। তাই হয়তো বাড়ির কর্তাব্যক্তিরা আতঙ্কিত হয়ে ছাদবাগানটি ধ্বংস করা যথোপযুক্ত মনে করেছেন। বিষয়টি অনেকটা ‘মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার মতোই’ হয়েছে বলে মনে হয়।

নগর জীবনে ছাদবাগান কিংবা বারান্দা, সিঁড়ি, বসার ঘর এমনকি বেডরুমের কোণে, জানালার কার্নিসে ছোট ছোট টবে বা নান্দনিক পাত্রে একচিলতে বাগান শুধু প্রকৃতি-প্রেম কিংবা রুচিশীলতার পরিচয়ই বহন করে না, বরং তা স্বাস্থ্যসম্মত ও নির্মল জীবনযাপনে সহায়ক হয়। সবুজে ভরা গ্রাম বাংলায় বেড়ে ওঠা নাগরিক সমাজের একটা অংশ সবুজকে ধরে রাখতে চায় তার আবাসস্থলে। তাই কৃত্রিমতার এ যুগে ছাদের বাগানে শখের বসে বা বিনোদন হিসেবে বিভিন্ন ফুলের পাশাপাশি অনেকে চাষাবাদ করছেন বিভিন্ন ধরনের ফলমূল, শাক-সবজি ও ঔষধি গাছ, যেমন তুলসী, অ্যালোভেরা, বাসকপাতা ইত্যাদি। এগুলো কিন্তু বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে। সময়ের সঙ্গে ছাদবাগানগুলো এখন আর শুধু শৌখিনতায় সীমাবদ্ধ নেই। ভেজাল ও ফরমালিনমুক্ত ফল ও শাক-সবজির জোগান দিয়ে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণ, বিনোদন এবং অবসর কাটানোর এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে ছাদবাগানগুলো। এর মাঝে অনেকেই আবার আয় -উপার্জনের একটা পথ খুঁজে পেয়েছেন। শৌখিন মানুষরা তাদের ঘরবাড়িতে সবুজকে ধরে রাখার জন্য একান্ত নিজস্ব ভাবনা আর প্রচেষ্টায় বাড়ির ছাদে তৈরি করছেন ছাদবাগান। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ছাদবাগান বা ইনডোর গার্ডেনের প্রচলন রয়েছে। ছাদে বাগান কোনো নতুন ধারণা নয়। অতিপ্রাচীন সভ্যতায়ও ছাদবাগানের ইতিহাস চোখে পড়ে। খ্রিস্টের জন্মেরও আগে মেসোপটেমিয়া ও পারস্যের জুকুরাক নামীয় পিরামিড আকৃতির উঁচু পাথরের স্থাপনায় বাগান ও ছোট গাছ লাগানোর জন্য স্থান নির্ধারণ করার নিদর্শন পাওয়া যায়। এমনকি ধারণা করা হয়, ব্যাবিলনের ‘ঝুলন্ত উদ্যান’ও বিভিন্ন ছাদ ও বারান্দার সমন্বয়ে তৈরি।

এ তো গেল অতীতের কথা, বর্তমানেও মানুষ পরিবেশবান্ধব বাড়ি বানানোর দিকে ঝুঁকছে। শহরাঞ্চলে ফুল, ফল ও সবজির পারিবারিক বাগান এখন আর কেবলই শৌখিনতা বা পারিবারিক প্রয়োজন নয়। পরিবেশ রক্ষা আর নগরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে অনেক দেশেই বাড়ির ছাদ, বারান্দা, গাড়িবারান্দা, ফুটপাথ, পার্ক, সরকারি খাসভূমিসহ প্রতিটি পর্যায়ে কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে উদ্যান ফসল ও বাহারি ফুলের গাছের সমন্বয়ে তৈরি করা হচ্ছে সবুজ নগরায়ণ। এমনকি সরকারিভাবেও বিভিন্ন দেশে শুধু বাসাবাড়ি নয়, অফিস-আদালত, রাস্তাঘাট, এয়ারপোর্ট, বাসস্ট্যান্ড সর্বত্র সৌন্দর্যবর্ধনেও সবুজের সমারোহের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। যেখানে যেভাবে সুযোগ আছে সেখানেই একটু সবুজের ছোঁয়া আনার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। তবে সম্প্রতি ডেঙ্গুর মতো মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের দেশে ছাদে চাষবাস ও বাগান নিয়ে অনেকের অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে এবং অনেকে আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছেন বৈকি! কিন্তু সত্যি বলতে আমাদের এই যান্ত্রিক জীবনে বিশেষ করে ঢাকাসহ অন্য শহরে ছাদবাগান সময়ের তাগিদে একটি অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে। কারণ শহুরে জীবনে বিশেষ করে ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে চারদিকে সবুজের যে অভাব, তা অনেকাংশে দূর করতে পারে ছাদবাগান, ফিরিয়ে দিতে পারে বুকভরা নিঃশ্বাস আর পরিবেশের অক্সিজেনের পরিমিত মাত্রা। শুধু ডেঙ্গুজ্বরের বাহক এডিস মশার বংশবৃদ্ধির ভয়ে ছাদবাগান ধ্বংসের কোনো যুক্তি নেই। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, শহরের অধিকাংশ ছাদে যেখানে বাগান নেই, সেখানেও বৃষ্টির পানি বা ট্যাংকের নিঃসরিত পানি জমে থাকে দিনের পর দিন। সেটি পরিষ্কার করার বিষয়ে বার বার সতর্ক করার পরও অধিকাংশ মানুষ কর্ণপাত করেন বলে মনে হয় না। এ জমা পানিও কিন্তু এডিস মশার উপযুক্ত প্রজননক্ষেত্র। সুতরাং ছাদে বাগান থাকুক বা না থাকুক সেটি মুখ্য নয়, আসল বিষয় হচ্ছে ছাদসহ বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার মানসিকতা ও সদিচ্ছা। অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, যেন এসব জায়গায় কোনো পাত্র পরিত্যক্ত অবস্থায় না থাকে এবং সেখানে পরিষ্কার পানি না জমে, যা ডেঙ্গুর প্রজননক্ষেত্রে পরিণত হয়।

ছাদবাগান একদিকে যেমন আমাদের সময়ের দাবি এবং অপরিহার্য অংশ হিসেবে চিন্তা করা যায় তেমনি আবার বাগান করতে গিয়ে যেন মশার প্রজননক্ষেত্র বিশেষ করে ডেঙ্গুর প্রজননক্ষেত্র প্রস্তুত না হয় সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। তাহলে ছাদবাগানও থাকবে, মশারও বংশবিস্তার বাড়বে না- দুই কুলই রক্ষা পাবে।

► সবসময় খেয়াল রাখতে হবে ছাদবাগানের গাছগুলোর টবে, পাত্রের নিচে যেন অতিরিক্ত পানি তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি জমে না থাকে। কারণ এ জমা পানিই ডেঙ্গুর প্রজননের মূল উৎস। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়, এ সময়টাতেও ছাদবাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা অতিজরুরি।

► যেহেতু গাছগুলোতে প্রতিদিন পানি দেওয়া হয়, তাই নিয়মিত পাত্রের নিচের ছিদ্র অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পরীক্ষা করতে হবে, যেন ব্যবহৃত অতিরিক্ত পানি সহজে নিষ্কাশিত হয়।

► শুধু টবে বা গাছ লাগানোর পাত্রে নয়, অনেক সময় অতিরিক্ত পানি দেওয়ার ফলে বা বৃষ্টি থেকেও পানি ছাদে জমে থাকতে পারে এবং তা থেকেও  এডিস মশা বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই সবসময় আপনার ছাদে তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি পানি জমতে দেবেন না।

► অনেকে ছাদবাগানে গাছ লাগানোর জন্য টায়ার বা ড্রাম ব্যবহার করেন। আবার বাগানের অব্যবহৃত ভাঙা টবের বা ছোটখাটো পাত্র কিংবা টায়ারের খোলে খুব সহজেই পানি জমে থাকে, যা অনেক সময় টের পাওয়া যায় না। এগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে এবং অব্যবহৃতগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে।

► নিজেরাই নিজেদের উদ্যোগে মাঝে মাঝে প্রয়োজনীয় কীটনাশক, ওষুধ বা অ্যারোসল স্প্রে করা যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে এগুলো গাছ, ফুল বা ফলের ক্ষতি না করে। আমাদের দেশেও হাঁটি হাঁটি পা পা করে ছাদবাগানের মাধ্যমে ব্যক্তিপর্যায়ে শহরে সবুজায়ন শুরু হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নয় বরং একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগেই এ দেশে ছাদবাগানের সূচনা। নানা প্রকার সবুজের সমারোহ দেখে আমরা প্রফুল্ল হয়ে উঠি। অসংখ্য শেডের সবুজ রং আমাদের একঘেয়েমিতে আক্রান্ত করে না, করে উৎফুল্ল। পরিবেশবিদরা বলছেন, এভাবে গাছ লাগানো গেলে শহরের তাপমাত্রা বহুলাংশে কমানো সম্ভব। শুধু সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয়, শহরের পরিবেশ ও তাপমাত্রা যেভাবে সহনীয়তার মাত্রা হারাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে ছাদে গাছ লাগানো গেলে তা পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখতে কাজ করবে। এসব বাগান পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি শিশুদের মানসিক বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আসলে শহুরে জীবনে সবুজের অপরিহার্যতা, নান্দনিকতা যেমন দরকার তেমনি ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে জনগণের আতঙ্ক দূর করাও প্রয়োজন। কারণ একজন সাধারণ মানুষের কাছে ডেঙ্গুর আতঙ্ক যে কত ভয়াবহ হতে পারে, তা এবারে অনেকেই উপলব্ধি করেছেন।

সুতরাং ছাদবাগান নিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও সচেতন করতে হবে। মশক নিধনের ব্যবস্থা যথাযথভাবে করলে ছাদবাগান মশার ঘাঁটি নয়, বরং হয়ে উঠবে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের ভান্ডার এবং পরিবেশ সুন্দরের সহায়ক। এ কথা যদি মানুষকে সঠিকভাবে বোঝানো যায়, তবে ধ্বংস নয় বরং নিজেদের উদ্যোগে সবাই ছাদবাগান করতে উৎসাহিত হবেন।

লেখক : ইউজিসি অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর