সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

রাজনীতির দুষ্ট আবর্ত ও ক্যাসিনো

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

রাজনীতির দুষ্ট আবর্ত ও ক্যাসিনো

গল্পটি প্রাচীন ভারতের গোড়া হিন্দুদের একটি অংশ তখন পিয়াজ খাওয়াকে পাপ মনে করত। গল্পটি পরে একটি জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্রে নতুন করে উঠে এলে ব্যাপক আলোচনায় আসে। গল্পের নায়িকা ছিল অনাথ, দাদির কাছে বড় হয়েছে। নায়কেরও এক বন্ধু ছাড়া কেউ নেই। তাই বাধ্য হয়েই ছন্নছাড়া নায়কের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে নায়িকার দাদির কাছে যেতে হলো বন্ধুটিকে। দাদির মন গলানোর মতো অনেক কথা বলা শেষ। দাদির সন্দেহ হলো। এত ভালো পাত্র এই অনাথ মেয়েকে কেন বিয়ে করবে? তাই সরাসরিই জিজ্ঞাস করলেন, পাত্রের স্বভাব চরিত্র কেমন? কোনো বদঅভ্যাস নেই তো? ঘটক বন্ধু দাদির মুখের কথা কেড়ে নিয়েই বললেন, না তেমন কোনো বদ অভ্যাস নেই, শুধু মাঝে মাঝে পিয়াজ খায়- এই যা।

দাদি কিছু বলার আগেই যোগ করলেন, না, মানে সব সময় খায় না যখন গো-মাংস খায়, তখন শুধু পিয়াজ খায়। হিন্দু পাত্রের গো-মাংস খাওয়ার কথা শুনে দাদি কী বলবেন বুঝতেই পারছিলেন না। তখন এলো আরেক চমক। না, মানে, সব সময় গো-মাংস খায় না। যখন সরাব টরাব খায়, তখন শুধু নেশা জমাতে গোমাংস খায়। দাদিকে আশ্বস্ত (?) করার জন্য আবার বলল, না মানে সব সময় তো আর মদ খায় না, জুয়ায় যখন বেশি টাকা হেরে যায়, তখন তো টাকার শোক ভোলার জন্য একটু মদ খেতেই হয়, নইলে অসুস্থ হয়ে যাবে না! দাদির বিস্ময় কাটাতে এবার নতুন তথ্য। না, মানে সব সময় তো আর জুয়া খেলে না। যখন ব্যাংক লুট করে, তথন হাতে অনেক টাকা আসে। এত টাকা ঘরে রাখা তো নিরাপদ না। তাই কিছু টাকা জুয়ার আসরে খরচ করে। দাদির অবস্থা দেখে এবার সহাস্যে নিবেদন, না না, সব সময় ব্যাংক লুট করে না, যখন ভাড়ায় মানুষ খুন একটু বেশি ঝুঁকি হয়ে যায়, তখন কিছু দিনের জন্য গা-ঢাকা দিতে শহরের বাইরে ব্যাংক লুট করে। এটুকু শুনেই দাদি জ্ঞান হারায়। নইলে ভাড়ায় মানুষ খুনের নেপথ্যে কারণ (?) ইত্যাদি ইত্যাদি হয়তো জানা যেত।

রাজধানীতে প্রায় ৬০টি ক্যাসিনোসহ অসংখ্য জুয়ার আসরের চিত্র উঠে এসেছে গত কয়েক দিনে। এমনকি থানার ২০০ গজের মধ্যে পরিচালিত ক্যাসিনো এবং মেহনতি মানুষের দল তথা বামপন্থি রাজনীতির পুরোধা ক্ষমতাসীন সাংসদের সভাপতিত্বে পরিচালিত একটি স্পোর্টস ক্লাবেও ক্যাসিনোর অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। আর এসব পরিচালনায় যারা সম্পৃক্ত, তারা এতদিন একটি দলের কর্ণধার থাকলেও এখন তাদের কেউ চিনেন না। তাই যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এতদিন ৬০ থানার ওসিরা কি আঙ্গুল চুষেছেন; আসলেই কি সব দায়িত্ব থানার ওসি সাহেবদের। একটি এলাকায় থানা-পুলিশ ছাড়াও সংসদ সদস্য, ওয়ার্ড কমিশনার, গোয়েন্দা সংস্থার সক্রিয় সদস্য ও সোর্স (?), মসজিদ কমিটি, সমাজ কল্যাণ সমিতি, ক্লাবের ক্রীড়া সংগঠকসহ অনেকেই থাকেন। আজ তারা কেউ কিছুই জানেন না, যে দলের সদস্যরা এসব পরিচালনা করতেন সে দলের কর্ণধাররাও এসব জানতেন না। তাই বিবেকের দায় নিয়ে এসব এলাকার নেতা, নেত্রী, সমাজপতি, প্রশাসক, পুলিশ-র‌্যাব সবার উচিত কাদের ইশারা বা কোন স্বার্থে তারা এতদিন চুপ ছিলেন বা আঙ্গুল চুষেছেন- তা প্রকাশ করা। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাদের একান্ত আস্থা এবং আনুগত্যই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

রাজনীতির একটি চক্রের মধ্যে বা আবর্তে ঢুকে পড়েছে বলে অনেকে দাবি করেন। বামপন্থিরা রাজনীতিতে কালো টাকাকে অশুভ ছায়া বলেছেন দীর্ঘদিন। আজ তাদের নেতার দিকেই যখন অভিযোগের তীর তখন কী বলবেন? রাজনৈতিক আদর্শ আজ একটি প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয়। কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বহু দেশেই রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়ন আর ক্ষমতায় আরোহণ সমার্থক। আর তাই তো দেখা যায় একই নেতা গান্ধীর সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করে পরক্ষণেই ছুটে যান গান্ধীর খুনির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। জনজরিপ যাই হোক, প্রেসিডেন্ট হন ট্রাম্প। রাজনীতিবিদদের জেলে পুরে দেশ চালায় প্লেবয় ক্রিকেটার। দেশের শিশুরা ক্ষুধায় গাছের পাতা খায়, সে দেশই আবার ড্রোন হামলা চালিয়ে জ্বালানির দাম বাড়ায়। দেশে দেশে জেলে বন্দী থাকে বিরোধীদলীয় নেতারা। সুতরাং কোনো অবস্থাতেই বিরোধী দলে যাওয়া যাবে না। ক্ষমতাই হলো মূল কথা। ক্ষমতাই হলো আদর্শ।

কীভাবে ক্ষমতায় যাওয়া যায়Ñ এর উত্তর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইয়ে এক রকম আর দেশে দেশে কিংবা বাস্তবে আরেক রকম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যাকরণে একটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। নির্বাচনে বিজয়ীরা সরকার গঠন করবে আর বিরোধীরা গড়বে ছায়া সরকার। ক্ষমতাসীন দলের একটি বিচ্যুতি তুলে ধরে তারা ক্ষমতায় থাকলে কী করত বা ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে কী করবে তা প্রকাশ করে পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার চেষ্টা করবে। বাস্তবে দেখা যায়, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের চাহিদা এত বেশি থাকে যে, কোনো সরকারের পক্ষেই এই চাহিদা পূরণ সম্ভব হয় না। কারণ তৃতীয় বিশ্ব সম্পদে সমৃদ্ধশালী নয়। তার ওপর থাকে আন্তর্জাতিক চাপ, বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং অল্প খরচে পঞ্চম বাহিনী বা সন্ত্রাসী দল গড়ার সুযোগ। তাই সরকারকে বেছে নিতে হয় একটি পথ। তা হলো- সব ঠিক আছে, দেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে, আর এভাবে অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে বর্তমান সরকারকে আবারও ক্ষমতায় আনতে হবে এই তত্ত্ব প্রচার। যারা অবস্থার বিরুদ্ধাচরণ করবে তাদের জন্য মুক্তাঙ্গন খুলে দিতে কোনো সরকারই তৃতীয় বিশ্বে ঝুঁকি নেবে না। তাই তাদের দমনের জন্য প্রয়োজন অনুগত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, দলীয় শক্তির উন্মত্ত প্রদর্শন আর রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব বলয়। এই তিন শ্রেণির আবার একটাই কাজ। সরকারকে বুঝান সব ঠিকই আছে। আর বিরোধী দল তো নীরব কিংবা স্বপ্লবাক আছেই। সুতরাং হেসেখেলেই মেয়াদ শেষ হওয়ার একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়। কিন্তু মাঝে মাঝেই যেন বাদ সাধে মিডিয়া। কোত্থেকে পর্দা, বালিশ, বই, ঢেউটিন, ক্যাসিনোÑ এসব খুঁড়ে বের করে যে মানুষ একটু হলেও নড়েচড়ে বসে। তাই বলে তৃতীয় বিশ্বের সরকারও কম যায় না। নতুন কিছু বা নতুন ইস্যু যেন তৈরি করাই থাকে। শুধু ছিপি খুলে ছড়িয়ে দেয়। ব্যস আগের সব ভুলে মানুষ মেতে উঠে নতুন বিষয় নিয়ে।

অতঃপর আসে নির্বাচন। যে দেশে একটি ছাত্র সাংসদের সাধারণ পদ ৩০ লাখ টাকায় কিনে ছয় মাসে দ্বিগুণ লাভের অডিওসহ প্রমাণ পাওয়া যায়, সে দেশে একটা সংসদ সদস্য হওয়া কতটা লাভজনক, তা বুঝতে খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন নেই। তাই তো শোনা যায়, লন্ডনসহ বিভিন্ন স্থানে নমিনেশন বাণিজ্যের খবর। সুতরাং টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রথমে নমিনেশন ক্রয়, তার আগে ও পরে ব্যাপক শোডাউন করে জনপ্রিয়তা প্রমাণের প্রচেষ্টা, অবশেষে নির্বাচনে পেশিশক্তির ব্যবহার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা প্রশাসনের নীরব ভূমিকাÑ এই আবর্তেই ঘোরে তৃতীয় বিশ্বের নির্বাচন। তাই নির্বাচনকে মাথায় রেখে তৃতীয় বিশ্বের সরকারগুলো যখন টাকা, পেশিশক্তি ও নীরব প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে, তখনই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক অনাচার, অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি, প্রশাসনের দাম্ভিকতা ও সেবকের বেশে প্রভুসুলভ আচরণ।

গ্রেনেড হামলা, গুম, ব্যাংক লুট, এতিমের অর্থলুট, বিদেশি ব্যাংকে টাকার পাহাড় প্রভৃতির অর্থ তখন একই দাঁড়ায়Ñ শুধু প্রেক্ষাপট থাকে ভিন্ন। এই দুষ্ট আবর্তেই ঘুরছে তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি? এই দুষ্ট আবর্ত ভাঙার পূর্বাভাস ক্যাসিনো অভিযান। তাই সাম্প্রতিক ক্যাসিনো প্রসঙ্গ দিয়েই শেষ করছি। আচ্ছা, বিরোধী দল, ধর্মভিত্তিক দল, গণমানুষের কথা বলা বামদল, সুশীল সমাজ কেউ কি জানত না ৬০টি ক্যাসিনো চলছে ঢাকায়? দুদকের কার্যালয়ে কিংবা রাজস্ব ভবন থেকে কত দূরে ক্যাসিনোগুলো? তাদের গোয়েন্দারা মফস্বলের ইঞ্জিনিয়ারকে জাল পেতে ধরে আর চোখ বন্ধ করে ঢাকার ক্যাসিনোর সামনে দিয়ে হেঁটে যায়? যারা ক্যাসিনোতে নিয়মিত যেতেন, তারা কত টাকা আয়কর দিতেন সরকারকে? রাষ্ট্রীয় আনসার বাহিনী কীভাবে ক্যাসিনো পাহারায় নিয়োগ পায়? আর পুলিশ তাদের তো ‘আঙ্গুল চোষা’ খেতাব দিয়েই দিয়েছেন মুরব্বিরা। অতএব মন্তব্য নিপ্র্রয়োজন।

লেখক : প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা, গবেষক ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর